আমি ব্লগ লেখার খুব বেশি সমর্থক কোনওদিনও ছিলাম না, সত্যি কথা বলতে কি এখনও যে আছি তা নয় । তার একটা প্রধান কারণ আমার ধারণা ব্লগ লেখার থেকেও পড়া অনেক বেশি ক্লান্তিকর । অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, অনেক সময়ই পড়তে শুরু করে শেষ করা হয়ে ওঠে না । নিজের ধৈর্য এবং/অথবা আগ্রহের অভাবকে 'ঠিক আছে, বাকিটা পরে পড়ব' জাতীয় অজুহাত দিয়ে ঢেকে দিই - আর আমরা সবাই জানি সেই 'পরে' টা আর কখনওই আসে না । তো, এই কারণে আমি ঠিক করেছি আমার ব্লগকে কখনওই অন্যের ক্লান্তির কারণ ঘটাব না, আমার ব্লগের বিষয় হবে প্রধানতঃ ভ্রমণ । আমার মতো যেসব বাঙালিরা ঘুরতে ভালোবাসে, তাদের জন্য আমার ব্লগ হবে তথ্যের একটা উৎস । আমার নিজের একটা অভ্যেস আছে, কোনও জায়গায় বেড়াতে যাওয়ার আগে সেই জায়গাটা সম্পর্কে কিছুটা জেনে নেওয়ার চেষ্টা করি, আর ইন্টারনেট ঘাঁটতে গিয়ে আমার বরাবরই মনে হয়েছে যে ইন্টারনেটে লেখালেখি করার ব্যাপারে বাঙালিদের থেকে কুঁড়ে খুব কম শিক্ষিত জাতই আছে । আমার মতো যেসব বাঙালিরা আছে, যারা ইন্টারনেটে কোনো একটা ইংরিজীতে লেখা দেখলেই না পড়ার চেষ্টা করে, তাদের জন্য আমার ব্লগ সহায়ক হবে, এই বিশ্বাস নিয়ে শুরু করছি আমার ভ্রমণকাহিনী । আগেই বলে রাখি, আমি স্ট্যাটিসটিক্সের ছাত্র ছিলাম, তাই আমার ব্লগে তত্ত্বের থেকে তথ্যের দেখাই মিলবে বেশি ।

Sunday, January 1, 2023

ঝাড়গ্রাম ও জামশেদপুর ভ্রমণ

বিশেষ সতর্কীকরণঃ

১. এই পুরো ভ্রমণে আমরা কোনও অবস্থাতেই কোনও পলিথিন বা প্লাস্টিক ব্যবহার করিনি। অর্থাৎ প্লাস্টিকের ব্যবহার না করেও এই ভ্রমণ অনায়াসে করা যায়।

২. এই পুরো ভ্রমণে আমরা কোনও কাগজ ব্যবহার বা নষ্ট করিনি। হোটেল বুকিং-এর রশিদ-এর প্রিন্ট আউট ব্যবহারের কোনও প্রয়োজন হয় না।

৩. এই পুরো ভ্রমণে আমাদের দলের কেউ ধূমপান করেনি। ধূমপান স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর।

আমার ব্লগের সমস্ত পাঠকদের বিশেষভাবে অনুরোধ করছি প্লাস্টিক, অপ্রয়োজনীয় কাগজের ব্যবহার আর ধূমপান বর্জন করার জন্য।

ভ্রমণপথঃ

বুধবার ২৮শে ডিসেম্বর, ২০২২ঃ সকাল ৬ঃ৪০ মিনিটে কলকাতা থেকে গাড়িতে যাত্রা করে দুপুর ১১ঃ৩০ মিনিটে ঝাড়গ্রাম - ঝাড়গ্রামে রাত্রিবাস।

বৃহস্পতিবার ২৯শে ডিসেম্বর, ২০২২ঃ সকাল ৯টায় গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে বেলপাহাড়ী - ঝাড়গ্রামে রাত্রিবাস।

শুক্রবার ৩০শে ডিসেম্বর, ২০২২ঃ সকাল ৯ঃ৩০ মিনিটে ঝাড়গ্রাম থেকে বেরিয়ে পথে সাইট সিয়িং - সন্ধ্যে ৭ঃ৩০ মিনিটে জামশেদপুর - জামশেদপুরে রাত্রিবাস ।

শনিবার ৩১শে ডিসেম্বর, ২০২২ঃজামশেদপুরে সাইট সিয়িং - জামশেদপুরে রাত্রিবাস।

রবিবার ১লা জানুয়ারী, ২০২৩ঃ সকাল ৯টায় জামশেদপুর থেকে বেরিয়ে পথে সাইট সিয়িং - দুপুর ২টোয় খড়্গপুরে মনসামন্দির - বিকেল ৪টেয় খড়্গপুর থেকে বেরিয়ে সন্ধ্যে ৬ঃ৩০ মিনিটে কলকাতা।

মাদের পশ্চিমবঙ্গ জেলার পশ্চিমে নবনির্মিত জেলা ঝাড়গ্রাম। এই জেলার সদর হল ঝাড়গ্রাম শহর। ঝাড় অর্থাৎ ঘন জঙ্গল - সেই থেকে গ্রামের নাম ঝাড়গ্রাম। ঝাড়গ্রাম জেলা মোটামুটি পশ্চিমবঙ্গ আর ঝাড়খন্ডের সীমানায় আর সীমানা পেরিয়ে কিছুদূর গেলে ঝাড়খন্ড জেলার সবথেকে বড় এবং সবথেকে বেশি জনবসতিপূর্ণ শহর জামশেদপুর। ইংরিজির বর্ষশেষের কয়েকদিন ধরে এই ঝাড়গ্রাম আর জামশেদপুরে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা নিয়েই আমার ব্লগের এবারের পোস্ট।

বছরের শেষের দিনগুলোয় ঘুরতে যাওয়ার প্রধান সমস্যা হল এই সময়ে যেকোনও পরিচিত জায়গাতেই প্রচন্ড ভীড় হয় যার ফলে হোটেল, ট্রেনের বুকিং ইত্যাদির পাওয়া মুশকিল হয়। হোটেলের ভাড়া, ঘোরার গাড়িভাড়া, খাবারের দাম সবই বছরের অন্যান্য সময়ের থেকে বেশ কিছুটা বেশি হয়। ভীড়ের কারণে জায়গাগুলো ভালোভাবে ঘোরাও যায় না। এইসব মাথায় রেখে এই সময়ে ঘোরার জন্য আমরা সাধারণতঃ তুলনামূলকভাবে অপরিচিত বা কম বিখ্যাত জায়গা খুঁজে বের করি। আমাদের গাড়ি নিয়ে শেষ গিয়েছিলাম গত মার্চ মাসে বরন্তি ও গড়পঞ্চকোটে, তাই যখন ঝাড়গ্রাম আর জামশেদপুর যাওয়ার কথা হল, তখন গাড়ি নিয়ে যাওয়াই স্থির করলাম।

ব্রেকফাস্ট ব্রেক
২৮শে ডিসেম্বর, ২০২২ - বুধবার সকাল ৬ঃ৪০ মিনিটে আমরা বেরোলাম আমাদের গাড়ি নিয়ে। এবারে আমরা আটজন - আমি, অমৃতা, বাবা, মা, কথা, কলি, সোনামাসি আর মশাই। কলকাতা থেকে ঝাড়গ্রামের দূরত্ব ১৮০ কিলোমিটারের মতো - যেতে ঘন্টা চারেক লাগার কথা। যাত্রাপথ কলকাতা - বিদ্যাসাগর সেতু পেরিয়ে কোনা এক্সপ্রেসওয়ে - ১৬ নং জাতীয় সড়ক - ৪৯ নং জাতীয় সড়ক - ৫ নং রাজ্য সড়ক - ঝাড়গ্রাম । আমরা কোলাঘাটের কাছে একটা দোকান থেকে লুচি তরকারি দিয়ে ব্রেকফাস্ট করে নিলাম (না, শের-ই-পাঞ্জাব নয়)। খরচ হল ৩৫০/- টাকা। এছাড়া রাস্তায় আরেকবার দাঁড়িয়েছিলাম চা খাওয়ার জন্য। বেলা সাড়ে এগারোটা নাগাদ আমরা পৌঁছে গেলাম আমাদের গন্তব্য - ঝাড়গ্রামের সোমানি ইন্‌-এ।

সোমানি ইন্‌-এর ঘর
সোমানি ইন্‌ হোটেলটা বেশ বড়। একটা কম্পাউন্ডের মধ্যে দুদিকে দুটো আলাদা বিল্ডিং আর মাঝখানে একটা বড় চত্বর। এখানে গাড়ি পার্কিং-এর ব্যবস্থা রয়েছে। আমাদের দুটো ঘর নেওয়া ছিল - একটা ডাব্‌ল্‌ বেড আর একটা ফোর বেড। ঘরগুলো বেশ বড়, প্রত্যেকটা ঘরের সঙ্গে লাগোয়া ব্যালকনি। আমরা স্নানটান করে নিয়ে ডাইনিং রুমে গেলাম। ডাইনিং রুমটাও বেশ বড় - একসঙ্গে অন্ততঃ সত্তর-আশিজন বসে খেতে পারে। আমরা মাছ থালি, ডিম থালি আর নিরামিষ থালি মিলিয়েমিশিয়ে নিলাম। খরচ হল ১,৩৪০/- টাকা।

লাঞ্চ করে গাড়ি নিয়ে আমরা কাছাকাছি জায়গাগুলো ঘুরতে বেরোলাম।

ঝাড়গ্রাম রাজবাড়ি
ঝাড়গ্রাম রাজবাড়ি - আমাদের হোটেল থেকে ৪.৫ কিলোমিটার দূরে ঝাড়গ্রাম শহরের মধ্যেই ঝাড়গ্রাম রাজবাড়ি। এখানে পৌঁছে গাড়ি বাইরে রেখে আমরা একটা ফটক দিয়ে হেঁটে ঢুকলাম। কিছুটা হাঁটার পর আরেকটা লোহার গেট আর সেটা বন্ধ। মূল রাজবাড়িতে প্রবেশ নিষেধ, এই গেটের বাইরে থেকেই রাজবাড়িটা দেখতে হয়। এই রাজবাড়ি বর্তমানে হোটেল হিসেবে ব্যবহার হয় অর্থাৎ কেউ চাইলে এখানে থাকতে পারে। আর এই কারণেই বুকিং না থাকলে বাইরের কাউকে এখানে ঢুকতে দেওয়া হয় না। আমরা লোহার গেটের বাইরে থেকেই যা দেখার দেখে নিলাম। বাড়িটা দেখতে খুবই সুন্দর আর সেইসঙ্গে এর আয়তনও বিশাল। এটা অবশ্য নতুন রাজবাড়ি যা ১৯৩১ সালে তৈরি হয়। এই বাড়িতে সিনেমার শ্যুটিং হয় এটা আগেই জানতাম। যেমন 'টিনটোরেটোর যীশু'তে নিয়োগী বাড়ি বা 'দুর্গেশগড়ের গুপ্তধন' ছবিতে ডাম্বলদের বাড়ির শ্যুটিং এই বাড়িতেই হয়েছে। নতুন বাড়ির পিছনে পুরনো রাজবাড়িটা এখনও আছে, যদিও সেটা বাইরে থেকে দেখা যায় না। আমরা এখানে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ছবি তুলে বাইরে বেরিয়ে এলাম।

প্রকৃতি পর্যটন কেন্দ্র
প্রকৃতি পর্যটন কেন্দ্র - ঝাড়গ্রাম রাজবাড়ি থেকে ১.৫ কিলোমিটার দূরে ঝাড়গ্রাম প্রকৃতি পর্যটন কেন্দ্র। এটা প্রকৃতপক্ষে একটা রিসর্ট। আমাদের আসার পথে যে ৫ নং রাজ্য সড়ক পড়েছিল এটা তারই পাশের জঙ্গলের মধ্যে। এটাই এর বৈশিষ্ট্য। রিসর্ট একটা দেখার মতো কিছু নয়, তাই আমরা এখানে আর গাড়ি থেকে নামলাম না, যেটুকু দেখার সেটা দেখে চলে এলাম।

সাবিত্রী মন্দির
সাবিত্রী মন্দির - প্রকৃতি পর্যটন কেন্দ্র থেকে ঝাড়গ্রাম শহরের দিকে ফেরার পথে ১ কিলোমিটার গেলে সাবিত্রী মন্দির। এটাও রাস্তার ধারে। মন্দিরটা সেরকম কিছু বড় নয়, তবে বেশ পরিপাটি। এটা সাবিত্রী দেবীর মন্দির যাঁকে এখানে দুর্গা ধ্যানে পুজো করা হয়। মূল মন্দিরের মাথাটা গম্বুজাকৃতি। চত্বরটা মার্বেল দিয়ে বাঁধানো। ভিতরে একটা বাগান রয়েছে, সেখানে টবে নানারঙের ফুলের রকমারি গাছের বাহার। আমরা এখানে কিছুক্ষণ থেকে এগিয়ে গেলাম আমাদের পরবর্তী গন্তব্যের দিকে।

মিনি জু-এর ভিতরে
ঝাড়গ্রাম মিনি জু - সাবিত্রী মন্দির থেকে ৫ কিলোমিটার দূরে ঝাড়গ্রাম শহরের সবথেকে বড় আকর্ষণ - ঝাড়গ্রাম মিনি চিড়িয়াখানা। চিড়িয়াখানায় গিয়ে দেখলাম এখানে বেশ ভালোই ভিড় হয়েছে। এটা খুবই স্বাভাবিক কারণ শীতকালের এই সময়টা চিড়িয়াখানা দেখার পক্ষে একেবারে আদর্শ (কলকাতার আলিপুর চিড়িয়াখানাতেও এই সময়ে প্রচন্ড ভিড় হয়)। নির্ধারিত জায়গায় গাড়ি পার্কিং করে আমরা টিকিট কেটে চিড়িয়াখানায় ঢুকলাম তখন বিকেল ৩ঃ৪৫। টিকিটের মূল্য বড়দের মাথাপিছু ২৫/- টাকা আর ছোটদের (৩ থেকে ১২ বছর) মাথাপিছু ১০/- টাকা।

মিনি জু-এ চিতা
ঝাড়গ্রাম জায়গাটা জঙ্গলমহলের মধ্যে পড়ে। তাই এই চিড়িয়াখানার নাম 'জঙ্গল মহল জুলজিক্যাল পার্ক'। চিড়িয়াখানার পরিসরটা বেশ বড়। পুরো জায়গাটা একটা অসমতল ভূমির উপর আর সেইসঙ্গে গাছপালা ঘেরা। ফলে বেশ একটা জঙ্গল জঙ্গল অনুভূতি হয়। এই জঙ্গলের মধ্যেই খাঁচা দিয়ে ঘেরা অনেকগুলো জায়গা আছে আর তার ভিতরে রয়েছে বিভিন্ন জানোয়ার আর পাখি। জানোয়ারের মধ্যে হরিণ নীলগাই কচ্ছপ গোসাপ খরগোশ ভাল্লুক চিতা হায়না বাঁদর ইত্যাদি আরও নানা চেনা অচেনা প্রজাতি আছে। পাখিদের মধ্যে রয়েছে এমু উটপাখি ময়ূর ইত্যাদি। তাছাড়া একটা সাপের ঘরও আছে। শীতকালে সাধারণতঃ সাপের দেখা পাওয়া যায় না কিন্তু চিড়িয়াখানার সাপ থাকে কাচের ঘরের ভিতরে তাই এখানে আমরা গোখরো অজগর ইত্যাদি বেশ কয়েকটা সাপকেই দেখতে পেলাম। ঢোকার সময়ে পুরো চিড়িয়াখানাটা যতটা বড় বলে মনে হয়েছিল, বাস্তবে সেটা তার থেকে অনেকটাই বড়, তাই দেখতে দেখতে প্রায় সন্ধ্যে হয়ে গেল।

চিড়িয়াখানা থেকে বেরিয়ে আমরা হোটেলে ফেরার পথ ধরলাম। রাস্তায় একজায়গায় চা-টা খেয়ে নেওয়া হল। হোটেলে ফিরে আর কিছু করার নেই, তাই গল্প করে আর টিভি দেখে সময় কাটিয়ে দিলাম। রাতে ডিনারটা আমরা ঘরে বসেই করলাম। ভাত, ডাল, রুটি, তড়কা, পনীর ইত্যাদি নিয়ে খরচ হল ৫৫৪/- টাকা।

২৯শে ডিসেম্বর, ২০২২ বৃহস্পতিবার - আমাদের বেলপাহাড়ী যাওয়ার দিন। সকাল নটা নাগাদ আমরা হোটেল থেকে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে একটা দোকান থেকে পরোটা, ঘুগনি আর ওমলেট দিয়ে ব্রেকফাস্ট করে নিলাম। এই দোকানের পরোটাটা বিশেষ ভালো। সবমিলিয়ে খরচ পড়ল ১৮০/- টাকা। এরপর আমরা বেলপাহাড়ী রওনা দিলাম।

ঝাড়গ্রাম থেকে বেলপাহাড়ী যেতে হলে যে ৫ নং রাজ্য সড়ক দিয়ে আমরা এসেছি, সেটা ধরেই আরও ৫০ কিলোমিটার এগিয়ে যেতে হয়। বেলপাহাড়ী পোঁছে জাতীয় সড়ক থেকে ডানদিকে একটা সরু রাস্তা ধরে ৫ কিলোমিটার গিয়ে আমরা পৌঁছলাম আমাদের প্রথম গন্তব্য - ঘাগরা জলপ্রপাতে।

ঘাগরা জলপ্রপাত
ঘাগরা জলপ্রপাত - জায়গাটায় পৌঁছে দেখলাম এখানে রীতিমতো পিকনিক হচ্ছে ! তবে পিকনিকের মতোই জায়গাও বটে। গাড়ি পার্কিং করে আমরা জলপ্রপাতের দিকে নেমে গেলাম। নদীর নাম তারাফেণি। বলা বাহুল্য, এই নদী বরফগলা জলে পুষ্ট নয়, বৃষ্টির জলে পুষ্ট তাই শীতকালে এতে স্রোত আশা করা বৃথা। নদীর সরু ধারা এখানে কিছু অনুচ্চ পাথরের উপর থেকে নিচে পড়ছে। জলপ্রপাত সেভাবে না দেখতে পেলেও জায়গাটার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অনস্বীকার্য। আমরা পাথরের উপরে পা-দিয়ে নদীর অন্যপারের উঁচু জায়গাগুলোয় গেলাম আর সেখান থেকে আবার আরেকটা দিক দিয়ে হেঁটে ফিরে এলাম। দিনের বেলা সূর্য মাথার উপরে তাই বেশ গরম লাগছিল। ঘাগরা জলপ্রপাত দেখে আমরা আবার এগিয়ে চললাম আমাদের পরবর্তী গন্তব্যের দিকে।

তারাফেণি বাঁধ
তারাফেণি বাঁধ - ঘাগরা জলপ্রপাত থেকে ভিতরের সরু রাস্তা দিয়ে আরও ৫ কিলোমিটার গেলে তারাফেণি বাঁধ। এখানে কিন্ত নদীর আকার বেশ বড় আর জলের পরিমাণও অনেক বেশি। এই জল লক্‌গেটের সাহায্যে আটকে রেখেই এখানে জলাধার তৈরি হয়েছে। লক্‌গেটের দুটো দিক দেখতে বেশ মজা লাগে - একদিকে সুগভীর জল আর অন্যদিকে খটখটে শুকনো। সবজায়গায় এটা এত কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়না। আমরা দুটো দিক বেশ ভালোভাবে দেখে ছবিটবি তুলে নিলাম।

গুড় জাল
তারাফেণি বাঁধের পাশেই একজায়গায় দেখলাম গুড় জাল দেওয়া হচ্ছে। এখানে রাস্তায় অনেক জায়গাতেই গুড় বিক্রি হয় সেটা আগেও দেখেছি। আমি নিজে গুড় জাল দেওয়া ব্যাপারটা কোনওদিন দেখিনি। মাটির মধ্যে গর্ত করে উনুন আর তার উপরে একটা বেশ বড় সাইজের চওড়া ট্রের মতো জিনিসে খেজুরের রস জাল দেওয়া হচ্ছে। এই রস জাল দিয়ে ঘন হবে আর সেটাই পাতলা গুড়ে পরিণত হবে। সেই পাতলা গুড় জমিয়ে আবার পাটালি তৈরি হবে। যে এই গুড় তৈরি করছে, পাশেই তার বাড়ি - সেখানে গুড় বিক্রিও হচ্ছে। দাম বেশ সস্তা। একটু চেখে দেখলাম, গুড়টা বেশ ভালো। তারপর বাড়ির জন্য আমরা এক কিলো গুড় কিনে নিলাম।

ঝাড়গ্রামের এ ডি এফ ও-র সঙ্গে আমরা
তারাফেণি বাঁধ থেকে আমরা আবার ৫ নং রাজ্য সড়কে ফিরে এলাম। অমৃতার কলেজের বন্ধু পার্থ মুখার্জীর সঙ্গে এখানে আমাদের দেখা হল । পার্থ বর্তমানে ঝাড়গ্রাম জেলার এ ডি এফ ও (অ্যাডিশনাল ফরেস্ট ডেভেলপ্‌মেন্ট অফিসার বা অতিরিক্ত বন আধিকারিক)। ও একটা সরকারী কাজে বেলপাহাড়ীতে এসেছে, সেই সুযোগে আমাদের সঙ্গে দেখা করে নিল। মিনিট দশেক আমরা দাঁড়িয়ে কথা বললাম আর তার মধ্যে ওর কাছ থেকে বেশ কিছু প্রয়োজনীয় তথ্য জানলাম। কথাগুলো যেভাবে হয়েছিল, আমার ব্লগের পাঠক/পাঠিকাদের জন্য সেভাবেই লিখছি ঃ

অমৃতা ঃ এখানে চারদিকে জঙ্গল, তোকে তো সারাক্ষণই ব্যস্ত থাকতে হয়।

পার্থ ঃ সে আর বলতে। ঝাড়গ্রামের চারপাশে জঙ্গলের মধ্যে নানারকম জন্তু-জানোয়ার রয়েছে। আমাদের সারাক্ষণই ছুটে বেড়াতে হয়। অন্য সব জন্তুকে কন্ট্রোল করা যায়, কিন্তু সবচেয়ে বেশি চাপ হয় হাতিকে নিয়ে।

অমৃতা ঃ হাতি কি যখন তখনই বেরিয়ে পড়তে পারে ?

পার্থ ঃ যেকোনও সময়ে। তোরা যেখানে আছিস, অর্থাৎ সোমানি ইনে, তার ৫ কিলোমিটারের মধ্যে দিয়ে হাতি ঘোরাফেরা করে। কিছুদিন আগে তোদের হোটেলের ঠিক সামনের রাস্তা দিয়ে হাতির পাল চলে গেছে। ওখানে একটা স্কুলের পাঁচিল হাতির ধাক্কায় ভেঙে গেছে।

অমৃতা ঃ ও বাবা !

পার্থ ঃ আমাদের এইভাবেই চলে ! তোরা চিড়িয়াখানাটা দেখেছিস ? ওখানে যে চিতাটা আছে, গতবছর ওটা চিড়িয়াখানা থেকে পালিয়েছিল।

অমৃতা আর আমি একসঙ্গে ঃ পালিয়েছিল ? কিকরে ?

পার্থ ঃ (নির্লিপ্তভাবে) খাঁচা টপকে।

অমৃতা ঃ অত উঁচু খাঁচা টপকাতে পারল ?

পার্থ ঃ (নির্লিপ্তভাবে সম্মতিসূচক ঘাড় নেড়ে) হ্যাঁ। পালিয়ে গিয়ে সে জঙ্গলে ঢুকে গিয়েছিল। তারপর অনেক খোঁজাখুঁজি করে শেষ পর্যন্ত তাকে পাওয়া যায়। তারপর ট্রায়াঙ্কুলাইজার দিয়ে ধরা হয়।

অমৃতা ঃ (কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে) এখানে তোর নানারকম অভিজ্ঞতা হয়। শুনতেও বেশ ভালো লাগে। আমরা তো আজ জঙ্গলে যাব ঠিক করেছি, আমাদের কি কোনও জন্তু জানোয়ার দেখার সম্ভাবনা আছে ?

পার্থ ঃ তোরা তো যাবি কাঁকড়াঝোর ফরেস্ট, ওখানে জানোয়ার দেখার চান্স কম। হয়তো জঙ্গলের মধ্যে হরিণের পাল দেখতে পেতে পারিস।

অমৃতা ঃ যাঃ, আর অন্য কিছুই দেখা যাবে না ?

পার্থ ঃ সম্ভবতঃ না। আর না দেখতে পাওয়াই ভালো !

পার্থর এই শেষের কথাটা আমি চূড়ান্তভাবে সমর্থন করলাম। আমার মতে জানোয়ার দেখতে হলে একটা নির্দিষ্ট দূরত্ব থেকে দেখাই শ্রেয় এবং আমার আর জানোয়ারের মধ্যে একটা অনতিক্রম্য দেওয়াল (খাঁচা বা ওইজাতীয় কিছু) থাকাটা অবশ্য প্রয়োজনীয়। অর্থাৎ, হয় জানোয়ার খাঁচার মধ্যে আর আমি খাঁচার বাইরে অথবা জানোয়ার খাঁচার বাইরে আর আমি খাঁচার মধ্যে। জঙ্গলের মধ্যে রাস্তা দিয়ে গাড়ি করে যেতে যেতে হঠাৎ যদি দেখি একপাল হাতি রাস্তা পার হচ্ছে বা একটা বাঘ রাস্তার উপরে বসে বিশ্রাম নিচ্ছে, সেই অভিজ্ঞতা আমার কাছে মোটেই রোমাঞ্চকর হবে না। তার মানে এই নয় যে আমি এদের ভালোবাসি না। আমি জানোয়ার খুবই ভালোবাসি - কিন্তু সেটা একটা নির্দিষ্ট ব্যবধান থেকে। এই ব্যবধান তৈরি করার জন্য আমাদের পূর্বপুরুষরা ওদের পূর্বপুরুষদের সঙ্গে হাজার হাজার বছর ধরে লড়াই করেছে। আর আমি এই ব্যবধানটা কমাতে চাই না।

পার্থর থেকে বিদায় নিয়ে আমরা এগিয়ে চললাম আমাদের পরবর্তী গন্তব্য গদ্রসিনি পাহাড়ের দিকে। রাজ্য সড়ক ছেড়ে একটা গাছপালা ঘেরা মেঠো পথ ধরে সাত কিলোমিটার মতো চলার পরে আমরা পৌঁছলাম আমাদের দিনের তৃতীয় গন্তব্যে।

১০০ মিটার উচ্চতায় বাসুদেবের মন্দির
গদ্রসিনি পাহাড় - গদ্রসিনি পাহাড়ের উচ্চতা ২০০ মিটারের মতো। উপরে একটা শিবমন্দির আছে। ট্রেকিং করে উঠতে হয়। ওঠার রাস্তাটা একেবারেই শুশুনিয়া পাহাড়ের মতো অর্থাৎ পাথুরে এবড়োখেবড়ো। বরন্তি ভ্রমণের সময়ে কথা-কলি ৪৫০ মিটার উঁচু শুশুনিয়া পাহাড়ের মাথায় উঠেছিল, তাই এই গদ্রসিনি পাহাড় ওদের কাছে যাকে বলে 'বাচ্চাদের কাজ'। কথা কলি আর আমি উঠতে শুরু করলাম পাহাড়ের মাথায়। এখানেও বেশ ভীড়, অনেকেই পাহাড়ে চড়ছে। ১০০ মিটারের উপরে এখানে একটা বাসুদেবের মন্দির আছে - সম্ভবতঃ যারা ২০০ মিটার চড়তে পারবে না তাদের জন্য। আমরা এখানে একটু দাঁড়িয়ে আরও উপরে ওঠা শুরু করলাম।

গদ্রসিনি পাহাড়ের উপরে
বাকি পথটা বলতে গেলে পাহাড়ের পিছন দিক দিয়ে। এখানে ওঠার সময়ে পাহাড়ের পিছনের অনন্যসাধারণ দৃশ্য দেখে চোখ জুড়িয়ে গেল। যতদূর চোখ যায় দিগন্তবিস্তৃত জঙ্গল - ঘন সবুজ গাছের ফাঁকে কোথাও কোথাও কিছুটা ন্যাড়া জমি। এরপর আরও কিছুটা ওঠার পরে আমরা পৌঁছে গেলাম পাহাড়ের একেবারে মাথায়। শিবমন্দিরটাও দেখতে পেলাম তবে মন্দিরে ঢুকতে গেলে আবার জুতো খুলতে হবে বলে আর সেদিকে গেলাম না। বরং উপর থেকে নিচের দৃশ্য প্রাণভরে উপভোগ করলাম।

এবার নামার পালা। ওঠার সময়ে লেগেছিল পনেরো মিনিটের মতো, নামার সময়েও ওইরকমই লাগল। আগেও দেখেছি এইধরণের পাহাড়ে উঠতে নামতে প্রায় একই সময় লাগে। ওঠার সময়ে প্রয়োজন হয় দমের আর নামার সময়ে প্রয়োজন হয় ব্যালেন্সের।

দুপুর দুটো বেজে গেছে আর খিদেও পেয়েছে। গদ্রসিনি পাহাড় থেকে ফেরার পথে গ্রামের মধ্যেই একটা হোটেল পেয়ে গেলাম - নাম পবিত্র হোম স্টে। এখানে খাওয়াদাওয়া আর থাকার ব্যবস্থাও আছে। ভাত ডাল আলুভাজা তরকারি মাছ সবমিলিয়ে খরচ হল ১,১০০/- টাকা।

খাঁদারাণী লেকের পথে
লাঞ্চের পরে আমরা এগিয়ে চললাম আমাদের পরবর্তী গন্তব্য - খাঁদারাণী লেকের দিকে। গদ্রসিনি পাহাড় থেকে ভিতরের রাস্তা দিয়ে খাঁদারাণী লেকের দূরত্ব মাত্র ২ কিলোমিটার আর যেতে মিনিট দশেকের বেশি লাগে না কিন্তু আমরা খাওয়ার জন্য কিছুটা এগিয়ে এসেছিলাম বলে আমাদের একটু ঘুরে যেতে হল। আমরা খাঁদারাণী লেক যখন পৌঁছলাম, ঘড়িতে তখন বিকেল পৌনে চারটে।

খাঁদারাণী লেক
খাঁদারাণী লেক - লেকটা বেশ বড়। এটা একটা প্রাকৃতিক হ্রদ। দেখতে বেশ সুন্দর। বিশেষ করে চারদিকে বেশ কিছু পাহাড়ের মধ্যে (তার মধ্যে গদ্রসিনিও আছে) এই লেকের সৌন্দর্য যেন আরও বেশি করে চোখে পড়ছিল। আমরা উপরের রাস্তা থেকে নিচে একেবারে লেকের পাড়ে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম। বিকেল প্রায় হয়ে গেছে আর কিছুক্ষণ পরেই সূর্যাস্ত হবে, এই সময়ে লেকের দৃশ্য আরও সুন্দর লাগছিল। লেকের উপরে একটা সরু ব্রীজ আছে যেটা দিয়ে একটা গাড়িই যেতে পারে। এই রাস্তা দিয়ে লেকের ওপারে গিয়ে কিছুটা গেলে গদ্রসিনি পাহাড়ে যাওয়ার রাস্তা পাওয়া যায়।

খাঁদারাণী লেকে কিছুক্ষণ থেকে আমরা এবার রওনা দিলাম আমাদের দিনের শেষ গন্তব্য - কাঁকড়াঝোর ফরেস্টের দিকে। আমাদের গন্তব্য ফরেস্টের নির্দিষ্ট কোনও জায়গা নয়, প্রকৃতপক্ষে ফরেস্টের ভিতরের রাস্তাটা দিয়ে যাওয়াই আমাদের উদ্দেশ্য। খাঁদারাণী লেক থেকে ২.৫ কিলোমিটার মেঠো পথে এসে আবার আমরা ৫ নং রাজ্য সড়কে উঠলাম। তারপর রাজ্য সড়ক দিয়ে ১৪ কিলোমিটার এগিয়ে গিয়ে চাকাডোবা বলে একটা জায়গা থেকে রাজ্য সড়ক ছেড়ে বাঁদিকে ঘুরে আমরা কাঁকড়াঝোর রোড ধরলাম।

কাঁকড়াঝোর ফরেস্ট - কাঁকড়াঝোর রোডটা প্রথমদিকে লোকালয়ের মধ্যে দিয়ে হলেও একটু পরে শুরু হল জঙ্গল। সে এক অদ্ভুত দৃশ্য ! দুদিকের শালগাছের ঘন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে বাঁধানো রাস্তা এগিয়ে চলেছে। ঘড়ি বলছে পৌনে পাঁচটা - শীতকাল হওয়ায় দিনের আলো বেশ কমে এসেছে। আর চারপাশে জঙ্গল হওয়ায় আলো এমনিতেই আরও কম। এই আলোআঁধারি পরিবেশের মধ্যে জঙ্গলের ভিতরের রাস্তা দিয়ে এগিয়ে চলেছে আমাদের গাড়ি। সামনে পিছনে যতদূর চোখ যায়, দ্বিতীয় কোনও গাড়ির উপস্থিতি চোখে পড়ছে না। রাস্তাটা ক্রমাগত দিকপরিবর্তন করছে বলে গাড়ির গতি মাঝেমাঝেই কমাতে হচ্ছে আর সেইসময়ে জঙ্গলের মধ্যে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রেখে দেখা হচ্ছে কোনও জানোয়ার চোখে পড়ে কিনা। জঙ্গল কোনও কোনও জায়গায় একটু পাতলা হয়ে এসেছে, কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই আবার ঘন হয়ে যাচ্ছে। শেষপর্যন্ত যখন একটা দু'টো করে বাড়ি চোখে পড়তে পড়তে একটা লোকালয় শুরু হয়ে গেল, তখন বুঝলাম আমরা জঙ্গলটা পেরিয়ে এসেছি। জঙ্গলের মধ্যে গাড়ি করে যাওয়ার একটা অসাধারণ অভিজ্ঞতা হল এটা বলতেই হবে আর গাড়ির ড্রাইভার হিসেবে এই পথে গাড়ি চালানোর অভিজ্ঞতা আমার বাড়তি পাওনা। আমার মতো যারা গাড়ি চালাতে ভালোবাসে, তাদের বিশেষভাবে অনুরোধ করব এই পথে একবার গাড়ি নিয়ে ভ্রমণ করার জন্য। পার্থ আমাদের বলেছিল পারলে এই পথ দিয়ে বিকেল-সন্ধ্যে নাগাদ যেতে আর ঘটনাচক্রে আমরা সেটাই করেছি। এই দূর্দান্ত সময়ের পরামর্শটা দেওয়ার জন্য মনে মনে পার্থকে ধন্যবাদ না দিয়ে পারলাম না।

কাঁকড়াঝোর
যারা কাঁকড়াঝোর ফরেস্ট দেখতে যাবে, তাদের কথা মাথায় রেখে ফরেস্টের কোনও ছবি ইচ্ছাকৃতভাবেই দিলাম না। এই সৌন্দর্যটা প্রথমবার দেখার আনন্দটা আমি আগে থেকে ছবি দেখিয়ে নষ্ট করে দিতে চাই না। তবে লেখার সঙ্গে ছবি থাকলে লেখাটা পড়তে বেশি ভালো লাগে, তাই কাঁকড়াঝোর ফরেস্টের শেষের দিকের রাস্তার একটা ছবি দিলাম। সূর্যাস্ত কিছুক্ষণ আগে হয়েছে, সামনের গাছগুলোর সিল্যুয়েট দেখা যাচ্ছে - সবমিলিয়ে একটা অপার্থিব সৌন্দর্য।

আমাদের দ্বিতীয় দিনের সাইট সিয়িং শেষ। আমরা কাঁকড়াঝোর থেকে একটা রাস্তা ধরলাম যেটা ধরে ২১ কিলোমিটার গিয়ে আবার রাজ্য সড়কে পৌঁছলাম। এখান থেকে ঝাড়গ্রাম আরও ৩৮ কিলোমিটার। আমরা আরও কিছুটা এগিয়ে একটা দোকান থেকে চা, সিঙ্গাড়া, তেলেভাজা, মিষ্টি ইত্যাদি খেয়ে নিলাম। হোটেলে ফিরে আর কিছু করার থাকে না। রাতের ডিনার আগেরদিনের মতো ঘরে আনিয়েই খাওয়া হল। মেনুও প্রায় আগেরদিনেরই। খরচ হল ৫৩৩/- টাকা।

পরেরদিন অর্থাৎ ৩০শে ডিসেম্বর ২০২২ শুক্রবার সকালে হোটেল থেকে চেক্‌আউট করে আমরা রওনা দিলাম জামশেদপুরের উদ্দেশ্যে। আমাদের ঝাড়গ্রামে দুটো জায়গা দেখা বাকি আছে সেগুলো আমরা যাওয়ার পথে দেখে নেব। ব্রেকফাস্ট করলাম আগেরদিনের দোকানটা থেকেই। তারপর রওনা দিলাম আমাদের দিনের প্রথম গন্তব্য - কনকদুর্গার মন্দিরের উদ্দেশ্যে।

কনকদুর্গা মন্দির যাওয়ার পথে
কনকদুর্গা মন্দির - ঝাড়গ্রাম শহর থেকে চিল্কিগড় জামবনি রোড ধরে ১৬ কিলোমিটার গেলে চিল্কিগড়ে একটা ছোট্ট জঙ্গলের মধ্যে কনকদুর্গার মন্দির। অবশ্য জঙ্গল বলতে যেটা মনে হয়, এটা ঠিক সেরকম নয়। জঙ্গলের মধ্যে গাছপালা কেটে একটা জায়গা পরিষ্কার করা হয়েছে আর সেখানে গাড়ি পার্কিং-এর ব্যবস্থা করা হয়েছে। আর তার থেকে যা হয়, এখানে রীতিমতো দোকান বসে গেছে। বেশিরভাগই খাবারদাবারের দোকান। পার্কিং-এর জায়গা থেকে জঙ্গলের মধ্যের বাঁধানো রাস্তা দিয়ে ৫০০ মিটার হেঁটে গিয়ে মন্দির।

কনকদুর্গা মন্দির
মন্দিরটা বেশ সুন্দর - সামনে বাঁধানো নাটমন্দির। মন্দিরের দুর্গার মূর্তিটা সোনার, সেই থেকেই নাম কনকদুর্গা। মন্দিরের চত্বরটা বেশ বড়। একপাশে কিছু দোকান। দোকানগুলো সব একই ধরনের আর প্রত্যেকটাতেই একইরকম পুজোর সামগ্রী পাওয়া যায়। মন্দিরের চত্বরের সবথেকে বেশি যেটা চোখে পড়ে সেটা হল বাঁদর। এখানে বাঁদরদের যে বিশেষ উৎপাত আছে তা মনে হয় না, এরা নিজেদের মতোই থাকে। বেশ কয়েকটা বাঁদরের বাচ্চাও দেখতে পেলাম। বাচ্চাদের সঙ্গে তাদের মা-বাবাদেরও দেখা গেল। মানুষ ছাড়া বাঁদরই হচ্ছে একমাত্র প্রাণী যাদের বাবারাও বাচ্চাদের সঙ্গে থাকে। যাই হোক, মন্দিরে বেশ ভীড় (মানুষের) ছিল বলে সেই ভীড় ঠেকে ঠাকুরের কাছে পর্যন্ত আর গেলাম না।

ডুলুং নদী
মন্দিরের পাশ দিয়ে একটা রাস্তা নেমে গেছে যেটা দিয়ে মিনিটখানেক গেলে ডুলুং নদী দেখতে পাওয়া যায়। নদীটা বেশ সুন্দর - গ্রামের নদী বলতে যে দৃশ্যটা আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে, ঠিক সেরকমই। নদীর দু'ধার উঁচু এবং পাড়টা ঢালু। দু'দিকেই হাল্কা জঙ্গলের মতো গাছপালা। নদীটা বেশ সরু তবে একেবারে পায়ের পাতাডোবা জল নয়। নদীর মাঝে জায়গায় জায়গায় পাথর রয়েছে যেগুলোর সাহায্যে কিছুটা কসরৎ করে নদী পারাপার করা যায়। আমরা অবশ্য সেই চেষ্টা করিনি। নদীর পাড়ে বসে থাকতে বেশ ভালো লাগছিল, তাই কিছুক্ষণ বসে আবার মন্দিরের কাছে ফিরে এলাম।

চিল্কিগড় রাজবাড়ি - কনকদুর্গা মন্দির থেকে বেরিয়ে গাড়ি নিয়ে ১.৫ কিলোমিটার দূরে চিল্কিগড় রাজবাড়ি। রাজবাড়ির মাঠটা একটা পাঁচিল দিয়ে ঘেরা আর তার মাঝখানে একটা বড় ফটক। এই ফটক দিয়ে ঢুকে ভিতরের মাঠে গাড়ি পার্কিং করা যায় আর পার্কিং-এর জন্য কোনও টাকা লাগে না।

চিল্কিগড় রাজবাড়ি (পাঁচিলের পিছনে)
ফটক দিয়ে ঢুকে যে দোতলা জমিদার বাড়ির মতো বাড়িটা চোখে পড়ে, সেটা কিন্তু আসলে রাজবাড়ি নয় (সেটার সামনে লেখা আছে জামবনি আই সি ডি এস প্রজেক্ট), যদিও ইন্টারনেটে সবাই এটাকেই রাজবাড়ি বলে উল্লেখ করে। এই বাড়িটার পাশে একটা লোহার গেট আছে আর আসল রাজবাড়িটা সেই গেটের পিছনদিকে। রাজবাড়ির দোতলাটা মাঠ থেকে দেখা যায় কিন্তু রাজবাড়িতে ঢোকা যায় না। আসলে এখানে এখন রাজাদের বর্তমান প্রজন্মের লোকেরা থাকে তাই স্বাভাবিকভাবেই তারা এখানে কাউকে ঢুকতে দেয় না। নিজের বাড়ি বাইরের লোকের পর্যটনস্থল হয়ে উঠলে সেই অভিজ্ঞতা যেকোনও মানুষের পক্ষেই বিরক্তিকর। মাঠের একপাশে একটা মন্দির আছে, যেটার রঙ দেখে বোঝা যায় যে সেটা অল্পকিছুদিন আগেই সংস্কার করা হয়েছে। এছাড়া মাঠের একপাশে একটা গেট দিয়ে ঢুকে একটা রাধাকৃষ্ণর মন্দির দেখা যায়। আমরা এই সবকিছু দেখে নিয়ে আবার রওনা দিলাম।

আমাদের ঝাড়গ্রাম ভ্রমণ শেষ - এবার আমরা রওনা দিলাম জামশেদপুরের উদ্দেশ্যে। যাত্রাপথ চিল্কিগড় রোড - ৯ নং রাজ্য সড়ক - বেন্ড রোড (এই বেন্ড রোড ধরে যাওয়ার সময়েই পশ্চিমবঙ্গ ছেড়ে ঝাড়খন্ডে ঢুকে যেতে হয়) - ধলভুমগড় রোড - ১৮ নং জাতীয় সড়ক - জামশেদপুর। চিল্কিগড় থেকে জামশেদপুরের দূরত্ব ১০০ কিলোমিটারের মতো। আমরা অবশ্য সরাসরি জামশেদপুর যাব না, যাওয়ার পথে পড়বে ঘাটশিলা আর আমরা যাওয়ার সময়ে এখানকার কয়েকটা দেখার জায়গা দেখে তারপরে জামশেদপুর যাব।

১৮ নং জাতীয় সড়কে উঠে কিছুটা চলার পরে রাস্তার ধারের একটা ধাবা থেকে আমরা লাঞ্চ করে নিলাম। এখানকার রান্না বেশ ভালো আর দাম অনুযায়ী পরিমাণও বেশ ভালো। ভাত রুটি ডাল চিকেন এগকারী ইত্যাদি নেওয়া হল। অমৃতা আবার একটা বিখ্যাত পাঞ্জাবী আইটেম খেল - মকাই-দি-রোটি আর সেইসঙ্গে সরষোঁ-দা-সাগ। ওর বেশ ভাল লেগেছে কিন্তু আমি ওর থেকে নিয়ে একটু চেখে দেখলাম ও জিনিস আমার পোষাবে না। পাঞ্জাবী ডিশের মধ্যে রুটি-তড়কা জিনিসটা আমার মন্দ লাগে না তবে চিকেন তন্দুরির নিচে বিশেষ কিছু আমি ভাবতে চাই না।

বুরুডি লেক
বুরুডি লেক - বিকেল সাড়ে তিনটে নাগাদ আমরা ঘাটশিলায় পৌঁছে জাতীয় সড়ক ছেড়ে ডানদিকে বুরুডি রোড ধরলাম। রাস্তাটা জাতীয় সড়কের মতো মসৃণ নয় আর সেইসঙ্গে বেশ সরু এবং আঁকাবাঁকা। ফলে গাড়ি কখনওই জোরে চালানো যায়না। এই রাস্তা ধরে ৭ কিলোমিটার মতো গেলে বুরুডি লেক। পার্কিং-এ গাড়ি দাঁড় করিয়ে আমরা গেলাম লেকের পাশে।

লেকটা বিশাল বড়। এটা দশটা ছোট ছোট পাহাড় দিয়ে ঘেরা (সেই থেকেই লেকের নামকরণ - স্থানীয় ভাষায় বুরুডি শব্দের অর্থ পাহাড়ে ঘেরা জলাশয়। এই তথ্যটা সিরিয়াসলি নেওয়ার দরকার নেই, এটা আমার নিজস্ব সংযোজন !)। এখানেও পিকনিক হচ্ছে - লোকজন গিজগিজ করছে। সেইসঙ্গে চলছে তারস্বরে মাইক। লেকের পাড়ে যথারীতি প্রচুর দোকানপাট আর এই সবকিছু এখানকার প্রাকৃতিক পরিবেশকে ধ্বংস করে ফেলেছে। কিছু করার নেই, তাই আমরা লেকের জলের একেবারে পাশে চলে গিয়ে এখানকার সৌন্দর্য যতদূর সম্ভব উপভোগ করার চেষ্টা করলাম।

বিকেল সাড়ে চারটে বাজে, সূর্য পশ্চিমদিকে ঢলে পড়েছে। পাহাড়ের উপরে সূর্যাস্ত একটু আগেই হবে আর অন্ধকার হয়ে যাবে, তাই আমরা রওনা দিলাম আমাদের পরবর্তী গন্তব্যের দিকে।

যে রাস্তা দিয়ে বুরুডি লেকে এসেছিলাম সেই রাস্তা দিয়ে পাহাড়ী পথে আরও এগোতে লাগলাম। আমাদের গন্তব্য ধারাগিরি ফল্‌স্‌ যেটা বুরুডি লেক থেকে আরও ৬ কিলোমিটার দূরে। এই রাস্তাটা যাকে বলে আন্ডার কনস্ট্রাকশন আর সেই কারণে অত্যন্ত এবড়োখেবড়ো। পাহাড়ী পথে গাছপালার মধ্যে দিয়ে রাস্তা, ত্রিসীমানার মধ্যে কাউকে দেখা যাচ্ছে না, ভরসা একমাত্র গুগ্‌ল্‌ম্যাপ। এখানে আবার মোবাইলের নেটওয়ার্কেরও বেশ সমস্যা। যাই হোক, কিছুটা ম্যাপ আর কিছুটা নিজের বিচারবুদ্ধির সাহায্যে ফলসের কাছে যখন পৌঁছলাম তখন সূর্যকে আর দেখা যাচ্ছে না। যেখানে পৌঁছলাম সেখানে আরও দুটো গাড়ি দাঁড়িয়েছিল, তাদের মধ্যে একটা গাড়ির লোকজন সবেমাত্র ফল্‌স্‌টা দেখে এসেছে। তাঁরা বললেন এখান থেকে ফল্‌স্‌টা হেঁটে আরও মিনিট পনেরো আর এটা দেখতে যাওয়ার কোনও মানেই হয় না। ফল্‌সে জল একেবারেই নেই, একটা সরু নালার মতো জলের ধারা। ওনাদের কথা শুনে আমরা দেখতে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম এবং ফেরার পথ ধরলাম। ফেরার সময়ে বুরুডি রোড একেবারেই অন্ধকার ফলে গাড়ির গতি আগের চেয়েও কমাতে হল। শেষপর্যন্ত আমরা ১৮ নং জাতীয় সড়কে যখন পৌঁছলাম তখন সন্ধ্যে ছটা।

আমাদের আর কিছু দেখার নেই, এবার সোজা জামশেদপুর। মাঝে রাস্তার ধারের একটা দোকান থেকে চা-পকোড়া ইত্যাদি খেয়ে নেওয়া হল। শেষপর্যন্ত জামশেদপুরের সাক্চি‌ মার্কেটে আমাদের হোটেল হলিডে ইন্‌-এ যখন পৌঁছলাম তখন সন্ধ্যে সাড়ে সাতটা।

হলিডে ইন্‌-এর ঘর
হলিডে ইন্‌ হোটেলটা সাক্চি‌ মার্কেটের একেবারে ভিতরে। হোটেলে গাড়ি পার্কিং-এর আলাদা কোনও ব্যবস্থা নেই, রাস্তার উপরেই রাখতে হয়। হোটেলের ঘরগুলো বেশ ছোট, হাঁটাচলার জায়গা খুব কম। জামশেদপুর এমনিতে খুব সুন্দর জায়গা হলেও এটা প্রধানতঃ ব্যবসাবাণিজ্য বা লোকজনের কর্মক্ষেত্রের জায়গা, তাই ট্যুরিস্ট এখানে খুব বেশি আসে না। আমি এর আগে ২০০৯ সালে একবার এখানে এসেছিলাম, তখন আমার জামাইবাবু কর্মসূত্রে সপরিবারে এখানে থাকতেন। এখানে কয়েকটা দেখার জায়গা আছে আর সেগুলো আমার খুব ভালো লেগেছিল। আমাদের আটজনের মধ্যে একমাত্র অমৃতা আর কথা-কলি কখনও জামশেদপুরে আসেনি, তাই মূলতঃ ওদের জন্যই এখানে আসার পরিকল্পনা করা হয়েছিল। হলিডে ইন্‌-এর খাবারের দাম বেশ বেশি। আমরা ভাত ডাল রুটি চিকেন নিয়ে ডিনার করলাম।

হয় হলিডে ইন্‌-এর খাবারে কোনও সমস্যা ছিল অথবা এখানে আসার পথে যে দোকান থেকে চা-পকোড়া খাওয়া হয়েছিল, তার খাবারে সমস্যা ছিল। মোটকথা জামশেদপুরে প্রথমরাত থেকেই আমাদের সবারই কমবেশি পেটের সমস্যা দেখা দিল। এই কারণে পরেরদিন শনিবার ৩১শে ডিসেম্বর সকালে কেউই ঘুম থেকে উঠে বেরোতে পারলাম না।

আমরা বেরোলাম দুপুর বারোটা নাগাদ। সকালে ব্রেকফাস্টও করা হয়নি, তাই প্রথমে গেলাম একটা কাছাকাছি ফুড স্টলে - নাম ভোলা মহারাজ। এখান থেকে ধোসা, ইডলি, ছোলে বাটুরে ইত্যাদি দিয়ে ব্রেকফাস্ট কাম লাঞ্চ করে নেওয়া হল। সবমিলিয়ে খরচ হল ৮৩০/- টাকা।

জামশেদপুরে দেখার জায়গা মূলতঃ চারটে - ডিমনা লেক, দো-মোহানি, জুবিলি পার্ক সেইসঙ্গে জুলজিক্যাল পার্ক আর ভুবনেশ্বরী মন্দির। এছাড়া আরও কয়েকটা ছোটখাটো দেখার জায়গা আছে। শরীর ঘোরাঘুরির জন্য যথেষ্ট ফিট না থাকায় আমরা শুধু ডিমনা লেকটাই যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম।

ডিমনা লেক
ডিমনা লেক - জামশেদপুর থেকে ১৮ নং জাতীয় সড়ক পেরিয়ে ৮ কিলোমিটার গেলে দেখা যায় ডিমনা লেক। লেকটা সুবিশাল - একপাশে একটা ড্যাম আছে, নাম ডিমনা ড্যাম। এই ড্যামের জায়গাটা থেকেই পুরো লেকটা বেশ ভালোভাবে দেখা যায়। আমরা এখানে গিয়ে দেখলাম - এখানেও পিকনিকের দল চলে এসেছে। তাছাড়া আরও কিছু অস্থায়ী দোকানও গজিয়ে উঠেছে। আমরা ড্যামের নিচের দিকের রাস্তাটা দিয়ে গিয়েছিলাম বলে সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠে লেকটা দেখতে হল। মিনিট দশেক এখানে কাটিয়ে আমরা আবার হোটেলে ফিরে এলাম।

সারা সন্ধ্যে হোটেলের ঘরে বসে গল্পটল্প করে কাটিয়ে দেওয়া হল। রাতে আর হোটেলের খাবার না খেয়ে কাছাকাছি একটা ভাতের হোটেলে গিয়ে ভাত রুটি তরকা দিয়ে ডিনার করে নিলাম।

রবিবার ১লা জানুয়ারী ২০২৩ - আমার ব্লগের সমস্ত পাঠকদের জানাই হ্যাপি নিউ ইয়ার ! আজ আমাদের বাড়ি ফেরার দিন। সকাল নটা নাগাদ হোটেল থেকে চেক্‌আউট করে বেরিয়ে পড়লাম। এখান থেকে কলকাতার দূরত্ব ২৯০ কিলোমিটার - টানা গেলে সাড়ে পাঁচ ঘন্টার মতো লাগার কথা। জামশেদপুর থেকে রওনা হওয়ার আগে আমরা দো-মোহানিটা দেখে নিলাম।

দো-মোহানি
দো-মোহানি - সাক্‌চি মার্কেটে আমাদের হোটেল থেকে দো-মোহানির দূরত্ব ৭ কিলোমিটারের মতো, যেতে মিনিট কুড়ি লাগল। দো-মোহানিতে খড়কাই নদী সুবর্ণরেখা নদীর সঙ্গে মিশেছে। এই জায়গার বৈশিষ্ট্য হল এখানে দুটো নদীর জলের রঙ সম্পূর্ণ আলাদা - একটা গাঢ় সবুজ আর অন্যটা কালচে। যেখানে এই দুটো নদী একসঙ্গে মিলিত হয়, সেখানেও এই জলের রঙের তফাৎটা খুব স্পষ্টভাবে বোঝা যায়। এখানে নদীর পাড়ে গাড়ি দাঁড় করিয়ে নিচে নেমে জলের একেবারে কাছে যাওয়া যায়। এত সকালে এখানে সেরকম ভিড় হয়নি কিন্তু ছুটির দিনে দুপুর বা বিকেলের দিকে এখানে ভালোই লোকসমাগম হয়। আমরা কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে তারপর রওনা দিলাম।

দো-মোহানি থেকে ১১৮ নং জাতীয় সড়ক দিয়ে কিছুটা এসে ১৮ নং জাতীয় সড়কে উঠতে হয়। আমরা এখানে রাস্তার ধারের একটা স্টল থেকে ব্রেকফাস্ট করে নিলাম। ইডলি ধোসা বঢ়া নিয়ে খরচ হল ১৮০/- টাকা।

১৮ নং জাতীয় সড়কে ওঠার পরে ফিরতি পথে আরও ৩০ কিলোমিটার এসে একটা জায়গা থেকে আমরা ডানদিকে ঢুকে গেলাম। এই রাস্তা দিয়ে আরও ১.৫ কিলোমিটার গেলে আমাদের শেষ দ্রষ্টব্য - গালুডি ব্যারেজ ও ড্যাম।

গালুডি ব্যারেজ
গালুডি ব্যারেজ ও ড্যাম - গালুডি ড্যামটা আসলে ঘাটশিলার সাইট সিয়িং-এর মধ্যে পড়ে। এটা দেখার পরিকল্পনা আমাদের জামশেদপুর আসার দিনই ছিল, কিন্তু সময়াভাবে সম্ভব হয়নি। এখানে সুবর্ণরেখা নদীর উপরে একটা ব্যারেজ আছে আর ব্যারেজের উপরে ব্রীজ। এই ব্রীজের উপর দিয়ে গাড়ি চলাচল করে। আমরা ব্রীজটা পেরিয়ে ওপারে গিয়ে নদীর পাড়ে দাঁড়ালাম। তারপর হেঁটে গিয়ে ব্যারেজটা ভালোভাবে দেখলাম। জায়গাটা কিছুটা কুয়াশা মতো হয়ে রয়েছে আর এই কুয়াশা শীতকালে দিনের কোনও সময়েই কমবে না। যাই হোক, আমরা এখানে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে আবার ফেরার পথ ধরলাম।

আর কোথাও দাঁড়ানোর নেই। আমাদের ফেরার পথ ১৮ নং জাতীয় সড়ক - ৪৯ নং জাতীয় সড়ক - ১৬ নং জাতীয় সড়ক - কোনা এক্সপ্রেসওয়ে - বিদ্যাসাগর সেতু পেরিয়ে কলকাতা। মাঝখানে খড়্গপুরের কাছে জকপুরের মনসামন্দিরে আমরা একটু দাঁড়িয়েছিলাম আর ওখানেই লাঞ্চ করেছি। সেটার বিস্তারিত বিবরণ আর এই ভ্রমণ অভিজ্ঞতায় সংযোজন করছি না। মোটকথা সন্ধ্যে সাতটা নাগাদ আমরা বাড়ি পৌঁছে গেলাম।

সারসংক্ষেপ ঃ

১. কলকাতা থেকে ১৮০ কিলোমিটার দূরে নবনির্মিত ঝাড়গ্রাম জেলার সদর ঝাড়গ্রাম। দুতিনদিন ঘোরার পক্ষে ঝাড়গ্রাম খুবই উপযোগী।

২. ঝাড়গ্রাম ট্রেনে যেতে হলে হাওড়া থেকে টাটানগরগামী ট্রেনে যাওয়া যায়। ট্রেনে যেতে ঘন্টাদুয়েক লাগে।

৩. কলকাতা থেকে ঝাড়গ্রামের বাস পাওয়া যায় অথবা সড়কপথে গাড়ি নিয়েও যাওয়া যায়। রাস্তা খুবই সুন্দর, কলকাতা থেকে ঝাড়গ্রাম ঘন্টাচারেকের মতো লাগে।

৪. ঝাড়গ্রাম পর্যটনের জন্য মোটামুটি বিখ্যাত, তাই এখানে অনেক হোটেল আছে। আমাদের হোটেল সোমানি ইন্‌-তাদের মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য। ঘরগুলো খুবই সুন্দর এবং এদের খাবারের মান বেশ ভালো। MakeMyTrip বা অন্যান্য বুকিং সাইট থেকে এদের বুকিং করা যায়। এদের যোগাযোগের নম্বরঃ 9733614354.

৫. ঝাড়গ্রামের সাইট সিয়িং-এর মধ্যে ঝাড়গ্রাম রাজবাড়ি, সাবিত্রী মন্দির আর ঝাড়গ্রাম মিনি জু আছে। এগুলো একেবারে শহরের মধ্যেই, তাই গাড়িভাড়া না করে টোটো ভাড়া করেও দেখা যেতে পারে।

৬. ঝাড়গ্রাম থেকে ৫০ কিলোমিটারের মতো দূরে বেলপাহাড়ী। এখানে বেশ কয়েকটা ভালো দেখার জায়গা আছে যার মধ্যে গদ্রসিনি পাহাড় ও খাঁদারাণী লেক অবশ্য দ্রষ্টব্য।

৭. বেলপাহাড়ী মোটামুটিভাবে একটা সারাদিনের ঘোরার জায়গা, তাই সঙ্গে কিছু খাবারদাবার রাখা ভালো। এখানকার সাইটসিয়িং-এর জায়গাগুলোর কোনওটার কাছেই সেরকম কোনও খাবারের দোকান নেই, তাই দুপুরের খাবার বেলপাহাড়ী শহর থেকেই খেয়ে নেওয়ার চেষ্টা করতে হবে।

৮. কাঁকড়াঝোর ফরেস্টে আলাদা করে কিছু দেখার নেই, তবে জঙ্গলের ভিতর দিয়ে রাস্তাটাই খুব সুন্দর। এখানে বিকেলের পড়ন্ত আলোয় যেতে পারলে জঙ্গলের সৌন্দর্য কিছুটা বেশি করে উপলব্ধি করা যাবে। আমার মতে এটাও অবশ্য দ্রষ্টব্য।

৯. ঝাড়গ্রাম থেকে ১৬ কিলোমিটার দূরে কনকদুর্গা মন্দির ও চিল্কিগড় রাজবাড়ি। কনকদুর্গা মন্দিরের লাগোয়া ডুলুং নদীটাও বিশেষ দ্রষ্টব্য।

১০. ঝাড়গ্রাম যাওয়ার পক্ষে সবচেয়ে ভালো সময় হল অক্টোবর থেকে মার্চ। গরমকালে এখানে গরম খুব বেশি আর বর্ষাকাল এইসব জায়গা ঘোরার পক্ষে একেবারেই উপযোগী নয়।

১১. কলকাতা থেকে প্রায় ৩০০ কিলোমিটার দূরে ঝাড়খন্ড রাজ্যের বাণিজ্যিক প্রধান শহর জামশেদপুর। ঝাড়গ্রামের মতো জামশেদপুরও দু'দিন থাকার পক্ষে বেশ ভালো।

১২. হাওড়া থেকে ট্রেনে জামশেদপুর (স্টেশনের নাম টাটানগর) যেতে লাগে সাড়ে তিন ঘন্টা মতো। সড়কপথে যেতে লাগে ঘন্টা পাঁচেক।

১৩. জামশেদপুর প্রধানতঃ শিল্প শহর বলে এখানে পর্যটনের ব্যাপারটা সেরকম জনপ্রিয় নয়। এখানকার বেশিরভাগ হোটেলই সাক্‌চি-তে - যেটা এখানকার প্রধান মার্কেট। তবে ঘুরতে গেলে সাক্‌চিতে হোটেল না নেওয়াই শ্রেয়।

১৪. আমাদের হোটেল হলিডে ইন মোটের উপর খারাপ নয়, যদিও এদের খাবারের দাম বেশ বেশি। MakeMyTrip থেকে এদের বুকিং করা যেতে পারে। হোটেলের যোগাযোগের নম্বর - 6200075778, 7070093188, 9334340004.

১৫. জামশেদপুরের সাইট সিয়িং-এর মধ্যে প্রধান হল ডিমনা লেক, দো-মোহানি, জুবিলি পার্ক ও জুলজিক্যাল পার্ক আর ভুবনেশ্বরী মন্দির এবং এই সবকটা জায়গাই অবশ্য দ্রষ্টব্য। এগুলোর কোনওটাই শহর থেকে দূরে নয়, তাই একটা আধবেলা হাতে থাকলেও এগুলো সব দেখা হয়ে যাবে।

১৬. জামশেদপুর ঘুরতে যাওয়ার জন্য অক্টোবর থেকে মার্চই সবথেকে ভালো। ৩রা মার্চ জামশেদজী টাটার জন্মদিন, ওইসময়ে এখানে বিরাট উৎসব হয় - সারা শহর সাজানো হয়। এইসময়ে এখানে গেলে খুবই ভালো লাগবে।

উপসংহার ঃ

ঝাড়গ্রামের প্রকৃতি
ঝাড়গ্রামে মাওবাদীদের সমস্যা নেই। এটা উল্লেখ করতে হল কারণ পশ্চিম মেদিনীপুরের বেশ কিছু জায়গা সম্পর্কে অনেকের মনেই এখনও এই সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে কিছুটা ভীতি কাজ করে। ঝাড়গ্রাম ঘুরতে যাওয়ার জন্য বেশ ভালো এবং নির্ভয়ে নিশ্চিন্তে এখানে ঘোরাঘুরি করা যেতে পারে। ঝাড়গ্রাম একটা আদ্যন্ত শহর হলেও তার সীমানা ছাড়িয়ে বেলপাহাড়ীর দিকে গেলে চোখে পড়বে প্রকৃতির আসল সৌন্দর্য। আর তার মাঝে মাঝে ছোট্ট ছোট্ট গ্রামে বসবাসকারী সহজসরল মানুষগুলোকে। এঁরা যেন প্রকৃতিরই সন্তান। এঁদের জীবনে অভাব আছে, দারিদ্র্য আছে কিন্তু উচ্চাভিলাষ নেই আর তাই জীবনযাত্রাও অত্যন্ত অনাড়ম্বর, শান্তিপূর্ণ ও শিথিল।  আবার এরই সম্পূর্ণ বিপরীত ছবি দেখা যায় জামশেদপুরে। টাটা গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা জামশেদজী টাটার নামাঙ্কিত এই শহরে সর্বদাই চোখে পড়ে কর্মব্যস্ততা। এখানকার মানুষের জীবনযাত্রা গতিপূর্ণ কিন্তু শৃঙ্খলাবদ্ধ। টাটা গ্রুপ এই শহরের একটা বড় অংশের রক্ষণাবেক্ষণ করে আর সেই অংশের পরিচ্ছন্নতা আর নিয়মানুবর্তিতা চোখে পড়ার মতো। টাটাদের সম্পর্কে আমি চিরকালই শ্রদ্ধাশীল আর শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে যাওয়া ব্যাপারটা জামশেদপুরে গেলে ভীষণভাবে অনুভব করা যায় !

ঝাড়গ্রাম ও জামশেদপুর ভ্রমণের আরও ছবি দেখতে হলে click here.

Monday, October 17, 2022

বালি (ইন্দোনেশিয়া) ভ্রমণ

বিশেষ সতর্কীকরণঃ

১. এই পুরো ভ্রমণে আমরা কোনও অবস্থাতেই কোনও পলিথিন বা প্লাস্টিক ব্যবহার করিনি। অর্থাৎ প্লাস্টিকের ব্যবহার না করেও এই ভ্রমণ অনায়াসে করা যায়।

২. এই পুরো ভ্রমণে আমরা কোনও কাগজ ব্যবহার বা নষ্ট করিনি। প্লেনের বুকিং-এর প্রিন্ট আউটের দরকার হয় না, হোটেল বুকিং-এর রশিদ-এরও প্রিন্ট আউট ব্যবহারের কোনও প্রয়োজন হয় না।

৩. এই পুরো ভ্রমণে আমাদের দলের কেউ ধূমপান করেনি। ধূমপান স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর।

আমার ব্লগের সমস্ত পাঠকদের বিশেষভাবে অনুরোধ করছি প্লাস্টিক, অপ্রয়োজনীয় কাগজের ব্যবহার আর ধূমপান বর্জন করার জন্য।

ভ্রমণপথঃ

মঙ্গলবার ১১ই অক্টোবর, ২০২২ঃ রাত ১২ঃ৩০ মিনিটে কলকাতা থেকে প্লেন - ভোর ৪ঃ৩০ মিনিটে (ভারতীয় সময় রাত ৩টে) ব্যাঙ্কক। ব্যাঙ্কক থেকে সকাল ৬ঃ৪৫ মিনিটে (ভারতীয় সময় সকাল ৫ঃ১৫ মিনিট) প্লেন - দুপুর ১২টায় (ভারতীয় সময় সকাল ৯ঃ৩০ মিনিট) বালি - বালিতে রাত্রিবাস।

বুধবার ১২ই অক্টোবর, ২০২২ঃ বালির লোক্যাল সাইট সিয়িং - বালিতে রাত্রিবাস।

বৃহস্পতিবার ১৩ই অক্টোবর, ২০২২ঃ বালির লোক্যাল সাইট সিয়িং - বালিতে রাত্রিবাস।

শুক্রবার ১৪ই অক্টোবর, ২০২২ঃ বালির লোক্যাল সাইট সিয়িং - বালিতে রাত্রিবাস।

শনিবার ১৫ই অক্টোবর, ২০২২ঃ বালিতে মার্কেটিং - বালিতে রাত্রিবাস।

রবিবার ১৬ই অক্টোবর, ২০২২ঃ সকাল ৭ঃ০৫ মিনিটে (ভারতীয় সময় ভোর ৪ঃ৩৫ মিনিট) বালি থেকে প্লেন - সকাল ১০টায় (ভারতীয় সময় সকাল ৭ঃ৩০ মিনিট) কুয়ালালামপুর। কুয়ালালামপুর থেকে রাত ১০ঃ৩৫ মিনিটে (ভারতীয় সময় রাত ৮ঃ০৫ মিনিট) প্লেন - রাত ১২ঃ১০ মিনিটে (সোমবার ১৭ই অক্টোবর, ২০২২) কলকাতা।

বালি। ভারতের দক্ষিণ-পুর্ব দিকে এশিয়া মহাদেশের একটি দেশ ইন্দোনেশিয়ার অন্তর্গত ছোট্ট একটা দ্বীপ। ভৌগোলিক অবস্থানগতভাবে বালি পৃথিবীর দক্ষিণ গোলার্ধে। নিরক্ষরেখার (বিষুবরেখা) খুব কাছাকাছি হওয়ায় এখানে সারাবছরই প্রায় একইরকম আবহাওয়া থাকে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর ভৌগোলিক সুবিধার কারণে এখানে বিদেশী পর্যটকদের ভীড় চোখে পড়ার মতো - আর এই কারণেই বালি প্রধানতঃ একটি পর্যটননির্ভর জায়গা। এই পর্যটননির্ভর জায়গায় আমাদের পাঁচদিনের পর্যটনের উপর নির্ভর করেই আমার ব্লগের এবারের পোস্ট।

বালি ভ্রমণ আমার ব্লগের প্রথম আন্তর্জাতিক ভ্রমণের পোস্ট। আন্তর্জাতিক ভ্রমণের ক্ষেত্রে কতগুলো বিষয়ে আলাদা করে ব্যবস্থা নিতে হয়, তাই ভ্রমণবৃত্তান্ত শুরু করার আগে সেগুলোর সম্পর্কে কিছু তথ্য দিয়ে রাখি।

পাসপোর্ট - যেকোনও ভারতীয় পাসপোর্টধারী ব্যক্তিই ইন্দোনেশিয়ায় যেতে পারেন, কিন্তু খেয়াল রাখতে হবে পাসপোর্টের ভ্যালিডিটি যেন ফেরৎ আসার দিনের পরে আরও অন্ততঃ ছ'মাস থাকে (কথা-কলির পাসপোর্ট ২০২৩ এর মার্চে এক্সপায়ার করে যাচ্ছিল, তাই ওদের নতুন পাসপোর্ট করাতে হয়েছিল)।

ভিসা - ইন্দোনেশিয়ায় পর্যটনের কারণে গেলেও ভারতীয়দের ভিসা লাগে। এই ভিসা অন্‌লাইনেও পাওয়া যায় আবার চাইলে বালিতে পৌঁছে এয়ারপোর্ট থেকেও ভিসা করানো যায় (যাকে বলে ভিসা অন্‌ অ্যারাইভ্যাল)। ভিসার খরচ ৫০০,০০০ ইন্দোনেশিয়ান রুপিয়া এবং এর ভ্যালিডিটি ৩০ দিন (সিঙ্গল্‌ এন্ট্রি)। এই বিষয়ে আরও বিস্তারিতভাবে এদের ওয়েবসাইট https://visa-online.imigrasi.go.id/ থেকে জানা যেতে পারে।

কারেন্সি - ইন্দোনেশিয়ার কারেন্সি হল ইন্দোনেশিয়ান রুপিয়া এবং বর্তমানে ১ ইন্দোনেশিয়ান রুপিয়া = ০.০০৬ ভারতীয় টাকা। অর্থাৎ ১,০০০ ইন্দোনেশিয়ান রুপিয়া = ৬ ভারতীয় টাকা। এটা আপাতদৃষ্টিতে খুব কম মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে ইন্দোনেশিয়ায় ১,০০০ রুপিয়ার কোনও মূল্য নেই। তাই তাড়াতাড়ি হিসেব করার সময়ে শেষের তিনটে শূন্যকে উপেক্ষা করে মনে মনে ৬ দিয়ে গুণ করলেই চলবে। যেমন - যদি কোথাও গাড়িভাড়া বলে ১০০,০০০ রুপিয়া, তার মানে ... ৬০০ টাকা চাইছে !

কারুর সঙ্গে যদি ১০০ মিলিয়ান ইন্দোনেশিয়ান রুপিয়া বা তার বেশি ক্যাশ থাকে তাহলে সেটা তাকে কাস্টমস্-এ অবশ্যই ডিক্লেয়ার করতে হবে।

কারুর কাছে যদি ভিসা বা মাস্টারকার্ড (ক্রেডিট বা ডেবিট কার্ড) থাকে, তাহলে সেগুলো সঙ্গে রাখাই বুদ্ধিমানের কাজ। বালিতে প্রায় সবজায়গায় কার্ড নেয় আর কার্ডে পেমেন্ট করাটা ক্যাশ পেমেন্টের থেকে বেশি লাভজনক (কেন, সেটা এখানে বিস্তারিত বলব না)।

মোবাইল ফোন - বালি এয়ারপোর্টে একাধিক স্থানীয় মোবাইল কোম্পানির দোকান আছে, সেখানে সাতদিন/দশদিন/পনেরোদিন ইত্যাদি বিভিন্ন দিনের ভ্যালিডিটিযুক্ত সিমকার্ড কিনতে পাওয়া যায়। এতে কিছু টক্‌টাইম আর মোবাইল ডেটা পাওয়া যায়। এগুলো নিতে না চাইলে নিজের ভারতীয় ফোনে ইন্টারন্যাশনাল রোমিং সক্রিয় করেও যাওয়া যেতে পারে। ইন্দোনেশিয়ার আই এস ডি কোড 0062.

ভাষা - ইন্দোনেশিয়ার ভাষা ইন্দোনীজ। কিন্তু পর্যটননির্ভর হওয়ায় এখানকার লোকেরা কমবেশি সবাই ইংরেজী বোঝে এবং বলতে পারে। এমনকি হোটেল, রেস্ট্যুরেন্ট থেকে শুরু করে দোকানপাট, রাস্তার নাম সবকিছু ইংরেজীতে লেখা থাকে। কথাবার্তা বলতে কোনওই অসুবিধে হয় না। তাই বালি যাওয়ার জন্য ইন্দোনীজ ভাষা শেখার কোনও দরকার নেই এমনকি 'তেরিমা কাসি' (ইন্দোনীজ ভাষায় ধন্যবাদ) শেখারও দরকার নেই (আমরা শিখেছিলাম, কিন্তু কোথাও ব্যবহার করার সুযোগ পাইনি !)।

সময় - ইন্দোনেশিয়ার সময় ভারতের থেকে আড়াই ঘন্টা এগিয়ে অর্থাৎ ভারতে যখন সকাল ছটা তখন ইন্দোনেশিয়ায় সকাল সাড়ে আটটা। আমি আমার লেখায় বিভিন্ন জায়গার স্থানীয় সময়গুলোই ব্যবহার করব।

দমদম বিমানবন্দরে অপেক্ষারত আমরা
যদিও আমাদের ফ্লাইট মঙ্গলবার ১১ই অক্টোবর রাত ১২ঃ৩০ মিনিটে, কিন্তু আন্তর্জাতিক ভ্রমণের ক্ষেত্রে ঘন্টাতিনেক আগে এয়ারপোর্টে পৌঁছতে হয়। সেইমতো আমরা দমদমে নেতাজী সুভাষচন্দ্র বোস আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছলাম তখন সোমবার ১০ই অক্টোবর, ২০২২ - রাত ৯ঃ৪৫ মিনিট। আমরা মানে আমি, অমৃতা, বাবা, মা, কথা, কলি। আমাদের ফ্লাইট ছিল এয়ার এশিয়ার। তাদের কাউন্টার থেকে বোর্ডিং পাস সংগ্রহ করে আমরা গেটের কাছে গিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম। প্লেন ছাড়ল নির্ধারিত সময়ের প্রায় ৪৫ মিনিট পরে। আমাদের যাত্রাপথের একমাত্র লে-ওভার ছিল ব্যাঙ্ককের ডন মুয়াং আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে, সেখান থেকে পরের প্লেনটা নির্ধারিত সময়েই ছাড়ল। এখানে জানিয়ে রাখি এয়ার এশিয়ার এই ফ্লাইটগুলো আন্তর্জাতিক হলেও প্লেনে কিন্তু কোনও খাবার দেয় না। তাই নিজের সঙ্গে খাবার রাখাই ভালো। সেটা না চাইলে প্লেনের ভিতরে খাবার কেনাও যেতে পারে। বেলা ১২টা নাগাদ আমরা পোঁছে গেলাম বালির গুরাহ রাই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে। আমাদের ভিসা ছিল
বালি বিমানবন্দরে

না, তাই ভিসা করে ইমিগ্রেশনের পর্ব মিটিয়ে এয়ারপোর্ট থেকে বেরোতে বেরোতে প্রায় দু"টো বাজল। আমাদের হোটেল কুটা এলাকাতে - এয়ারপোর্ট থেকে ক্যাবে মিনিট পনেরোর রাস্তা। আমরা একটা টয়োটা অ্যাভাঞ্জা নিয়ে হোটেলে পৌঁছলাম। ক্যাব নিল ২০০,০০০/- রুপিয়া।

হোটেল জিয়ায় আমাদের ঘর
আমাদের হোটেলের নাম 'হোটেল জিয়া' (স্থানীয় উচ্চারণে হোটেল শিয়া)। হোটেলটা দুর্দান্ত এবং আমাদের দেশের তুলনায় বেশ সস্তা। হোটেলটা বেশ বড়। আমাদের দু'টো ঘর সিক্সথ ফ্লোরে (যদিও এরা গ্রাউন্ড ফ্লোরকেই ফার্স্ট ফ্লোর বলে আর কোনও একটা বিশেষ কারণে থার্ড ফ্লোরের উপরেরটা ফিফথ্‌ ফ্লোর। তো, সেই হিসেবে আমাদের ঘরটা আসলে পাঁচতলায়)। আমরা হোটেলে চেক্‌ইন করে স্নানটান সেরে লাঞ্চ করতে বেরোলাম।

হোটেল জিয়ায় লাঞ্চের সেভাবে ব্যবস্থা নেই, তাই লাঞ্চের খোঁজে আমরা বাইরে বেরোলাম দুপুর সাড়ে তিনটে নাগাদ। সৌভাগ্যক্রমে হোটেলের বাইরেই একটা খাবার দোকান পাওয়া গেল - সেখানে ভাত আর চিকেনের ঝোল দিয়ে লাঞ্চ সেরে নেওয়া হল। রান্না আমাদের দেশের মতো নয় একেবারেই, তবে খেতে বেশ ভাল। আমাদের ছজনের লাঞ্চের খরচ পড়ল ১৩৪,০০০/- রুপিয়া।

হোটেল জিয়ার ছাদ
লাঞ্চ করে আমরা হোটেলে ফিরে এলাম। আমাদের ফ্লোরের উপরেই ছাদ - সেখানে একটা সুইমিং পুল আছে। ছ'তলার ব্যালকনি থেকেই সমুদ্রের লাইনটা দেখা যায় আর ছাদ থেকে চারপাশের দৃশ্য খুবই সুন্দর। আমাদের হোটেলের খুব কাছাকাছির মধ্যে এত উঁচু কোনও বাড়ি নেই, তাই চারদিকেই বহুদূর পর্যন্ত দেখা যায়। এখানকার প্রায় সব বাড়িগুলোর মাথাটা টালির, তাই ছাদ থেকে দেখে মনে হয় একটা দিগন্তবিস্তৃত চাদর দিয়ে পুরো শহরটা ঢাকা রয়েছে।

বীচে যাওয়ার রাস্তা
ছাদ থেকে নেমে এবার আমরা রওনা দিলাম কুটা বীচের দিকে। আমাদের হোটেল থেকে হেঁটে মিনিট দশেক। বালির রাস্তাঘাট খুবই সুন্দর - সবথেকে বেশি যেটা চোখে পড়ে সেটা হল পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা আর নিয়মানুবর্তিতা। সেইসঙ্গে দোকানপাটও চোখজুড়নো। আমাদের হোটেলটা কুটার যে অঞ্চলে, সেটা মূলতঃ ট্যুরিস্ট এলাকা তাই এখানে প্রচুর হোটেল রেস্ট্যুরেন্ট ডিপার্টমেন্টাল স্টোর আর হরেকরকম জিনিসের দোকানের ভীড়। আর সেইসঙ্গে বিদেশী ট্যুরিস্টদের ভীড়ও চোখে পড়ার মতো। এদের মধ্যে অস্ট্রেলিয়ান, আমেরিকান আর ইউরোপিয়ানই বেশি (বর্ণবিদ্বেষমূলক শোনাতে পারে বলে 'সাদা চামড়া' কথাটা ব্যবহার করলাম না)। 

কুটা বীচ্‌
কুটা বীচটা খুবই সুন্দর। সমুদ্রটা ভারত মহাসাগর। এই আমার প্রথম ভারত মহাসাগর দর্শন ! বিকেল সাড়ে পাঁচটা বাজে, সূর্যাস্ত হবে হবে করছে। প্রথমে মনে হচ্ছিল সমুদ্রের জলের উপর সূর্যাস্ত হওয়ার বিরল দৃশ্যটা দেখতে পাব, কিন্তু তারপরে কিছুটা বেয়াড়া মেঘ এসে সেই সম্ভাবনার সলিলসমাধি করে দিল। বিদেশী পর্যটকদের ভীড়ের কারণেই বোধহয় এখানে বীচে প্রচুর ছাতার নিচে বসার চেয়ার আর সেইসঙ্গে ডাব থেকে শুরু করে নানারকম পানীয়ের ব্যবস্থা রয়েছে। আমরা ঘন্টাখানেক বীচে ঘোরাঘুরি করে ফেরার পথ ধরলাম।

গ্রিলরত চিকেন সসেজ
রাস্তায় ফেরার পথে একটা ডিপার্টমেন্টাল স্টোর পড়ল, নাম ইন্দোমারেট, সেখানে ঢুকলাম পানীয় জল কেনার জন্য। আমাদের হোটেলে ঘরে জল দেয় ঠিকই, কিন্তু সেটা একেবারেই পর্যাপ্ত নয়। বালিতে মিনারেল ওয়াটারের বোতলের দাম আমাদের দেশের তুলনায় কিছুটা বেশি - একটা ১.৫ লিটার জলের বোতলের দাম ৪,৯০০/- রুপিয়া। জল ছাড়া কিছু চিকেন সসেজ কিনে হোটেলে ফিরে এলাম। আমাদের সঙ্গে কলকাতা থেকে আনা কিছু খাবার ছিল, সেগুলোর সঙ্গে সসেজ দিয়ে হোটেলের ঘরে বসে ডিনার করে নিলাম।

হোটেল জিয়ার ব্রেকফাস্ট কাউন্টার
বুধবার ১২ই অক্টোবর, ২০২২ - সকালে প্রথমে আমাদের হোটেল থেকে ব্রেকফাস্ট করে নিলাম। এখানকার ব্রেকফাস্ট কাউন্টার থেকে বাফেট ব্রেকফাস্ট খাওয়া যায়। মাথাপিছু খরচ বড়দের ৫০,০০০/- রুপিয়া আর ছোটদের ২৫,০০০/- রুপিয়া। ব্রেকফাস্টে হরেকরকম খাবার পাওয়া যায় যার মধ্যে ফ্রাইড-রাইস, চাউমিন, চিলি চিকেন, চিকেন সসেজ, প্যানকেক্‌, অরেঞ্জ জুস ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য (আরও অনেএএএক কিছু ছিল, এখানে প্রধানতঃ আমি যেগুলো খেয়েছি, সেগুলোই লিখলাম !)।

ব্রেকফাস্ট করে আমরা বেরোলাম সাইট সিয়িং করতে। সাইট সিয়িং-এর জন্য হোটেল থেকেই গাড়ি পাওয়া যায়। গাড়ি ১০ ঘন্টার জন্য নিতে হয়। আমাদের হোটেল থেকে ঘোরার জন্য দু'ধরনের গাড়ি পাওয়া যায় - টয়োটা অ্যাভাঞ্জা আর নিসান সেরেনা। বালির সাইট সিয়িং-কে মোটামুটি চারভাগে ভাগ করা যায় - উবুদ এলাকা, নুসা দুয়া এলাকা, বেদুগুল এলাকা আর কারাঙ্গাসেম এলাকা। টয়োটা অ্যাভাঞ্জা বুক করলে প্রথম তিনটের খরচ ৫৫০,০০০/- রুপিয়া আর শেষেরটার খরচ ৭৫০,০০০/- রুপিয়া। ঘোরার সমস্ত জায়গার পার্কিং আর যাত্রীপিছু একটা করে জলের বোতল এই খরচের অন্তর্ভুক্ত। আমরা একটা টয়োটা অ্যাভাঞ্জা নিয়ে সকাল ন'টা নাগাদ বেরোলাম উবুদ এলাকা ঘুরতে।

বাটুয়ান টেম্পল -
ঢোকার টিকিট - বড়দের মাথাপিছু ৩০,০০০/- রুপিয়া আর ছোটদের মাথাপিছু ১৫,০০০/- রুপিয়া।

স্যারং পরিহিত
হোটেল থেকে একঘন্টা চলার পরে আমরা পৌঁছলাম উবুদ এলাকায় আমাদের প্রথম দ্রষ্টব্য স্থান বাটুয়ান টেম্পলে (স্থানীয় ভাষায় পুরা বাটুয়ান - পুরা অর্থাৎ মন্দির)। এখানে টিকিট কাটার পরে কোমরে একটা রঙিন নক্সা করা চাদরের মতো জিনিস, নাম স্যারং, পরিয়ে দেয়। আমাদের মধ্যে মা শাড়ি পরে ছিল, তাই মা ছাড়া বাকি সবাইকেই পরতে হল। এটা এখানকার নিয়ম - মন্দির বা পবিত্র জায়গায় ঘুরতে গেলে এটা পরতে হয়। এর জন্য কোনও অতিরিক্ত চার্জ লাগে না।

বাটুয়ান টেম্পল্‌ চত্বরের কিছুটা
মন্দিরের চত্বরটা বিশাল। মন্দিরে ঢুকতে গেলে জুতোও খুলতে হয় না। এখানকার মন্দির ঠিক ভারতীয় মন্দিরের মতো নয়, এখানে মন্দিরের ভিতরে কোনও ঘর বা কোনও বিশেষ বিগ্রহ নেই। পুরো জায়গাটা জুড়ে বেশ কিছু ছোট-বড় ঘরের মতো জিনিস, তার কয়েকটার আবার চাতাল রয়েছে। এই চাতালগুলোয় চাইলে বসাও যায়। কিছু কিছু স্ট্রাকচার  দেখতে অনেকটা প্যাগোডার মতো। পুরো জায়গা জুড়েই বিভিন্ন মূর্তি রয়েছে, চাইলে সেগুলোকে পুজোও দেওয়া যায়। এখানকার পুজোর মধ্যেও বেশ অভিনবত্ব আছে, একটা কলাপাতার বাটিতে (স্থানীয় ভাষায় যার নাম 'কানাং সারি') কয়েকটা ফুল, ধুপ আর নিজের পছন্দের যেকোনও জিনিস দিয়ে এরা কোনও একটা মূর্তির সামনে বসিয়ে দেয়। কোনও পূজারী বা রীতিনীতির ব্যাপার আছে বলেও মনে হল না। যে যার খুশিমতো ঘুরছে, ছবি তুলছে, কথাবার্তা বলছে কিন্তু সবমিলিয়ে জায়গাটার মধ্যে একটা পরিমিত নিয়মানুবর্তিতা কাজ করছে, এটা অস্বীকার করার উপায় নেই। মন্দির সংলগ্ন একটা ছোট জলাশয়ের মধ্যে অনেক মাছের সঙ্গে কয়েকটা কচ্ছপও চোখে পড়ল।

তেগুনুঙ্গান ওয়াটারফল্‌ (অবশ্য দ্রষ্টব্য)-
ঢোকার টিকিট - বড়দের মাথাপিছু ২০,০০০/- রুপিয়া আর ছোটদের মাথাপিছু ১০,০০০/- রুপিয়া।

তেগুনুঙ্গান ওয়াটারফল্‌ (উপর থেকে)
বাটুয়ান টেম্পল থেকে মিনিট কুড়ি চলার পরে আমরা পৌঁছলাম তেগুনুঙ্গান ওয়াটারফল্‌-এ। এখানে গাড়ি থেকে নেমে কিছুটা ঢালুপথে নামলে আসল জলপ্রপাতটা চোখে পড়ে। আসল জলপ্রপাতটার সামনে যেতে গেলে অবশ্য সিঁড়ি দিয়ে অনেকটা নিচে নামতে হয়। যারা অতটা নিচে নামতে চায় না, তারা চাইলে উপর থেকেও জলপ্রপাতের দৃশ্য দেখতে পারে।

তেগুনুঙ্গান ওয়াটারফল্‌ (কাছ থেকে)
মা ছাড়া আমরা সবাই নিচে নামলাম। যতই নিচে নামা যায়, ততই জলের শব্দ জোরালো হয়। পরে জেনেছিলাম, এই জলপ্রপাত দেখার জন্য আমাদের সময়টা একেবারে যথাযথ কারণ বর্ষার পরে এই সময়ে এখানে জলের তেজ সবচেয়ে বেশি থাকে। সত্যি বলতে কি, তেজের নমুনা আমরা চোখের সামনেই দেখতে পাচ্ছিলাম। পাহাড়ের উপর থেকে সুবিশাল জলরাশি নিচে আছড়ে পড়ে খরস্রোতা নদী হয়ে এগিয়ে চলেছে। নিচে নামতে নামতে ঝর্ণার একেবারে সামনেও যাওয়া যায়, এখানে নদীর মধ্যে একটা পাথুরে চরের মতো রয়েছে। জায়গাটায় যেতে গেলে একটা ছোট্ট কাঠের পুল পেরিয়ে যেতে হয়। এখানে গেলে গায়ে জলের ছিটে রীতিমতো জোরে লাগে। এখান থেকে ঝর্ণার দৃশ্য অনবদ্য ! তেগুনুঙ্গান জলপ্রপাতে প্রচুর লোক স্নান করে - ঝর্ণার জলে স্নান করার মজাই আলাদা ! আমাদের হাতে সময়ও ছিল না আর আমরা স্নান করার জন্য তৈরি হয়েও যাইনি, তাই তেগুনুঙ্গানে স্নান করাটা পরেরবারের জন্য তোলা রইল। আমরা ফেরার সময়ে একটু ঘুরপথে আরও তিনটে ছোট্ট ছোট্ট কাঠের পুল পেরিয়ে আবার মূল ভুখন্ডে ফিরে এসে উপরে উঠে এলাম। বালিতে গেলে তেগুনুঙ্গান জলপ্রপাত অবশ্য দ্রষ্টব্য এবং নিতান্ত অসম্ভব না হলে জিনিসটা একেবারে নিচে নেমে দেখাই বাঞ্ছনীয়।

গোয়া গজাহ টেম্পল্‌ -
ঢোকার টিকিট - বড়দের মাথাপিছু ৫০,০০০/- রুপিয়া আর ছোটদের মাথাপিছু ২৫,০০০/- রুপিয়া।

গোয়া গজাহ মন্দিরের কাছের দোকানপাট
তেগুনুঙ্গান ওয়াটারফল্‌ থেকে মিনিট দশেক চলার পরে আমরা পৌঁছলাম আমাদের তৃতীয় গন্তব্য গোয়া গজাহ টেম্পলে। 'গজাহ' শব্দটার সঙ্গে গজ অর্থাৎ হাতির মিল থাকায় আন্দাজ করছিলাম এটা একটা গণেশের মন্দির। এই মন্দিরেও ঢোকার সময়ে আমাদের স্যারং পরিয়ে দিল। এখানে মন্দিরের গেটের কাছে প্রচুর দোকানপাট রয়েছে আর সেখানে ট্যুরিস্টদের জন্য ঘর সাজানোর জিনিস থেকে শুরু করে জামাকাপড়, সাজের জিনিস, রকমারী ব্যাগ সবই আছে। দাম যথারীতি অনেক চড়ানো। বালিতে দরদাম করার ব্যাপারে মোটামুটি নিয়ম হল দোকানী যা বলছে, তোমাকে তার অর্ধেক বা তার কম দিয়ে শুরু করতে হবে আর তার থেকে খুব একটা উপরে ওঠা চলবে না। হয় দোকানী তোমার দামের কাছে আসবে অথবা তুমি নিজে পরবর্তী দোকানীর কাছে যাবে। বালিতে ট্যুরিস্টের জন্য দোকানের অভাব নেই, তাই দরদাম করে কেনার সুবিধে পূর্ণমাত্রায় রয়েছে।

গোয়া গজাহ মন্দিরের ভিতরে
গোয়া গজাহ গণেশেরই মন্দির। তবে এখানেও সেভাবে বিগ্রহ নেই, যদিও একজায়গায় অনেক লোকজন বসে কিছু একটা পুজো করছে, এটা বুঝতে পারছিলাম। এখানেও মন্দিরের চত্বরটা বিশাল আর জায়গায় জায়গায় অনেক ছোটবড় মন্দিরের মতো রয়েছে। মন্দিরের সংলগ্ন জলাশয়ে ফোয়ারার মতো ব্যবস্থা করা রয়েছে, যেখানে একাধিক নারীমূর্তি কলসি থেকে জলাশয়ের মধ্যে অবিরাম জল ফেলে চলেছে। মন্দির চত্বরে কয়েকজায়গায় একটা করে ছোট বেদির মতো রয়েছে, সেখানে একটা ছোট কাঠের সিংহাসনে কিছু পুজোর সামগ্রী যেমন জল, ফুল, ঘন্টা ইত্যাদি রাখা রয়েছে। যে কেউ চাইলে এই বেদির উপরে বসে এইসব পুজোর সামগ্রী ব্যবহার করে পুজো করতে পারে।

পাহাড়ের ধাপে ধাপে রাস্তা
মন্দিরের পাশের একটা সিঁড়ি দিয়ে নেমে কিছুদূর গেলে একটা ছোট ঝর্ণা দেখতে পাওয়া যায়। পুরো জায়গাটা পাহাড়ের ধাপে ধাপে আর সেইসঙ্গে গাছপালায় ঘেরা। পরিবেশ খুবই মনোরম। আকাশে সূর্য থাকলেও এই জায়গাটা গরম নয় একেবারেই, বেশ আরামদায়ক। আধঘন্টামতো ঘুরে আমরা মন্দির থেকে বেরিয়ে এলাম।

কিন্তামনি বাতুর ভল্‌ক্যানো (অবশ্য দ্রষ্টব্য) -
ঢোকার টিকিট - বড়দের মাথাপিছু ৫০,০০০/- রুপিয়া আর ছোটদের লাগেনা।

গোয়া গজাহ টেম্পল থেকে বেরিয়ে প্রায় একঘন্টা চলার পরে আমরা পৌঁছলাম কিন্তামনি ভিউ পয়েন্টে। শেষের মিনিট পনেরো ধরে অনুভব করছিলাম, আমরা পাহাড়ী পথে বেশ উপরে উঠে যাচ্ছি। জায়গায় জায়গায় মেঘ বা কুয়াশার মধ্যে দিয়ে আমাদের গাড়ি যাচ্ছিল। কিন্তামনি ভিউ পয়েন্টে আমরা যখন পৌঁছলাম, তখন প্রায় দুপুর দুটো। এখানে পৌঁছে বেশ শীত করছিল। কিছু করার নেই, আমরা বালি ভ্রমণের জন্য সঙ্গে কোনও গরম জামাকাপড় আনিনি। ড্রাইভার আমাদের একটা রেস্ট্যুরেন্টে নিয়ে গেল লাঞ্চের জন্য। রেস্ট্যুরেন্টটা আবার চারদিক খোলা, ফলে ঠান্ডা লাগাটা কমলো না। এই অবস্থায় ঠান্ডা লাগা কমানোর উপায় হল গরম খাবার - আমরা ভাত, চিকেন আর একটা মাছ দিয়ে লাঞ্চ সেরে নিলাম। মাছটা এখানকার স্থানীয় বাতুর লেকের এবং খেতে বেশ ভালো। আমাদের সবমিলিয়ে খরচ পড়ল ৩২০,০০০ রুপিয়া।

বাতুর আগ্নেয়গিরি
রেস্ট্যুরেন্টের ভিতর থেকেই সামনে দেখা যায় বাতুর পাহাড়ের উপর বাতুর আগ্নেয়গিরি। এই বাতুর পাহাড়ের একেবারে উপরে আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখটা মেঘে ঢাকা থাকার জন্য দেখতে পেলাম না, তবে ছবিতে যেমন আগ্নেয়গিরি দেখা যায় পাহাড়টা একেবারে সেরকমই দেখতে। পাহাড়ের সামনের জমিটা কালো রঙের আগ্নেয় ভস্ম বা ভল্‌ক্যানিক অ্যাশ-এ ঢাকা। বাতুর আগ্নেয়গিরি হল জীবন্ত আগ্নেয়গিরি - আজ থেকে মাত্র ২২ বছর আগে ২০০০ সালে এখানে অগ্ন্যুৎপাত হয়েছে। হয়তো প্রাকৃতিক কারণেই এখানে পাহাড়ের উপরটা সবসময়ে মেঘে ঢাকা থাকে। আমরা অবশ্য আগ্নেয়গিরির লাভা নিঃসরণ দেখতে পাইনি (সেটাই অভিপ্রেত। আগ্নেয়গিরি মৃত বা সুপ্তই ভালো, জীবন্ত আগ্নেয়গিরির হঠাৎ করে জীবনের লক্ষণ দেখানোর ইচ্ছে হলে সেটা দর্শকদের কাছে আদৌ সুখকর অভিজ্ঞতা হবে না !)।

বাতুর লেক
বাতুর আগ্নেয়গিরি দেখে মিনিট দশেক নেমে আসার পরে একটা জায়গায় দাঁড়ালাম বাতুর লেকটা দেখার জন্য। আগ্নেয়গিরির পাশেই লেক আর জলের রঙটা একেবারে সবুজ। এটা হল আগ্নেয়গিরির দ্বারা সৃষ্ট হ্রদ (ইংরিজীতে যাকে বলে 'ভলক্যানিক ক্রেটর লেক')।



তির্তা এম্পুল টেম্পল্‌ (অবশ্য দ্রষ্টব্য) -
ঢোকার টিকিট - বড়দের মাথাপিছু ৫০,০০০/- রুপিয়া আর ছোটদের মাথাপিছু ২৫,০০০/- রুপিয়া।

তির্তা এম্পুল টেম্পলের ভিতরে
বাতুর লেক দেখার পরে আরও আধঘন্টা চলার পরে আমরা পৌঁছলাম আমাদের পঞ্চম গন্তব্য - তির্তা এম্পুল টেম্পলে। আমরা পাহাড়ের উঁচু জায়গাটা থেকে নেমে এসেছি, তাই আগের মতো ঠান্ডা না লাগলেও মেঘলা করে থাকার জন্য গরম একেবারেই লাগছিল না। তির্তা এম্পুল টেম্পলের বিবরণ আর আলাদা করে দিচ্ছি না, কারণ মন্দিরের ভিতরের চত্বরটা আগেরগুলোর থেকে বিশেষ আলাদা কিছু নয়। সেই কয়েকটা আলাদা আলাদা স্ট্রাকচার, জলাশয়, তার মধ্যে মাছ - সবই এক। কিন্তু এখানকার মন্দিরে সবথেকে বেশি যেটা চোখে পড়ে সেটা হল পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা। মন্দিরের দর্শনার্থীর অভাব নেই, কিন্তু সবকিছুর মধ্যেই একটা সুশৃঙ্খল ভাব লক্ষ্য করা যায়। ঠেলাঠেলি নেই, পুরোহিতদের বাড়াবাড়ি নেই, পুজোর সামগ্রী গছানোর জন্য ঘাড়ের উপর দোকানদারের ভীড় নেই। এখানকার বেশিরভাগ জলাশয়ের মধ্যেই ফোয়ারার মতো জল পড়ার একটা ব্যবস্থা থাকে - এখানে কতগুলো সুদৃশ্য মুখের মতো জিনিস থেকে জল পড়তে দেখতে পেলাম।

তির্তা এম্পুল টেম্পল দেখতে দেখতে জোরে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। আমরা কোনওমতে তাড়াতাড়ি গাড়িতে উঠে রওনা দিলাম আমাদের পরবর্তী গন্তব্যের দিকে।

তেগালালাং রাইস টেরাস -
ঢোকার টিকিট - বড়দের মাথাপিছু ১৫,০০০/- রুপিয়া আর ছোটদের লাগেনা।

তেগালালাং রাইস টেরাস
তির্তা এম্পুল টেম্পল থেকে মিনিট পনেরো চলার পরে বিকেল চারটে নাগাদ আমরা পৌঁছলাম তেগালালাং রাইস টেরাসে। এখানে পাহাড়ের গায়ে সিঁড়ির মতো ধাপে ধাপে ধানচাষ করা হয়। রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে রাইস টেরাসটা মোটামুটি ভালোভাবেই দেখা যায়, তাই আমরা এখানে আর ভিতরে ঢুকে সময় খরচ করলাম না। ভিতরে না ঢুকলে টিকিট লাগে না আর ভিতরে ঢোকার প্রধান উদ্দেশ্য হল রাইস টেরাসের মধ্যে দিয়ে ট্রেকিং করা। পুরো ট্রেকিংটা ঘন্টাদুয়েকের আর আমাদের পক্ষে এটা করার প্রশ্নই ওঠে না, তাই রাস্তার ধার থেকেই টেরাসটা দেখে নিলাম। জায়গাটা দেখতে খুবই সুন্দর এটা স্বীকার করতেই হবে, বিশেষ করে এরকম বিস্তীর্ণ জায়গা জুড়ে পাহাড়ের গায়ে ধাপে ধাপে ধানচাষ করতে আমি আগে কোথাও দেখিনি। আমাদের দেশে পাহাড়ের গায়ে চা-চাষ করার রেওয়াজ আছে, ধানচাষ কোথাও হয় কিনা জানি না।

উবুদ এলাকায় আমাদের প্যাকেজের মধ্যে আরেকটা জায়গা ছিল, সেটার নাম মাঙ্কি ফরেস্ট। কিন্তু আমরা আগেই জেনেছিলাম এই মাঙ্কি ফরেস্টে শুধু যে বহুসংখ্যক মাঙ্কি আছে তাই নয়, এখানে মাঙ্কিরা বেশ উৎপাতও করে। তাই আমরা মাঙ্কি ফরেস্টে না গিয়ে তার বদলে 'উবুদ প্যালেস' আর 'সরস্বতী টেম্পল' দেখার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম।

উবুদ প্যালেস -
ঢোকার টিকিট - লাগেনা

উবুদ প্যালেস
তেগালালাং রাইস টেরাস থেকে আধঘন্টা চলার পরে আমরা পৌঁছলাম উবুদ প্যালেসে। উবুদ প্যালেসটা উবুদ এলাকার একেবারে মাঝখানে। জায়গাটা জনবহুল হওয়ার কারণে এখানে ট্রাফিক জ্যামও বেশ ভালোই হয়। উবুদ প্যালেসটা বেশ সুন্দর, যদিও এখানে রাজা বা তাঁর পরিবারের লোকজন কোথায় থাকতেন, সেটা বুঝতে পারলাম না। জায়গাটার সঙ্গে এখানকার মন্দিরগুলোর মিল আছে, সেইরকমই স্ট্রাকচার। বেশ কয়েকটা বন্ধ দরজার সামনে পড়লাম কিন্তু সেগুলোর পিছনে কোনও প্রাসাদ বা বড় সাইজের ঘরজাতীয় কিছু আছে বলে মনে হল না। হয়তো আরও কিছুক্ষণ সময় এখানে কাটালে আর এখানকার লোকজনের সঙ্গে কথা বললে সেগুলো জানা যেত, কিন্তু সেসবের জন্য আর সময় খরচ করলাম না। এখানকার কারুকার্য আর শিল্পমান অত্যন্ত উন্নতমানের - সেগুলো দেখেই প্রাসাদ থেকে বেরিয়ে এলাম।

সরস্বতী টেম্পল্‌ -
ঢোকার টিকিট - লাগে না

সরস্বতী টেম্পল্‌
উবুদ প্যালেস থেকে মিনিট পাঁচেক হাঁটাপথে সরস্বতী মন্দির। আগেই বলেছি, জায়গাটা খুবই জনবহুল - রাস্তায় প্রচুর গাড়ি, তাই ফুটপাথের উপর দিয়ে হেঁটে আমরা পৌঁছলাম সরস্বতী মন্দিরে। এখানেও ঢোকার টিকিট লাগে না আর স্যারং পরার রীতিও নেই। মন্দিরের ভিতরটা ঢুকে খুব ভালো লাগল। অন্যান্য মন্দিরের মতো এখানে অনেক আলাদা আলাদা স্ট্রাকচার নেই, কিন্তু যেটা রয়েছে সেটা একটা বেশ বড় জলাশয় আর তার মধ্যে মাছের বদলে রয়েছে অজস্র পদ্মফুল। দেখে প্রায় পদ্মবনের তুলনাই দেওয়া চলে। এই জলাশয়ের মাঝখান দিয়ে চলে গেছে মন্দিরে যাওয়ার হাঁটারাস্তা। এই রাস্তাটা দিয়ে হাঁটতে খুব ভালো লাগে। মন্দিরের একেবারে সামনেটায় বেশ বড় একটা চত্বর যার একপাশে দেখলাম অনেক চেয়ার সাজানো হয়েছে। হয়তো সন্ধ্যেবেলা কোনও অনুষ্ঠান হবে। সরস্বতী মন্দিরে গিয়েও যথারীতি সরস্বতীর দেখা পেলাম না, তবে কারুকার্য করা মন্দিরটা দেখতে বেশ ভালো লাগল।

আমাদের প্রথমদিনের সাইট সিয়িং এখানেই শেষ - এবার আমাদের হোটেলে ফেরার পালা। আমাদের গাড়ি আমাদের নামিয়ে দিয়ে অনেক দূরে পার্কিং করেছিল, গাড়ি খুঁজে তাতে উঠতে উঠতে বিকেল সাড়ে পাঁচটা বেজে গেল। তারপর ফেরার পথ ধরলাম। নিরক্ষরেখার কাছাকাছি হওয়ায় বালিতে সন্ধ্যে হতে প্রায় সাড়ে ছটা বেজে যায়। আমাদের ফেরার পথে রাস্তায় খুবই যানজট পেলাম। গাড়িতে বসে বসে বেশ বিরক্তই লাগছিল, কিন্তু যেটা এখানে উল্লেখ করার মতো সেটা হল গাড়ির চালকদের শৃঙ্খলাবোধ। যত যানজটই থাকুক, কোনও গাড়িই কিন্তু উল্টোদিকের লেন ধরে এগিয়ে গিয়ে তার সামনের গাড়িকে ওভারটেক করছে না। প্রায় দেড় ঘন্টা ধরে আমাদের গাড়ি যে গাড়িটার পিছনে পিছনে চলছিল, সেটার পিছনেই চলল। আমাদের পিছনের বা তার পিছনের গাড়ির ক্ষেত্রেও এটা প্রযোজ্য। ভাবছিলাম, আমাদের দেশ হলে এতক্ষণে সব গাড়ি উল্টোদিকের লেন ধরে তার সামনের গাড়িকে ওভারটেক করে উল্টোদিক থেকে আসা গাড়িগুলোকে আটকে দিয়ে একটা বিশ্রী ব্যাপার করে ফেলত। এই নিয়মানুবর্তিতাই হয়তো এদের কাছ থেকে শেখার !

হোটেলে পৌঁছলাম তখন প্রায় রাত আটটা। আমরা এখানে কাছাকাছির মধ্যে কোনও স্থানীয় খাবারের দোকান বা ফুডকোর্ট ধরনের কিছু আছে কিনা, তার খোঁজ করছিলাম। সমস্যা হল আমাদের হোটেলটা কুটার যে অঞ্চলে, সেটা যাকে বলে কিছুটা অভিজাত এলাকা। অভিজাত হোটেল আর সেইসঙ্গে মানানসই রেস্ট্যুরেন্ট। সবকটাতেই বিদেশী নারীপুরুষের ভীড়। তাই এখানে আমরা যে ধরনের খাবার চাইছি, সেরকম খাবারের কোনোও দোকান নেই। বেশ কিছুক্ষণ ঘুরে ব্যর্থমনোরথ হয়ে আগেরদিনের মতো চিকেন সসেজ কিনলাম। সসেজগুলো খেতে খুবই ভালো ছিল। তাছাড়া আরও কিছু স্যান্ডউইচ্‌ ইত্যাদি দিয়ে রাতের ডিনার সেরে নিলাম। খরচ হল ১০৯,৭০০/- রুপিয়া।

বৃহস্পতিবার ১৩ই অক্টোবর, ২০২২ - সকালে ঘুম থেকে উঠে ব্রেকফাস্ট করলাম আমাদের আগের দিনের কিনে রাখা ইন্সট্যান্ট নুড্‌লস্‌ দিয়ে। তারপর আগেরদিনের মতো সকাল নটায় বেরোলাম আমাদের দ্বিতীয়দিনের সাইট সিয়িং-এর জন্য। গন্তব্য - কারাঙ্গাসেম এলাকা।

এখানে জানিয়ে রাখি, কারাঙ্গাসেম এলাকায় সাইট সিয়িং-টা অবশ্য কর্তব্য। এখানকার বিভিন্ন জায়গাগুলো বালির প্রধান আকর্ষণ। কারাঙ্গাসেম এলাকাটার দূরত্ব কুটা থেকে অন্যগুলোর তুলনায় বেশি হওয়ায় এখানকার গাড়িভাড়াটাও বেশি, কিন্তু আমার মনে হয় সেটা ব্যয় করাটা যুক্তিসংগত।

আমাদের হোটেল থেকে বেরিয়ে প্রায় সওয়া দু'ঘন্টা চলার পরে আমরা পৌঁছলাম আমাদের প্রথম গন্তব্যে। এই যাওয়ার রাস্তাটার বিবরণ দেওয়া জরুরী কারণ এই রাস্তাটার অনেকটাই একেবারে সমুদ্রের ধার বরাবর। বেশিরভাগ রাস্তাটাই হাইওয়ে আর মাঝের বেশ অনেকটা রাস্তা সমুদ্রের তীরবর্তী পাহাড়ের গা দিয়ে। এই দৃশ্য কোনওদিন ভোলার নয়। পাহাড়ের উপর থেকে সমুদ্র দেখার অনুভুতি অসাধারণ আর এই সুযোগ আমাদের দেশে ভাইজ্যাগ আর গোয়া ছাড়া খুব বেশি পাওয়া যায় না। গোয়া যাইনি, তবে ভাইজ্যাগেও একটা দীর্ঘ পথ দিয়ে গাড়ি করে যেতে যেতে এই দৃশ্য দেখার অভিজ্ঞতা আমার হয়নি। এখানে দেখলাম - উপভোগ করলাম।

লেম্পুইয়াং টেম্পল্‌ (অবশ্য দ্রষ্টব্য) -
ঢোকার টিকিট - বড়দের মাথাপিছু ৫৫,০০০/- রুপিয়া আর ছোটদের লাগেনা।
যাতায়াতের গাড়ির টিকিট - বড়দের মাথাপিছু ৪৫,০০০/- রুপিয়া আর ছোটদের লাগেনা।

লেম্পুইয়াং টেম্পল্‌ যাতায়াতের গাড়ি
লেম্পুইয়াং মন্দিরটা একটা পাহাড়ের উপরে। আমাদের গাড়ি এখানকার পার্কিং লটে আমাদের নামিয়ে দিল, এখান থেকে মন্দিরের নিজস্ব গাড়ি ছাড়া উপরে ওঠার নিয়ম নেই। আমরা মন্দিরের গাড়ির টিকিট কেটে গাড়িতে চড়ে বসলাম। গাড়িগুলো বেশ সুন্দর - চারিদিক খোলা, ভিতরে একসঙ্গে জনা দশেক লোক বসতে পারে। এই গাড়ি পাহাড়ের গায়ের খাড়াই পথ দিয়ে উপরে উঠতে লাগল। এই ওঠার রাস্তাটাও খুব সুন্দর। উপরে উঠে গাড়ি আমাদের যেখানে নামালো, সেখান থেকে আমরা মন্দিরে ঢোকার টিকিট কেটে নিলাম। এখানে আমাদের স্যারং পরানো হল আর মন্দিরের সম্পর্কে কিছুটা ধারণা দেওয়া হল।

এখানে পাহাড়ের উপর মোট সাতটা আলাদা আলাদা মন্দির আছে। পাহাড়ী পথে ঘুরে এই সবকটা দেখতে ঘন্টাচারেক সময় লাগে। তবে এদের মধ্যে প্রথম মন্দিরটাই সবথেকে বেশি বিখ্যাত - যেখানে 'স্বর্গের দ্বার' বা 'গেট অফ্‌ হেভেন' আছে (এই গেট অফ্‌ হেভেন-টা বালিতে খুব বিখ্যাত, বালির যেকোনও ট্যুরিস্ট গাইডেই এটার উল্লেখ আছে)। এটা যেতে মিনিট পাঁচেক সময় লাগে। আমরা চাইলে প্রথমটা দেখেই নেমে আসতে পারি অথবা চাইলে বাকিগুলোও দেখতে পারি।

গেট অফ্‌ হেভেন !
খাড়াই পথে মিনিট দশেক (পাঁচ মিনিটটা আসলে স্থানীয় লোকের পায়ে !) উঠে আমরা পৌঁছলাম প্রথম মন্দিরটার কাছে। এই গেট অফ্‌ হেভেনটা দেখতে ভীষণ সুন্দর, একটা বিশাল দরজা যার ভিতর দিয়ে দূরের মাউন্ট আগুং দেখা যায়। এই গেটের সামনে দাঁড়িয়ে বিভিন্ন পোজে ছবি তোলাটা একটা বিশেষ ব্যাপার, এখানে যারা যায় সবাই এটা করে বা করতে চায়। যেহেতু ছবি তোলার চাহিদা প্রচন্ড, তাই এরা টিকিটের সঙ্গেই একটা নম্বর লেখা কাগজ দিয়ে দেয়। এই নম্বরটা আমার ক্রমিক সংখ্যা, এই নম্বর অনুযায়ী লোকজনের ছবি তোলা হয়। আমাদের নম্বর ছিল ২৮৬ আর আমরা যখন এখানে পৌঁছলাম, তখন ১৬৮ (!) নম্বররের ছবি তোলা হচ্ছিল। হিসেব করে দেখলাম ছবি তুলতে গেলে আমাদের আরও অন্ততঃ ঘন্টা তিনেক অপেক্ষা করতে হবে। বলা বাহুল্য, আমরা সেটা করিনি। তার বদলে মন্দিরটা ভালো করে ঘুরে দেখেছি। ছবি তোলার চত্বরটা থেকে আরও বেশ কিছুটা উপরে
প্যানোরমিক ভিউতে মাউন্ট আগুং

আসল মন্দির, সেখানে সিঁড়ি দিয়ে উঠে আমরা চারদিকের প্যানোরমিক ভিউটা আরও সুন্দরভাবে দেখলাম।



নিচের চত্বর থেকে গেট অফ্‌ হেভেন
মন্দিরের চত্বরের কিছুটা নিচে আরেকটা চত্বর আছে, সেখান থেকেও এই গেট অফ্‌ হেভেনটা দেখা যায়। সেই জায়গাটা বেশ ফাঁকা, তাই এখানে গিয়ে আমরা জিনিসটা ভালো করে দেখলাম। আকাশে রোদের তেজ ছিল, তাই কিছুটা গরম লাগছিল। আর পাহাড়ী পথে বেশ কিছুটা হাঁটাহাঁটি হয়েছে, তাই সামনেই একটা শরবতের দোকান দেখে সেখান থেকে আমের শরবৎ খেয়ে ক্লান্তি দূর করা হল (খুব যে ক্লান্ত লাগছিল তা নয়, কিছুটা শরবৎ খাওয়ার জন্যই নিজেদের ক্লান্ত অনুভব করছিলাম !) ছ'গ্লাস শরবতের দাম নিল ১২০,০০০/- রুপিয়া। শরবৎটা অত্যন্ত ভালো সে'বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই, আমের ঘন রস আর তার মধ্যে বরফের কুচি দেওয়া। একগ্লাস খেলে যে ক্লান্তি দূর হয় তাইই নয়, পেটও কিছুটা ভর্তি হয়ে যায়।

স্যান্ডউইচ ও ফ্রেঞ্চ ফ্রাই তৈরি করে প্যাকিং হচ্ছে
মন্দির থেকে নামার পথে একটা স্যান্ডউইচের দোকান দেখে আমরা সেখান থেকে লাঞ্চের জন্য স্যান্ডউইচ্‌ বক্স কিনে নিলাম। চিকেন স্যান্ডউইচ্‌ অথবা হ্যাম স্যান্ডউইচ্‌ আর সেইসঙ্গে ফ্রেঞ্চ ফ্রাই। ছ'প্যাকেট স্যান্ডউইচের দাম নিল ২১০,০০০ রুপিয়া। গাড়ির স্ট্যান্ডে এসে আমরা আবার সেই চারদিক খোলা গাড়িতে উঠলাম আর তারপর সেই গাড়ি চড়ে নিচের পার্কিং লটে পৌঁছলাম। তারপরে আমাদের গাড়ি চড়ে দুপুর দেড়টা নাগাদ রওনা দিলাম আমাদের পরবর্তী গন্তব্যের উদ্দেশ্যে।

তির্তা গঙ্গা (অবশ্য দ্রষ্টব্য) -
ঢোকার টিকিট - বড়দের মাথাপিছু ৫০,০০০/- রুপিয়া আর ছোটদের মাথাপিছু ১৫,০০০/- রুপিয়া।

তির্তা গঙ্গায় জলের উপর পাথরের ধাপ
লেম্পুইয়াং টেম্পল্‌ থেকে মিনিট পনেরো চলার পরে আমরা পৌঁছলাম তির্তা গঙ্গায়। এটা একটা পুরনো রাজপ্রাসাদের অংশ। এখানে কয়েকটা হ্রদ ও সুইমিং পুল রয়েছে। এই গঙ্গা নামটা আমাদের দেশের গঙ্গার নাম থেকেই এসেছে আর তাই মনে করা হয় এই জল খুবই পবিত্র। এখানে পাশাপাশি তিনটে জলাশয় আছে, তার একটার জল কিছুটা গভীর, সেখানে চাইলে নৌবিহার করা যায়। অন্যদুটোর একটা নিতান্তই অগভীর। সেটার জলের মধ্যে পরপর আটকোণা পাথরের ধাপে করে আছে, এই ধাপগুলো দিয়ে চাইলে হেঁটে জলাশয়ের একপাড় থেকে অন্য পাড়ে যাওয়া যায়। এই যাওয়ার পথটা আবার সোজাসুজি নয়, পুরো জলাশয়টা জুড়েই এই পথটা করা আছে। একেকটা ধাপ অপরিসর - মাত্র একজন মানুষই এর উপর দাঁড়াতে পারে। ফলে একবার এই ধাপ ধরে এগিয়ে গেলে পিছনোরও কোনও উপায় নেই আবার সামনের লোক কোনও কারণে না এগোলে তাকে পেরিয়ে যাওয়ারও কোনও উপায় নেই। আমি কথা কলি তিনজনে এই ধাপ ধরে একপাড় থেকে অন্যপাড়ে যাওয়ার অভিজ্ঞতাটা সঞ্চয় করলাম।

তির্তা গঙ্গার দ্বীপ
পুরো জায়গাটা অত্যন্ত সুন্দরভাবে সাজানো গোছানো। জলাশয়ের মাঝে আবার একটা দ্বীপ রয়েছে আর সেটার সঙ্গে মূলভূখন্ডকে যোগ করে দুটো ছোট ছোট ব্রীজ রয়েছে। পুরো জায়গাটায় পাহাড়, গাছ, ফুল, পাতা, জলাশয়, ফোয়ারা, ছোট বড় মূর্তি, নৌকো, পর্যটকদের নানারঙের পোষাক - আর সেইসঙ্গে রৌদ্রজ্জ্বল আবহাওয়া সবমিলিয়ে রঙের যে বাহার তৈরি হয়েছে, সেটা সত্যিই চোখে পড়ার মতো। খুবই ভালো লাগছিল এই জায়গাটা।

তামান উজুং (অবশ্য দ্রষ্টব্য) -
ঢোকার টিকিট - বড়দের মাথাপিছু ৭৫,০০০/- রুপিয়া আর ছোটদের মাথাপিছু ৫০,০০০/- রুপিয়া।

তির্তা গঙ্গা থেকে গাড়িতে মিনিট কুড়ি যাওয়ার পরে আমরা পৌঁছলাম তামান উজুং-এ। এই জায়গাটা সমুদ্রের ধারে, তাই যাওয়ার পথে সমুদ্রের খুব কাছ দিয়েই গেলাম। এখান থেকে সমুদ্রের দৃশ্যও অসাধারণ।

তামান উজুং-এ ঢোকার ব্রীজ
তামান উজুং হল ওয়াটার প্যালেস। টিকিট কেটে হেঁটে ঢোকার পথে এখানে একটা ব্রীজ আছে যার নিচে বর্তমানে নানারকম গাছপালা রয়েছে। দেখে মনে হয় কোনও একসময়ে এখানে হয়তো কোনও জলাশয় ছিল, যেমন আগেকার দিনে বেশিরভাগ রাজপ্রাসাদ বা কেল্লার বাইরে থাকত বহিঃশত্রুর হাত থেকে নিরাপদে থাকার জন্য।

তামান উজুং ওয়াটার প্যালেস
এই ব্রীজ পেরিয়ে প্যালেসের মূল চত্বরটায় ঢুকতে হয়। এখানেও ভিতরটা দেখে চোখ জুড়িয়ে গেল। একটা বিশাল সাইজের আয়তাকার জলাশয় আর তার মাঝখানে প্রাসাদ। জলাশয়ের দুদিক থেকে দুটো ব্রীজ দিয়ে এই প্রাসাদে যাতায়াতের ব্যবস্থা রয়েছে। জলাশয়ের চারদিকে প্রশস্ত রাস্তা, সেটা দিয়ে চাইলে পুরো জায়গাটা ঘুরে দেখা যায়। ব্রীজ দিয়ে পর্যটকরা চাইলে প্রাসাদে ঢুকতেও পারেন। প্রাসাদটা অবশ্য বিরাট বড় কিছু নয়, হয়তো রাজারা শুধুমাত্র বিশ্রামের জন্যই এখানে আসতেন। আমরা যথারীতি ব্রীজ পেরিয়ে প্রাসাদে ঢুকলাম। দুপুর তিনটে বাজে, রোদের তেজও ভালই, তাই ওয়াটার প্যালেসের ভিতরে ঢুকে বেশ আরাম বোধ হচ্ছিল। এখানেও জুতোটুতো খোলার ব্যাপার নেই। ভিতরটা অত্যন্ত পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। ভিতরে রাজার এবং রাজপরিবারের লোকজনের ছবি ও তাঁদের সম্পর্কে তথ্যও ছিল, কিন্তু সেগুলো আর পড়ে দেখিনি। প্রাসাদে কিছুক্ষণ কাটিয়ে অন্যদিকের ব্রীজ পেরিয়ে আমরা আবার জলাশয়ের পাড়ে এসে পৌঁছলাম।

টিলার উপর থেকে প্যালেস ও পিছনে সমুদ্র
এখান থেকে দুদিকে দুটো লম্বা সিঁড়ি উঠে গেছে পাশের একটা টিলার উপরে ওঠার জন্য। আমি কথা কলি এই সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠলাম উপর থেকে প্রাসাদের দৃশ্য দেখার জন্য। জলের উপর তামান উজুং আর তার পিছনে কিছুদূরে সমুদ্র - এই দৃশ্য নিজের চোখে না দেখলে এর সৌন্দর্যের বর্ণনা দেওয়ার চেষ্টা করা আমার মতো অ-সাহিত্যিকের পক্ষে শুধু যে মুস্কিল বা অসম্ভব তাইই নয়, হাস্যকরও বটে। এক কথায় বলছি - অনবদ্য !

নিচে নেমে এসে আমরা বেরিয়ে এলাম তামান উজুং ওয়াটার প্যালেস থেকে। এই একটা জায়গায় ঘুরে মনে হচ্ছিল এখানে আরও কিছুক্ষণ থাকতে পারলে মন্দ হতো না। দুপুর সাড়ে তিনটে বাজে, আমরা গাড়িতে করে এগিয়ে চললাম আমাদের দিনের শেষ গন্তব্য - ক্যান্ডি ডাসা বীচের দিকে। যেতে মিনিট কুড়ি লাগল আর এর মাঝে গাড়িতে বসেই আমরা আমাদের স্যান্ডউইচ্‌ দিয়ে লাঞ্চ সেরে নিলাম। খুবই সুস্বাদু !

ক্যান্ডি ডাসা বীচ্‌ (অবশ্য দ্রষ্টব্য) -
ঢোকার টিকিট - লাগে না

ক্যান্ডি ডাসা বীচ্‌
পান্টাই ক্যান্ডি ডাসা বা ক্যান্ডি ডাসা বীচ্‌টা (পান্টাই শব্দের অর্থ বীচ্‌) পাহাড়ের একেবারে ধারে। এর ভৌগলিক অবস্থান দেখে মনে হয় যেন পর্যটনের জন্যই তৈরি হয়েছে। সমুদ্রের নীল জল, সেইসঙ্গে প্রায় সাদারঙের বালি, তার পিছনে নারকোল গাছের মাঝে ছোট ছোট হোটেল আর রেস্ট্যুরেন্ট আর সবকিছুর পিছনে সবুজ রঙের পাহাড় - সবমিলিয়ে একেবারে ছবির মতো। জলের মধ্যে কিছুটা গিয়ে দাঁড়ানোর জন্য বোল্ডার দিয়ে ঘেরা জায়গা আছে আর সেইসঙ্গে বাঁধানো পাড় আছে। আমরা যে সময়ে গেছিলাম, তখন বীচে বিশেষ কোনও লোকজন ছিল না, তাতে এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে আরওই ভালো লাগছিল। এখানে বীচে দাঁড়িয়ে সমুদ্রের জলের মধ্যে একটা আবছা দ্বীপ দেখা যায়, সেটা হল 'নুসা পেনিদা' বা পেনিদা দ্বীপ। বালিতে এলে অনেকে নুসা পেনিদাও যায় - জায়গাটা হানিমুনের জন্য বিশেষভাবে বিখ্যাত।

ক্যান্ডি ডাসা বীচ্‌ থেকে আমরা আমাদের হোটেলে ফেরার পথ ধরলাম। এখান থেকে ফিরতে ঘন্টা দেড়েক লাগল। এই ফেরার পথেরও অনেকটাই সমুদ্রের ধার দিয়ে। যখন হোটেলে পৌঁছলাম, তখন দিনের আলো প্রায় শেষ হয়ে এসেছে।

সন্ধ্যের জলখাবারের জন্য আবার সেই চিকেন সসেজ কেনা হল। রাতের ডিনারের জন্য আমাদের হোটেলের পাশের একটা দোকান থেকে চিকেন রাইস কেনা হল আর 'ইয়োশিনোয়া' নামক ফুড স্টল (এটা অনেকটা ম্যাক্‌ডোনাল্ডস্‌-এর মতো) জাপান'স নাম্বার ওয়ান বীফ্‌ বৌল কেনা হল। সব মিলিয়ে ডিনারের জন্য খরচ হল ৮৪,০০০/- রুপিয়া।

এখানে একটা বিশেষ ঘটনার কথা লিখে রাখি। হোটেলে ফিরে এসে আমরা আবিষ্কার করলাম আমাদের সঙ্গে আসা একটা ব্যাগ, যাতে অমৃতা, কথা আর কলির তিনটে টুপি ছিল, সেটা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। ঘরে অনেক খোঁজাখুঁজি করেও যখন পাওয়া গেল না, তখন বুঝলাম ব্যাগটা আগেই কোথাও খোয়া গেছে। আমাদের তোলা ছবিতে দেখা গেল, বালিতে প্লেন থেকে নামার সময়েও ব্যাগটা আমাদের কাছেই ছিল, কিন্তু তারপরে সেটা কোথায় গেল বোঝা যাচ্ছে না। হোটেলের রিসেপশনে গিয়ে খোঁজ করলাম, তারা তাদের 'লস্ট অ্যান্ড ফাউন্ড' কাউন্টার চেক্‌ করে বলল তারা আমাদের ব্যাগ পায়নি। অর্থাৎ ব্যাগ হোটেলে আসেনি। তাহলে একমাত্র সম্ভাবনা হল হয় এয়ারপোর্টে অথবা ক্যাবে ফেলে এসেছি। এয়ারপোর্টে ফেলে এসে থাকলে এই মূহুর্তে পাওয়ার সম্ভাবনা নেই তাই আগে ক্যাবেই খোঁজ করব ঠিক করলাম। ক্যাবটা এয়ারপোর্ট থেকে ধরেছিলাম তাই তার খোঁজ পাওয়া সহজ নয় কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে আমার কাছে ক্যাব ড্রাইভারের একটা কার্ড ছিল। সেই কার্ডের ফোন নম্বরে ফোন করে নিজের পরিচয় দিয়ে আর হোটেলের নাম বলতেই ড্রাইভার নিজে থেকেই জিজ্ঞেস করল - আমরা কোনও টুপির ব্যাগ হারিয়েছি কিনা ? এত সহজে খোঁজ পাওয়া যাবে ভাবিনি ! সঙ্গে সঙ্গে বললাম - হ্যাঁ। তখন সে বলল - আমি আজ রাতে তোমাদের হোটেলে গিয়ে ব্যাগটা ফেরৎ দিয়ে আসব।

হ্যাঁ, সে এসেছিল। রাত তখন সাড়ে এগারোটা। হাসিমুখে ব্যাগটা ফেরৎ দিয়ে গিয়েছিল। তার জন্য কোনও অর্থ দাবী তো দূরের কথা, অনুরোধও করেনি। করতেই পারত। কিন্তু আমি তাকে খালি হাতে ফিরে যেতে দিইনি, তার হাতে কিছু 'রুপিয়া' গুঁজে দিয়েছিলাম। কত, সেটা ইচ্ছে করেই এখানে লিখলাম না। এটা জোর দিয়ে বলতে পারি যা দিয়েছিলাম, ভারতীয় টাকায় সেটা টুপিগুলোর দামের চেয়ে বেশিই হবে। তাতে কিছু যায় আসে না। কারণ - দামটা টুপিগুলোর নয়।

দামটা সততার।

দামটা নিঃস্বার্থভাবে পরোপকার করার মানসিকতার।

দামটা কথা-কলির মুখের হাসির। 😊

শুক্রবার ১৪ই অক্টোবর, ২০২২ - ব্রেকফাস্ট করলাম আমাদের আগের দিনের মতোই - ইন্সট্যান্ট নুড্‌লস্‌ দিয়ে। তারপর আগেরদিনের মতো সকাল নটায় বেরোলাম আমাদের তৃতীয়দিনের সাইট সিয়িং-এর জন্য। গন্তব্য - নুসা দুয়া এলাকা।

নুসা দুয়া এলাকায় আমাদের প্রথম গন্তব্য বেনোয়া বীচ্‌। কুটা থেকে এই বেনোয়া বীচে যাওয়ার জন্য ৬.৫ কিলোমিটার দীর্ঘ একটা সী-লিঙ্ক আছে (মুম্বইয়ের বান্দ্রা-ওর্লি সী-লিঙ্কের মতো) যেটা দিয়ে গেলে রাস্তা আর সময় দুটোই কম হয়। আমরা সেই রাস্তা দিয়ে যাব কিনা সেটা ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করাতে তিনি বললেন তাঁর গাড়িতে টোল স্টিকার (আমাদের দেশের ফাস্ট্যাগের মতো) নেই আর টোল স্টিকার ছাড়া ওই ব্রীজ দিয়ে যাওয়া যায় না। ব্রীজটা আমরা আসার সময়ে প্লেন থেকেও দেখেছিলাম আর ওটার উপর দিয়ে গেলেও নিশ্চয়ই ভালোই লাগত, কিন্তু দূর্ভাগ্যক্রমে সেই সুযোগ পাওয়া গেল না।

বেনোয়া বীচ্‌ (অবশ্য দ্রষ্টব্য) -
ঢোকার টিকিট - লাগে না

বেনোয়া বীচে জলক্রিড়ার মেলা
সী-লিঙ্ক ব্যবহার না করে শহরের ভিতরের রাস্তা দিয়ে আমাদের হোটেল থেকে বেনোয়া বীচ্‌ পৌঁছতে লাগল পঁয়তাল্লিশ মিনিটের মতো। বীচে পৌঁছে দেখলাম যেন মেলা বসেছে ! বোটিং সার্ফিং ডোনাট রাইডিং জেট স্কিয়িং প্যারাসেইলিং ফ্লাইবোর্ডিং ইত্যাদি যতধরনের জলক্রীড়ার (ওয়াটার স্পোর্টস্‌) সম্পর্কে আমি জানি, সবগুলোই এখানে হচ্ছে। সেইসঙ্গে আছে "দাদা, আমার সঙ্গে চলুন, আমি কম টাকায় ঘুরিয়ে আনব" জাতীয় ডাকাডাকি (এই জিনিসটার সঙ্গে আমাদের দেশের কোনও পার্থক্য নেই !)। যাই হোক আমাদের কোনও কিছুই করার পরিকল্পনা ছিল না, তাই বীচেই দাঁড়িয়ে সবকিছু ভালোভাবে দেখলাম। এখানে সম্ভবতঃ সমুদ্রের পাড় থেকেই জলের গভীরতা শুরু হয়ে যায়, তাই ঠিক এই জায়গাটায় কাউকে স্নান করতে দেখলাম না। বীচ্‌টা এমনিতে খুব সুন্দর - নীল জলের উপর রাশি রাশি নৌকো সমুদ্রে যাওয়ার জন্য তৈরি হয়ে রয়েছে। আমরা বীচে খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে (সেইসঙ্গে লাফালাফি করে !) আবার গাড়িতে গিয়ে বসলাম।

পান্ডোয়া বীচ্‌ (অবশ্য দ্রষ্টব্য) -
ঢোকার টিকিট - বড়দের মাথাপিছু ১৫,০০০/- রুপিয়া আর ছোটদের মাথাপিছু ১০,০০০/- রুপিয়া।

বেনোয়া বীচ্‌ থেকে আধঘন্টা চলার পরে পান্ডোয়া বীচ্‌। এখানে মনে হতে পারে বীচে যেতে আবার টিকিট কাটতে হবে কেন ? এর উত্তর হল এখানে বীচে যাওয়ার রাস্তাটা একটা পাহাড়ের মধ্যে দিয়ে আর পৌঁছনোর সামান্য আগে একটা গেট বসানো আছে। এই গেটেই টিকিটটা কাটতে হয়।

পান্ডোয়া বীচে্‌ ঢোকার রাস্তা
বীচে ঢোকার রাস্তাটা দূর্দান্ত ! সমুদ্রের একেবারে পাশেই অনুচ্চ পাহাড় আর এই পাহাড়ের গায়ে বিশাল বিশাল গর্ত করে তার মধ্যে পঞ্চপান্ডব, কুন্তী আর গণেশের (কেন গণেশ, আমার কোনও ধারণা নেই) মূর্তি বসানো হয়েছে। পাহাড়ের গা দিয়ে নিচে নেমে বীচে পৌঁছতে হয়। নামার সময়ে সমুদ্রের দৃশ্যটা দেখতে দারুণ লাগে।

পান্ডোয়া বীচ্‌
পাহাড়ের নিচে গাড়ি থেকে নেমে আমরা গেলাম সী-বীচে। বেনোয়া বীচের মতো জনবহুল নয়, পান্ডোয়া বীচ্‌ নিতান্তই নিরিবিলি আর শান্তশিষ্ট। এখানকার সমুদ্র জলক্রীড়ার জন্য নয়, বরং পাড়ে ছাতার তলায় বসে বা শুয়ে উপভোগ করার জন্য। আমরা সমুদ্রের ধারে বেশ কিছুক্ষণ ঘুরেটুরে দেখলাম পাড়ে বেশ কিছু খাবারের দোকান আছে। আগেরদিনের লাঞ্চ কিনে নিয়ে গাড়িতে বসে খাওয়ার ব্যাপারটা সবদিক দিয়েই খুব লাভজনক হয়েছে, তাই এখান থেকে লাঞ্চ কিনে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। ভাতের সঙ্গে চিকেন কারি আর ভাতের সঙ্গে পর্ক কারি সবমিলিয়ে ছ'প্লেট নেওয়া হল। খরচ হল ১১০,০০০/- রুপিয়া। লাঞ্চ যতক্ষণ তৈরি হচ্ছিল, সেই সময়ে আমরা একটা শরবতের দোকান থেকে শরবৎ খেয়ে সময়টা কাটিয়ে দিলাম।

উলুওয়াটু টেম্পল্‌ (অবশ্য দ্রষ্টব্য) -
ঢোকার টিকিট - বড়দের মাথাপিছু ৫০,০০০/- রুপিয়া আর ছোটদের মাথাপিছু ৩০,০০০/- রুপিয়া।

জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে রাস্তা
বালিতে গিয়ে যে জায়গাগুলো আমার সবথেকে বেশি ভালো লেগেছে, উলুওয়াটু মন্দির তার মধ্যে একটা। এর কারণ কী, সেটা সরাসরি না বলে ঘটনাক্রমেই লিখি। টিকিট কেটে আমরা গেট দিয়ে ভিতরে ঢুকলাম। এখানে আবার স্যারং পরানোর রেওয়াজ নেই, তার বদলে একটা গেরুয়া রঙের সিল্কের স্কার্ফের মতো জিনিস কোমরে বেঁধে দেয়। ভিতরে ঢুকে দেখলাম বেশ জঙ্গল জঙ্গল একটা ব্যাপার। গাছপালার মধ্যে দিয়ে এদিকে ওদিকে বাঁধানো পায়ে চলার রাস্তা চলে গেছে। জায়গায় জায়গায় ম্যাপ দিয়ে কোথায় কিভাবে যেতে হবে সেগুলো দেখানো হয়েছে। কিছুদূর এগিয়ে গিয়ে ডানদিকে একটা রাস্তা দিয়ে গিয়ে দেখলাম সেখানে একজন জোব্বা পরা লাঠি হাতে মানুষের বিশাল মূর্তি। এনার নাম দং হায়াং নিরর্থ। ইনি একজন হিন্দু পর্যটক যিনি ষোড়শ শতকে বালিতে ছিলেন।

ক্লিফ্‌ ভিউ
এই মূর্তির পাশের রাস্তাটা ঢালুপথে ধাপে ধাপে কিছুটা নেমে গেছে। দু'দিকে ঘন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে বেশিদূর দেখা যাচ্ছে না, তবে বেশ বুঝতে পারছি আমরা কোনও একটা বেশ উঁচু জায়গায় রয়েছি। একটা ছোট্ট বাঁক ঘুরতে হঠাৎই গাছপালার পর্দা সামনে থেকে সরে গেল আর দেখলাম - আমরা পাহাড়ের একেবারে ধারে একটা রেলিং-এর পাশে পৌঁছে গেছি আর সামনে দিগন্তবিস্তৃত অসীম নীল জলরাশি ! রেলিং-এর ওদিকে পাহাড়ের দেওয়াল খাড়া নিচের দিকে নেমে গিয়ে একেবারে জলের মধ্যে চলে গেছে। নিচে কিন্তু সমুদ্রের পাড় বা বীচ্‌ নেই, জলের রঙ দেখেই বোঝা যায়, জল এখানে প্রচুর গভীর। কিছুক্ষণ অন্তর অন্তর সমুদ্রের একেকটা সুদীর্ঘ ঢেউ এসে এই পাহাড়ে ধাক্কা মেরে নীল জল থেকে সাদা ফেনায় পরিণত হচ্ছে। ঢেউয়ের শব্দ এত উপর থেকেও স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে।

পাহাড় ও সমুদ্রের প্যানোরমিক ভিউ
আমাদের বাঁদিকে পাহাড়টা ধীরে ধীরে কিছুটা উপরের দিকে উঠে গেছে আর ডানদিকটা নেমে গেছে। পুরো পাহাড়ের পাড়টাই উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। আমি এইভাবে এত উপর থেকে এত কাছে কখনও সমুদ্র দেখিনি, বিশেষ করে জায়গাটা যেখানে সমুদ্রের বীচ্‌ নয়। খাড়া পাহাড়ের ঠিক পাশে সমুদ্রের এইরকম দৃশ্যকে বলে 'ক্লিফ্‌ ভিউ'। ঘাড় ঘুরিয়ে বাঁদিক থেকে ডানদিকে পুরো প্যানোরমিক ভিউটাই এতটাই সুন্দর যে মনে হয় এখানে দীর্ঘ সময় স্রেফ দাঁড়িয়েই থাকা যায়। আমি দৃশ্যটার প্যানোরমিক ছবি তুলেছি ঠিকই, কিন্তু ছবিতে আসল দৃশ্যের বড়জোর ১% ধরে রাখা সম্ভব !

টেম্পল্‌ এলাকা থেকে পাহাড়ের নিচু জায়গা
এরপর আমরা প্রথমে ডানদিকে গিয়ে শেষপর্যন্ত দেখে এসে তারপর বাঁদিকের রাস্তা ধরে ধাপে ধাপে উঠতে শুরু করলাম। পুরো রাস্তাটাই সমুদ্রের ধার ধরে, তাই ক্লিফ্‌ ভিউটা একটু একটু করে পালটে যাচ্ছিল। পাহাড়ের সবচেয়ে উঁচু জায়গাটার উচ্চতা ৯৭ মিটার, এখানেই আসল মন্দিরটা আছে। মন্দির সেই একই ধরনের - অর্থাৎ কোনও আলাদা করে বিগ্রহ দেখতে পেলাম না। যাই হোক, এই উঁচু জায়গাটা আরও সুন্দর বিশেষ করে এখান থেকে পাহাড়ের নিচু জায়গাটা দেখতে দারুণ লাগে। আমরা কিছুক্ষণ এখানে দাঁড়িয়ে নামার পথ ধরলাম।

এখানে একটা অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটল। একটা বাঁদর হঠাৎ ক্ষিপ্রগতিতে এসে মা-এর চোখ থেকে একটানে চশমাটা খুলে নিয়ে গেল। সানগ্লাস নয়, মা-এর পাওয়ারের চশমা। আচ্ছা মুশকিল  হল ! জিনিসটা সে খাবার ভাবছিল কিনা জানি না, কিন্তু ডাঁটিটা বারবার কামড়ে কামড়ে দেখছিল। বাঁদরের সঙ্গে পেরে ওঠা খুব কঠিন কারণ এদের বুদ্ধি প্রায় মানুষের সমান আর গতি মানুষের থেকে বেশি ! কি করব বুঝে উঠতে পারছি না, চশমা ফেরৎ পাওয়ার আশা একরকম ছেড়েই দিয়েছি এমন সময়ে মন্দিরের একজন ভদ্রলোক এগিয়ে এলেন। তাঁর হাতে কলা। তিনি একটা কলা বাঁদরটার দিকে ছুঁড়ে দিলেন। কিন্তু বাঁদরটা সেয়ানা ! সে একহাতে কলাটা আর অন্যহাতে চশমাটা নিয়ে আরও দূরে একটা জায়গায় গিয়ে বসল। এবার ভদ্রলোক আরেকটা কলা ছুঁড়ে দিলেন বাঁদরের দিকে। হাতও দু'টো - কলাও দু'টো। অগত্যা বাঁদর চশমাটা পাশে নামিয়ে রেখে দু'হাত দিয়ে দু'টো কলা ধরে নিল। এরপর ভদ্রলোক বাঁদরটাকে একটু তাড়া করতেই সে কলা নিয়ে পালিয়ে গেল আর ভদ্রলোক চশমাটা উদ্ধার করে আমাদের হাতে তুলে দিলেন। আমরা তাঁকে 'ধন্যবাদ' দিলাম ঠিকই, কিন্তু তিনি যেরকম ভাবলেশহীন মুখ করে এসেছিলেন, সেভাবেই ফিরে গেলেন। আমি জানি বাঁদরের এরকম উৎপাত আমাদের দেশেও বিভিন্ন জায়গায় আছে। কিন্তু পার্থক্য হল সেখানে বাঁদরদের এই বাঁদরামিগুলো করানোর জন্য প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় যাতে বস্তু পুনরুদ্ধার করে এইজাতীয় লোকেরা অর্থোপার্জন করতে পারে !

কুম্ভকর্ণের মূর্তি
বাঁদরকান্ডের পরে মন্দির থেকে নিচে নেমে এসে একটা কুম্ভকর্ণের মূর্তি দেখতে পেলাম। রামায়ণের কুম্ভকর্ণের গল্প সবারই জানা আর আমাদের চারপাশের কিছু কিছু মানুষকে আমরা এখনও এই রাক্ষসের সঙ্গে সঙ্গত কারণেই তুলনা করি। কিন্তু কুম্ভকর্ণের কোনও মূর্তি আমি কখনও কোথাও দেখিনি। আমাদের দেশে আছে কিনা, তাও জানি না। এখানে আছে আর সেই মূর্তিকে চারদিক থেকে অনেকগুলো বাঁদর আক্রমণ করেছে (না, আসল নয়)। মূর্তি দেখে আমরা বেরিয়ে এলাম উলুওয়াটু মন্দির থেকে। না, আর কোনও বাঁদরের আক্রমণের মধ্যে পড়তে হয়নি। উলুওয়াটু মন্দিরের এই জঙ্গলে প্রায় ৪০০ বাঁদর আছে আর এখানকার কর্তৃপক্ষ এদের রীতিমতো লালনপালন করেন।

মন্দির থেকে বেরিয়ে একটা বসার জায়গায় বসে আমরা লাঞ্চ সেরে নিলাম। তারপর আড়াইটে নাগাদ রওনা দিলাম আমাদের পরবর্তী গন্তব্যের দিকে।

ব্লু-পয়েন্ট বীচ্‌ (অবশ্য দ্রষ্টব্য) -

ঢোকার টিকিট - লাগে না

ব্লু-পয়েন্ট বীচ্‌
উলুওয়াটু মন্দির থেকে মিনিট পনেরো চলার পরে আমরা পৌঁছলাম ব্লু-পয়েন্ট বীচে। এখানেও একটা পাহাড়ের পাশে বীচ্‌। গাড়ি আমাদের যেখানে নামাল, সেখান থেকে বীচে পৌঁছতে গেলে অনেকটা রাস্তা সিঁড়ি দিয়ে নামতে হয়। এই সিঁড়ির দুপাশে পাহাড়ের গায়ে ধাপে ধাপে অজস্র হোটেল রেস্ট্যুরেন্ট আর দোকান গজিয়ে উঠেছে। আমরা সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে একেবারে বীচে যেখানে পৌঁছলাম, সেখানে বীচ্‌টা ঠিক খোলা জায়গায় নয়। বরং মনে হতে পারে আমরা পাহাড়ের মধ্যে একটা বিশাল গুহার ভিতর থেকে বেরিয়ে এসে সমুদ্রের ধারে চলে এসেছি। এখানে স্নানার্থিদের প্রচন্ড ভীড় আর জলটাও স্নানের একেবারে উপযুক্ত। পাহাড়ের খাঁজের মধ্যে হওয়ায় ঢেউও খুব বেশি। এখানে প্রচুর লোক সার্ফ বোর্ড নিয়ে জলে নামে। বলা বাহুল্য, ইউরোপিয়ান আর আমেরিকানই বেশি। আমাদের স্নান করার বাসনা ছিল না, শুধু কথা-কলি বায়না করে হাঁটু জল পর্যন্ত নামল আর কিছুক্ষণের মধ্যেই ফ্রক্‌টা কোমর পর্যন্ত ভিজিয়ে ফেলল ! যাই হোক, বীচটা খুব সুন্দর আর এরকম পাহাড়ের গুহার মধ্যে থেকে সমুদ্রের জল আমি এর আগে কখনও দেখিনি।

বীচ্‌ থেকে উপরে উঠে এসে গাড়িতে বসে এগিয়ে গেলাম আমাদের পরবর্তী গন্তব্যের দিকে।

পেডাং পেডাং বীচ্‌ -
ঢোকার টিকিট - লাগে না

পেডাং পেডাং বীচ্‌
ব্লু-পয়েন্ট বীচ্‌ থেকে মিনিট দশেক গাড়িতে চলার পরে পেডাং পেডাং বীচ্‌। রাস্তা দিয়ে গাড়ি চলার পথ থেকেই এই বীচ্‌টা দেখতে পাওয়া যায়, রাস্তা থেকে বেশ কিছুটা নিচে। বীচ্‌টা দেখে মনে হল এটা কাছ থেকে দেখার খুব একটা দরকার নেই, তাই আমরা এই বীচে যাব না ঠিক করলাম। এগিয়ে চললাম আমাদের পরবর্তী গন্তব্যের দিকে।

গরুড়া বিষ্ণু কেনক্যানা বা জি ডব্লু কে স্ট্যাচু (অবশ্য দ্রষ্টব্য) -
ঢোকার টিকিট - বড়দের মাথাপিছু ১২৫,০০০/- রুপিয়া আর ছোটদের মাথাপিছু ১০০,০০০/- রুপিয়া।

পেডাং পেডাং বীচ্‌ থেকে আধঘন্টা চলার পরে আমরা পৌঁছলাম বালির সাইট সিয়িং-এর সবথেকে বেশি বিখ্যাত জায়গা - গরুড়া বিষ্ণু কেনক্যানা স্টাচু। এই সেই স্ট্যাচু যা প্লেন নামার সময়ে দেখা যায়, প্লেন থেকে নেমে টার্মিনাস বিল্ডিং-এ ঢোকার সময়ে দেখা যায়, আমাদের হোটেলের ছাদ থেকে দেখা যায়, কুটার আর নুসা দুয়ার বিভিন্ন জায়গা থেকে দেখা যায়। এর উচ্চতা আর বিশালত্বই এর প্রধান বিশেষত্ব।

গরুড়া বিষ্ণুতে যাওয়ার গাড়ি
একটা সুবিশাল চত্বর জুড়ে এই জায়গাটা তৈরি হয়েছে। আমাদের গাড়ি আমাদের পার্কিং লটে ছেড়ে দিল। সেখান থেকে এদের গাড়ি আমাদের নিয়ে গেল ভিতরে। এদের এই গাড়িগুলো বেশ নতুন ধরনের - একেকটা গাড়িতে দু'টো করে চারদিক খোলা বগির মতো। গাড়িগুলো সম্ভবতঃ ইলেকট্রিকে চলে। এই গাড়ি আমাদের টিকিট কাউন্টারের সামনে ছেড়ে দিল।

কাশ্যপ, কদ্রু ও বিনতার মূর্তি
এখানে মহর্ষি কাশ্যপ, কদ্রু আর বিনতার মূর্তি রয়েছে। টিকিট কাউন্টার থেকে আমরা টিকিট কেটে সামান্য ঢালুপথে উপরে ওঠা শুরু করলাম। জায়গাটায় বেশ ভালোই ভীড় হয়েছে। শুধু যে বিদেশী পর্যটক আছে তা নয়, বেশ কিছু লোকজনকে দেখে মনে হচ্ছিল তারা বালিরই বাসিন্দা। জায়গায় জায়গায় ম্যাপ লাগানো রয়েছে, সেই ম্যাপ দেখে আমরা এগিয়ে চললাম আমাদের গন্তব্যের দিকে।

গরুড়া বিষ্ণু (যদিও এদের স্থানীয় বানানে বিষ্ণু লেখা হয় ডব্লু দিয়ে অর্থাৎ উচ্চারণটা হবে উইষ্ণু) হল বাহন গরুরের পিঠে বিষ্ণুর মূর্তি। এখানে প্রধানতঃ তিনটে মূর্তি আছে - প্লাজা গরুড়া (অর্থাৎ গরুড়ের মূর্তি), প্লাজা বিষ্ণু (অর্থাৎ বিষ্ণুর মূর্তি) আর গরুড়া বিষ্ণু (গরুড় আর বিষ্ণুর যৌথ মূর্তি)।



ভিতরে ঢোকার জায়গা
পুরো জায়গাটা ভীষণ সুন্দরভাবে পরিকল্পনামাফিক তৈরি। ভিতরে ঢোকার জায়গাটায় আবার রাম, লক্ষণ, সীতা, রাবণ, ইন্দ্রজিৎ, বিভীষণ-দের মূর্তি রয়েছে। এগুলো বেশি বড় নয়। এরপর ভিতরে ঢুকে একটা জায়গায় দেওয়ালে কদ্রু আর বিনতার ডিম থেকে শুরু গরুড়ের বিষ্ণুর বাহন হওয়া পর্যন্ত পুরো গল্পটা মডেলের সাহায্যে বলা হয়েছে। সেইসঙ্গে অবশ্য ইংরিজীতে পুরো গল্পটা লেখাও রয়েছে। এই মডেল থেকে কিছুটা এগোলে টিকিট চেকিং-এর জায়গা। সেটা পেরোনোর পরে সিঁড়ি বা লিফ্‌টের সাহায্যে উপরে উঠতে হয়। দোতলায় উঠলে প্লাজা গরুড়া আর তিনতলায় উঠলে প্লাজা বিষ্ণু। আমরা প্রথমে দোতলায় উঠে প্লাজা গরুড়ার দিকে এগোলাম।

প্লাজা গরুড়া
একটা মাঠের মতো জায়গায় এই প্লাজা গরুড়াটা রয়েছে। জিনিসটা আসলে লৌহনির্মিত আর ভিতরটা ফাঁপা। পিছনের একটা লোহার খাঁচার সাহায্যে জিনিসটা আটকানো আছে। আমরা যখন এই প্লাজা গরুড়াটা দেখছি, তখন এদের এখানে একটা অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেল। কিছুক্ষণ দেখার পরে বুঝলাম এরা এই কদ্রু-বিনতা-কাশ্যপ থেকে শুরু করে গরুড়ের বিষ্ণুর বাহন হওয়া পর্যন্ত পুরো গল্পটারই একটা নৃত্যনাট্য গোছের করছে। আমরা কিছুক্ষণ এগুলো দেখে তিনতলায় প্লাজা বিষ্ণু দেখতে গেলাম।

প্লাজা বিষ্ণু
স্বাভাবিক কারণেই বিষ্ণুর মূর্তিটা গরুড়ের থেকে বড়। এই প্লাজা বিষ্ণুটা একটা ছাদের মতো জায়গার উপরে আর এখান থেকে বহুদূরের দৃশ্য দেখতে পাওয়া যায়। বেশ কিছুটা দূরে নুসা দুয়া এলাকার একটা বীচ্‌ দেখা যায় (পরে জেনেছিলাম ওটা জিম্বারান বীচ্‌) আর তারও পরে আরও দূরে কুটা এলাকাটাও দেখা যায়। বিকেল প্রায় সাড়ে পাঁচটা বাজে, তাই আমরা এখানে আর সময় নষ্ট না করে এগিয়ে গেলাম আসল স্ট্যাচু অর্থাৎ গরুর ও বিষ্ণুর মিলিত স্ট্যাচুটার দিকে (আমাদের যাওয়ার একটু ভুল ছিল। আমাদের উচিৎ ছিল আগে প্লাজা বিষ্ণু দেখে তারপরে প্লাজা গরুড়া দেখা আর সবশেষে গরুড়া বিষ্ণুর দিকে যাওয়া। এতে সময় আর পরিশ্রম দু'টোই কম লাগত।




গরুড়া বিষ্ণু
যাই হোক, যেখানে নৃত্যনাট্য হচ্ছিল, তার পাশ দিয়েই গরুড়া বিষ্ণুর স্ট্যাচুটার দিকে যেতে হয়। স্ট্যাচুর দিকে কিছুটা এগিয়ে যেতে যেতে বুঝলাম মূল স্ট্যাচুটার কাছে পৌঁছতে গেলে আমাদের অনেকটা হাঁটতে হবে। আর স্ট্যাচুটাও এখান থেকে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছিল, তাই সামনে আর না এগিয়ে এবার ফেরার পথ ধরলাম। পুরো জায়গাটাই পাহাড় কেটে তৈরি হয়েছে। পাহাড় কেটে কোনও জায়গা তৈরি হয়েছে দেখলে আমাদের দেশের ইলোরার কৈলাস মন্দিরের কথা মনে পড়েই যায়। এটা বলতেই হবে ৬০০ সালের ছেনি-হাতুড়ির কাজের সঙ্গে ২০১৮ সালের ডিনামাইটের কাজের কোনও তুলনাই হয়না আর সেই কারণে তুলনাটা সমীচীনও নয়।

ভিতরে ঢোকার জায়গাটায় পৌঁছনোর পরে একটা ইলেকট্রিক গাড়ি আমাদের নিচে টিকিট কাউন্টারের সামনে পৌঁছে দিল। সেখান থেকে আরেকটা গাড়ি আমাদের পার্কিং লটে নিয়ে এল। আর তারপর আমাদের গাড়ি আমাদের নিয়ে রওনা দিল আমাদের পরবর্তী তথা দিনের শেষ তথা বালি ভ্রমণের শেষ গন্তব্যের দিকে।

জিম্বারান বীচ্‌ -
ঢোকার টিকিট - লাগে না

জিম্বারান বীচে ওপেন এয়ার রেস্ট্যুরেন্ট
গরুড়া বিষ্ণু থেকে বেরিয়ে মিনিট পনেরো চলার পরে আমরা পৌঁছলাম জিম্বারান বীচে। এই বীচ্‌টার সঙ্গে আমাদের প্রথমদিনের দেখা কুটা বীচের কিছুটা মিল আছে। তবে প্রধান পার্থক্য হল এখানে বীচের উপর অনেকগুলো ওপেন এয়ার রেস্ট্যুরেন্ট আছে। অজস্র চেয়ার টেবিল পাতা রয়েছে আর সেইসঙ্গে পুরো বীচ্‌টা আলো দিয়ে সাজানো হয়েছে। সূর্যাস্ত হয়ে গেছে, দিনের আলো কমে এসেছে। এই সময়ে এই আলোকসজ্জিত বীচ্‌টা দেখতে খুব সুন্দর লাগছিল। জিম্বারান বীচ্‌ ডিনারের জন্য বিখ্যাত - অনেকেই সন্ধ্যের পরে এখানে এসে রাতের খাবার খায়। আমরা অবশ্য ডিনার করিনি, কিছুক্ষণ এখানে কাটিয়ে ফেরার পথ ধরলাম।

জিম্বারান বীচ্‌ থেকে আমাদের হোটেলে ফিরতে আধঘন্টা মতো লাগল। ফিরে এসে আবার সেই চিকেন সসেজ কিনা আনা হল। সেইসঙ্গে আমাদের হোটেল থেকে মিনিট তিনেকের হাঁটাপথে একটা রেস্ট্যুরেন্ট খুঁজে বের করলাম যেখানে বেশ লাঞ্চ বা ডিনারের জন্য নানারকম স্থানীয় সুখাদ্য পাওয়া যায়। আমরা ডিনারের জন্য এখান থেকে চিকেন ভাত আর পর্ক ভাত কিনে নিলাম। খরচ হল ১২৫,০০০/- রুপিয়া।

পরেরদিন শনিবার ১৫ই অক্টোবর, ২০২২ - বালিতে আমাদের শেষদিন। আমাদের বালির সাইট সিয়িং শেষ - গত তিনদিনে আমরা বিখ্যাত জায়গাগুলোর প্রায় সবই দেখে নিয়েছি। দু'টো জায়গা দেখা হয়নি যাদের নাম 'উলুন দানু বেরাতান টেম্পল্‌' আর 'তানহা লট্‌ টেম্পল্‌'। কিছু করার নেই, আমাদের হাতে শুধু একটা দিনই আছে আর এই একদিনে যদি ওগুলো দেখতে যাই তাহলে সারাদিনটা ওতেই চলে যাবে। তাই ওই দুটো জায়গা পরের বারের জন্য রেখে দেওয়া হল !

হোটেলের সুইমিং পুলে কথা কলির সঙ্গে লেখক
হোটেলে ব্রেকফাস্ট করে সকাল সাড়ে দশটা নাগাদ আমি আর কথা কলি ছাদে গিয়ে সুইমিং পুলে নামলাম (এই সুইমিং পুলে নামাটাও সাইট সিয়িং-এ না যাওয়ার একটা কারণ। কথা কলিকে প্রথমদিনই বলে রেখেছিলাম আমরা একদিন এই পুলে নামব)। জলটা দারুণ পরিষ্কার, সাঁতার কাটতে খুবই ভালো লাগছিল। কথা কলি মোটামুটি সাঁতার শিখেছে। ওরা এর আগে কখনও কোনও হোটেলের সুইমিং পুলে নামেনি, তাই ওদের উৎসাহ দেখার মতো। প্রায় ঘন্টাদুয়েক আমরা সুইমিং পুলের জলে দাপাদাপি করে ঘরে এসে স্নান করে নিলাম (সৌভাগ্যক্রমে এই পুরো সময়টায় হোটেলের অন্য কোনও অতিথি সুইমিং পুলে নামেনি !)। তারপর আগেরদিন রাতের রেস্ট্যুরেন্টটা থেকে চিকেন ভাত আর আর পর্ক ভাত নিয়ে নেওয়া হল। খরচ হল ৮৭,০০০/- রুপিয়া।

কুটা মার্কেট
দুপুরে হোটেলের ঘরে কিছুক্ষণ বিশ্রাম করে বিকেল পাঁচটা নাগাদ আমরা বেরোলাম মার্কেটিং করতে। বেড়াতে এসে এটা করতেই হয়, যদিও আমি ব্যক্তিগতভাবে এটা আদৌ পছন্দ করি না। তবে বিদেশে বেড়াতে এসে আত্মীয়স্বজনের জন্য কিছু উপহার না নিয়ে যাওয়াটা ভালো দেখায় না, তাই কুটা মার্কেট থেকে কিছু জিনিসপত্র কিনে নেওয়া হল। সাতটা নাগাদ আবার হোটেলে ফিরে এসে সকালের সেই একই রেস্ট্যুরেন্ট থেকে ডিনার কিনে নেওয়া হল। খরচ হল ৯০,০০০/- রুপিয়া। সেইসঙ্গে আমাদের হোটেলের কাছের ম্যাক্‌ডোনাল্ডস্‌টা থেকে ছ'টা চিকেন বার্গার নিয়ে নেওয়া হল পরেরদিনের ব্রেকফাস্টের জন্য। দাম নিল ১১৩,০০০/- রুপিয়া।

আমাদের বালি ভ্রমণ এখানেই শেষ, সেইসঙ্গে শেষ আমাদের সঙ্গের রুপিয়াও (আমি এইভাবেই হিসেব করে খরচ করে থাকি)। আমাদের ফ্লাইট পরেরদিন সকাল সাতটায়, তাই অন্ততঃ চারটের মধ্যে এয়ারপোর্টে পৌঁছতে হবে। সেইজন্য আমরা তাড়াতাড়ি ডিনার করে ন'টার মধ্যে শুয়ে পড়লাম।

রবিবার ১৬ই অক্টোবর, ২০২২ - আমরা হোটেল থেকে চেক্‌ আউট করে বেরোলাম তখন রাত তিনটে কুড়ি। হোটেলের গাড়ি আমাদের এয়ারপোর্টে পৌঁছে দিল, চার্জ নিল ২০০,০০০/- রুপিয়া (এমনিতে এদের এয়ারপোর্ট ড্রপ্‌ রেট ১০০,০০০/- রুপিয়া, কিন্তু আরও ১০০,০০০/- রুপিয়া বেশি নিল 'আর্লি মর্নিং ড্রপ' বলে)। অত রাতে রাস্তাঘাট একেবারেই ফাঁকা, আমরা দশমিনিটের মধ্যে এয়ারপোর্টে পৌঁছে গেলাম গুরাহ রাই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে।

বালি এয়ারপোর্ট থেকে দূরে গরুড়া বিষ্ণু
এরপর চেক্‌ ইন করে প্রায় ঘন্টা তিনেকের অপেক্ষা। এই এয়ারপোর্টের একটা বিচ্ছিরি ব্যাপার হল এখানে পানীয় জলের কোনও ব্যবস্থা নেই এবং সিকিউরিটি চেকিং-এর সময়ে জল নিয়ে ঢুকতেও দেয় না। আমি দেশে-বিদেশে অনেক এয়ারপোর্টেই গেছি, কিন্তু জল না পাওয়ার অভিজ্ঞতা এর আগে কোথাও হয়নি। তাই অনেক বেশি দাম দিয়ে আমাদের জল কিনতে হল। প্লেন ছাড়ল সকাল ৭ঃ০৫ মিনিটে আর কুয়ালালামপুর পৌঁছল সকাল ১০টায়। এয়ারপোর্টে পৌঁছে আমরা সঙ্গে থাকা বার্গারগুলোর সদ্ব্যবহার করে ফেললাম।

কুয়ালালামপুর এয়ারপোর্টে
কুয়ালালামপুর এয়ারপোর্টে আমি এর আগেও গেছি - জায়গাটা বিইইশাল বড়। আর তেমনি এখানে সিকিউরিটি চেকিং-এর বাড়াবাড়ি ! এখানে আমাদের লে-ওভার ছিল ১২ ঘন্টা ৩৫ মিনিটের (এয়ার এশিয়া হঠাৎ ফ্লাইট পরিবর্তন করে দেওয়াতেই আমাদের এই দুর্ভোগ !)। এয়ারপোর্ট জায়গাটা এমনিতে খারাপ নয়, কিন্তু ১২ ঘন্টার বেশি বসে থাকাটা বেশ বিরক্তিকর। সারাদিনের খাওয়াদাওয়ার পিছনে আমাদের খরচ হল ১০৯.২০ রিঙ্গিট (ভারতীয় মুদ্রায় ১৯৬৬/- টাকার মতো)। যাই হোক, দীর্ঘ অপেক্ষার অবসানের পরে রাত ১০ঃ৩৫ মিনিটে আমরা কলকাতাগামী প্লেনে চড়ে বসলাম। সোমবার ১৭ই অক্টোবর, ২০২২ রাত ১২ঃ১০ মিনিটে আমরা পৌঁছে গেলাম আমাদের প্রিয় শহরে। আর তারপর ট্যাক্সি ধরে বাড়ি পৌঁছলাম তখন রাত প্রায় ১টা। ভ্রমণ শেষ !

সারসংক্ষেপঃ

১. কলকাতা থেকে ৪ - ৫ দিন ঘোরার জন্য বালি একটা বেশ ভালো জায়গা। বিশেষ করে মধুচন্দ্রিমা যাপনের জন্য গত কয়েক বছর ধরে বালি বাঙালিদের মধ্যে বিশেষ গুরুত্ব অর্জন করেছে।

২. কলকাতা থেকে বালির সরাসরি ফ্লাইট নেই, সাধারণতঃ ব্যাঙ্কক বা কুয়ালালামপুরে লে-ওভার থাকে। লে-ওভারের সময়টা বাদ দিলে মোট উড়ান সময় (টোটাল ফ্লাইং টাইম) প্রায় সাতঘন্টার মতো।

৩. বালিতে থাকার জায়গাগুলোর মধ্যে কুটা, সেমিন্যাক, নুসা দুয়া এইসব জায়গাগুলো বিখ্যাত। এগুলোর প্রত্যেকটাতেই কাছাকাছির মধ্যে একাধিক বীচ্‌ রয়েছে। কুটার অতিরিক্ত সুবিধে হল জায়গাটা এয়ারপোর্ট থেকে খুব কাছে।

৪. বালি পর্যটনের জন্যই বিখ্যাত, তাই এখানে সব জায়গাতেই অজস্র হোটেল আছে। আমাদের হোটেল জিয়া কুটা বেশ সস্তা এবং দারুণ। বিভিন্ন অন্‌লাইন বুকিং সাইট যেমন tripadvisormakemytrip ইত্যাদি জায়গা থেকে এদের বুকিং করা যায়। যোগাযোগের নম্বর - +62361758811, ইমেল - rsv@ziakutahotel.com.

৫. হোটেল জিয়ায় বাফেট ব্রেকফাস্টের ব্যবস্থা আছে, যদিও লাঞ্চ বা ডিনারের ব্যবস্থা সেভাবে নেই। ব্রেকফাস্টের মেনুতে অনেক পদ আছে, যদিও দাম কিছুটা বেশি।

৬. হোটেল জিয়া থেকে কুটা বীচ্‌ হাঁটাপথে মিনিট দশেক। এই বীচ্‌ স্নান করার জন্য খুবই উপযোগী।

৭. কুটার এই অঞ্চলটা বহুসংখ্যক হোটেল আর রেস্ট্যুরেন্টে সমৃদ্ধ। এইসব হোটেল আর রেস্ট্যুরেন্টে বিভিন্ন বাজেটের বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন ধরনের খাবারদাবার পাওয়া যায়।

৮. বালিতে খাওয়াদাওয়ার কোনও সমস্যা হওয়ার কথা নয়, কারণ এখানে ভাত চিকেন ইত্যাদি সবই পাওয়া যায়। যারা পরীক্ষামূলক খাবারদাবার খেতে পছন্দ করে, তাদের জন্যও এখানে অনেক অপ্‌শন রয়েছে। তবে একেবারে আদ্যন্ত নিরামিষাশী হলে কোনও উপায় আছে কিনা সেটা আমার জানা নেই।

৯. কুটার এই অঞ্চলে বেশ কিছু দোকানপাট আছে যেখান থেকে মার্কেটিং করা যেতে পারে। মার্কেটিং-এর ব্যাপারে মোটামুটি নিয়ম হল দোকানদার যা দাম বলছে, তার অর্ধেক দাম থেকে শুরু করতে হবে।

১০. বালিতে সাইট সিয়িং-এর জন্য তিনদিন হাতে রাখতেই হবে, চারদিন রাখতে পারলে আরও ভালো। এখানে ঘোরার অনেকগুলো ভালো ভালো জায়গা আছে, তার মধ্যে বেশ কয়েকটা অবশ্য দ্রষ্টব্য।

১১. সাইট সিয়িং-এর ঘোরার জন্য গাড়িই একমাত্র ভরসা। এখানে ছোট গাড়ি সেভাবে পাওয়া যায় না, কমপক্ষে ছ'সিটের গাড়িই নিতে হয়। তাছাড়া বড় দলে গেলে আরও বড় গাড়িরও ব্যবস্থা আছে।

১২. বালিতে বছরের যেকোনও সময়েই যাওয়া যেতে পারে কারণ নিরক্ষীয় অঞ্চলে হওয়ার কারণে এখানে সারা বছরই আবহাওয়া প্রায় একইরকম থাকে। তবে ডিসেম্বর মাসে ছুটি থাকার কারণে এখানে ইউরোপিয়ান আর আমেরিকানদের ভীড় বেশি হয়, তাই পারলে সেই সময়টা এড়িয়ে যাওয়াই ভালো।

উপসংহারঃ

হোটেলের ছাদ থেকে কুটার প্যানোরমিক ভিউ
১৭,০০০ এরও বেশি ছোট বড় দ্বীপ নিয়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় অবস্থিত দেশ ইন্দোনেশিয়া আর তার মধ্যে একটা দ্বীপ হল বালি। একদিকে ভারত মহাসাগর আর অন্যদিকে জাভা সমুদ্রের মাঝখানে অবস্থিত এই দ্বীপে বেশ কিছু ছোট ছোট পাহাড় থাকায় এবং তাদের মধ্যে কয়েকটা পাহাড় সমুদ্রের একেবারে পাশে হওয়ায় বেশ কিছু অত্যন্ত মনোরম প্রাকৃতিক দৃশ্যপটের সৃষ্টি হয়েছে। প্রকৃতি যেন নিজেই এখানে সৃষ্টির কারিগর। তার সঙ্গে যোগ হয়েছে মানুষের অসাধারণ শিল্পনৈপুণ্য। আর এই দুয়ের মেলবন্ধন হলে যা হয় তাকেই বোধহয় মাস্টারপিস্‌ বলে। পুরো বালি দ্বীপ জুড়ে এইরকম রাশি রাশি মাস্টারপিস্‌ ছড়িয়ে রয়েছে। বালির অর্থনীতি প্রধানতঃ পর্যটননির্ভর আর এখানকার মানুষজন অত্যন্ত অতিথিবৎসল। আমরা আমাদের ভ্রমণকালে যতজন মানুষের সংস্পর্শে এসেছি, প্রত্যেকের কাছ থেকে অত্যন্ত অমায়িক ব্যবহার পেয়েছি। সুন্দর শহর, সুন্দর রাস্তাঘাট, সুন্দর মানুষ - মনের মধ্যে এইগুলোরই রেশ থেকে যায়। তাই এর স্বাদ পেতে গেলে যেতে হবে বালি - ইন্দোনেশিয়ার বালি !

বালি ভ্রমণের আরও ছবি দেখতে হলে click here.