আমি ব্লগ লেখার খুব বেশি সমর্থক কোনওদিনও ছিলাম না, সত্যি কথা বলতে কি এখনও যে আছি তা নয় । তার একটা প্রধান কারণ আমার ধারণা ব্লগ লেখার থেকেও পড়া অনেক বেশি ক্লান্তিকর । অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, অনেক সময়ই পড়তে শুরু করে শেষ করা হয়ে ওঠে না । নিজের ধৈর্য এবং/অথবা আগ্রহের অভাবকে 'ঠিক আছে, বাকিটা পরে পড়ব' জাতীয় অজুহাত দিয়ে ঢেকে দিই - আর আমরা সবাই জানি সেই 'পরে' টা আর কখনওই আসে না । তো, এই কারণে আমি ঠিক করেছি আমার ব্লগকে কখনওই অন্যের ক্লান্তির কারণ ঘটাব না, আমার ব্লগের বিষয় হবে প্রধানতঃ ভ্রমণ । আমার মতো যেসব বাঙালিরা ঘুরতে ভালোবাসে, তাদের জন্য আমার ব্লগ হবে তথ্যের একটা উৎস । আমার নিজের একটা অভ্যেস আছে, কোনও জায়গায় বেড়াতে যাওয়ার আগে সেই জায়গাটা সম্পর্কে কিছুটা জেনে নেওয়ার চেষ্টা করি, আর ইন্টারনেট ঘাঁটতে গিয়ে আমার বরাবরই মনে হয়েছে যে ইন্টারনেটে লেখালেখি করার ব্যাপারে বাঙালিদের থেকে কুঁড়ে খুব কম শিক্ষিত জাতই আছে । আমার মতো যেসব বাঙালিরা আছে, যারা ইন্টারনেটে কোনো একটা ইংরিজীতে লেখা দেখলেই না পড়ার চেষ্টা করে, তাদের জন্য আমার ব্লগ সহায়ক হবে, এই বিশ্বাস নিয়ে শুরু করছি আমার ভ্রমণকাহিনী । আগেই বলে রাখি, আমি স্ট্যাটিসটিক্সের ছাত্র ছিলাম, তাই আমার ব্লগে তত্ত্বের থেকে তথ্যের দেখাই মিলবে বেশি ।

Tuesday, October 26, 2010

ব্যান্ডেল ভ্রমণ

বার একটা পোস্ট করার সময় হয়ে গেল । কারণটা সহজেই অনুমেয়, খুব সম্প্রতি ব্যান্ডেল ঘুরে এলাম আর আমার পরিকল্পনা অনুযায়ী আমার ভ্রমণসর্বস্ব ব্লগকে আপডেট্‌ করার সময় এসেছে ।

এবারে গেছিলাম ব্যান্ডেল । (জানি এটা বাজে দিলাম কারণ শিরোনাম দেখেই বোঝা যাচ্ছে গোবরডাঙ্গা যাইনি ! কিন্তু কিছু একটা দিয়ে শুরু করতেই হয়) কলকাতা থেকে একটা সারাদিন ঘোরার পক্ষে খুবই সুন্দর জায়গা । ২৬শে অক্টোবর ২০১০ সকালে একটা শিয়ালদহ-বর্ধমান লোকালে আমাদের যাত্রা শুরু । আমি আর অমৃতা । এছাড়া অন্যান্য অনেকরকমভাবেই ব্যান্ডেল পৌঁছনো যায় - হাওড়া থেকে ট্রেনে বা কলকাতা ও হাওড়ার বিভিন্ন জায়গা থেকে গাড়িতে । শিয়ালদহ-বর্ধমান লোকাল ব্যান্ডেল পৌঁছয় বেলা বারোটা নাগাদ । (এটা মনে করার কোনও কারণ নেই যে আমরা অনেক দেরি করে ফেলেছি) স্টেশন থেকেই বাস অটো রিক্সা পাওয়া যায় আর ব্যান্ডেল ঘোরার জন্য এদের শেষের দু'টোর থেকে ভালো আর কিছু হয় না ।

স্টেশন থেকে অটো ধরে প্রথমে গেলাম ব্যান্ডেল চার্চ । রাস্তার বিবরণ দেওয়ার মতো কিছু নেই - একটু মফঃসল জায়গার বাড়িঘর বা রাস্তাঘাট যেরকম হয়, ব্যান্ডেল তার থেকে আলাদা নয় । তবে জায়গাটার বয়স প্রায় পাঁচশ বছর, সেইজন্যই হয়তো কিছু অনেক পুরনো বাড়ি বা তাদের ভগ্নাবশেষ চোখে পড়ে । সবমিলিয়ে মন্দ নয় ।

এখানে যেটা উল্লেখ না করে পারছি না সেটা হচ্ছে ব্যান্ডেলে এখনও সেইসব অটোগুলোই চলে যেগুলো হাইকোর্টের নির্দেশে ইতিপূর্বেই বাতিল হয়ে গেছে । (খবরের কাগজের ভাষায় 'কাটা তেলের অটো') এটা তেমন উল্লেখযোগ্য কিছু নয় । যেটা উল্লেখযোগ্য সেটা হচ্ছে একটা অটোয় চালক ছাড়া ৮ (আট) জন যাত্রী বসে !!! সামনে চারজন আর পেছনে চারজন ! না, আমি কোনও বড় অটোর কথা বলছি না, কলকাতায় রাস্তা পেরোতে গেলে যেসব অটোগুলো কোমরের কাছে এসে ধাক্কা মারে আর যাদের দৌরাত্মে (পড়ুন বাঁদরামিতে) কলকাতার মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে, সেই ধরনের অটোর কথাই বলছি । অটোর সংখ্যা কম থাকার জন্যই হোক আর যে কারণেই হোক, মানুষ এই ধরনের কষ্টকর যাত্রা মুখ বুজে মেনেও নেয় !

ব্যান্ডেল চার্চ
ব্যান্ডেল চার্চ । স্টেশন থেকে মাথাপিছু অটোভাড়া ৬ টাকা । একেবারে চার্চের সামনেই নামায় । চার্চ প্রতিদিন সকাল ৮ টা থেকে বিকেল ৫ টা পর্যন্ত খোলা থাকে । বছরে শুধুমাত্র দু'দিন, ২৫ শে ডিসেম্বর ও ১ লা জানুয়ারী নিরাপত্তার জন্য বন্ধ থাকে । চার্চের ভেতরটা খুবই সুন্দর, পরিষ্কার ও শান্ত । ভেতরে কোনও জায়গাতেই ছবি তোলা নিষিদ্ধ নয় শুধুমাত্র উপাসনাগৃহের মধ্যে ছাড়া । বারান্দার সর্বত্রই যীশুর জীবনের নানাঘটনার ছবি - তার সঙ্গে অনেক তথ্য দেওয়া আছে । উপাসনাগৃহের ভেতরে দেওয়ালেও নানারকম ছবি ও লেখা । উপাসনাগৃহের সামনে একটা ছোট গোরস্থান - সেখানে সমাধিগুলো সম্ভবতঃ ব্যান্ডেল চার্চের ধর্মযাজকদের ।

চার্চের আরেকটা অত্যন্ত সুন্দর জায়গা হল ছাদ । অদ্ভুত সুন্দর একটা সিঁড়ি দিয়ে উঠতে হয় ছাদে । ছাদ থেকে ব্যান্ডেল শহরের অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যায় । চার্চের পাশেই গঙ্গা নদী - দেখতে খুব সুন্দর লাগে । ছাদে একটা ছোট ঘরের মতো আছে - সেখানে ব্যান্ডেল চার্চ সম্পর্কে অনেক তথ্য জানা যায় । এছাড়া আছে একটা ঘন্টাঘর । এখানে সাধারণ মানুষের পক্ষে যাওয়া সম্ভব নয় ।

ব্যান্ডেল চার্চের বাইরেই দু'একটা ভাতের হোটেল আছে - খুবই সাধারণ । খুব বেশি ভালো খাবারের জায়গা আশা করে লাভ নেই - এখানে কাছাকাছির মধ্যে সব এরকমই । আমরা মুরগির মাংস আর ভাত খেলাম । খরচ পড়ল মাথাপিছু ৬০ টাকা । খাবারের মান মোটামুটি ভালোই - সঠিক বিশেষণ হল 'আশানুরূপ' ।

ইমামবাড়া
খাওয়ার পর গেলাম আমাদের দ্বিতীয় গন্তব্য - ইমামবাড়া । এখানেও অটোয় যাওয়া যায়, কিন্তু দুপুরে সেটার জন্য খুব বেশি অপক্ষা না করে রিক্সাই নিয়ে নিলাম । রিক্সার আরেকটা সুবিধে হচ্ছে সেটা একেবারে ইমামবাড়ার সামনে নামায় - অটোয় গেলে শেষ ৫ মিনিট হাঁটতে হবে । রিক্সায় যেতে মিনিট ১০ সময় লাগল আর ভাড়া নিল ২০ টাকা । বিরাট মাপের ইমামবাড়া - প্রবেশমূল্য মাথাপিছু ৫ টাকা । ভেতরে একটা বিরাট জায়গা যার মাঝখানে একটা জলাশয় - যার মধ্যে একটা ফোয়ারা আছে যদিও সেটা কাজ করে কিনা জানিনা । ঢোকার পর সোজা যেখানে যাওয়া যায় সেখানে একটা দরবার ধরনের জায়গা আছে । ভেতরটা খুবই সুন্দর - রকমারি রঙের অনেকগুলো ঝাড়বাতি আছে । দরবারের ভেতর থেকে বেরিয়ে গেলাম ইমামবাড়ার পেছনে - গঙ্গার ধারে । এখানে একটা সূর্যঘড়ি বা sundial আছে - দুর্ভাগ্যক্রমে সেটার ব্যবহার ভালো করে বুঝতে পারিনি কারণ আকাশ মেঘলা ছিল । এখানে ইমামবাড়ার একটা বাগান আছে - সেটা দেখে মনে হয় নিয়মিত পরিচর্যা করা হয় ।

ইমামবাড়ার একটা বড় আকর্ষণ হল এর ঘন্টার ঘর । এটা দেখার জন্য সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠতে হয় । আর এই ওঠার সিঁড়ি পুরুষ ও মহিলাদের জন্য আলাদা । ওপরে উঠেও আলাদাই থাকে - সময়জ্ঞান আলাদা হওয়ার জন্যই কিনা জানিনা, পুরষ ও মহিলাদের ঘন্টাঘর বা ঘড়ির ঘর আলাদাভাবেই দেখতে হয় ।

ইমামবাড়া থেকে বেরিয়ে বড় রাস্তার উদ্দেশ্যে হাঁটতে শুরু করলাম । মিনিট পাঁচেক হাঁটার পর একটা চৌমাথায় এসে পৌঁছলাম - সেখান থেকে আমাদের তৃতীয় গন্তব্যে যাওয়ার জন্য অটো বা টাটা-ট্যাক্সি পাওয়া যায় । সামান্য সময় অপেক্ষা করার পর পেলাম ট্যাক্সি । আমাদের তৃতীয় গন্তব্য হংসেশ্বরী মন্দির - যেখানে যাওয়ার রাস্তা ব্যান্ডেল চার্চের পাশ দিয়েই ।

হংসেশ্বরী মন্দির
প্রায় মিনিট কুড়ি যাওয়ার পর যেখানে পৌঁছলাম আমাদের ড্রাইভার বলল সেখান থেকে হংসেশ্বরী মন্দির হেঁটে যাওয়া যায় । ট্যাক্সিভাড়া মাথাপিছু ৮ টাকা । সেই স্টপেজ থেকে ১০ মিনিট হেঁটে পৌঁছলাম হংসেশ্বরী মন্দির । মন্দির দুপুরে বন্ধ থাকে - খোলে বিকেল ৪ টেয় । এর ফলে আমাদের পক্ষে মন্দিরের ভেতরে ঢোকা সম্ভব হয়নি - বাইরে থেকে দেখেই সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে । পাশাপাশি দু'টো মন্দির - একটায় টেরাকোটার কাজ করা । চারপাশে আরও কিছু ভগ্নস্তূপ ছড়িয়ে আছে যা দেখে বোঝা যায় সেখানে একসময়ে কোনও বড় প্রাসাদ ছিল ।

ত্রিবেণী ঘাট
হংসেশ্বরী মন্দির থেকে একটা অটো ভাড়া করে গেলাম ত্রিবেণী - আমাদের চতুর্থ এবং শেষ গন্তব্য । ভাড়া নিল ৫০ টাকা । ত্রিবেণী দেখে বেশ হতাশ হতে হল । ত্রিবেণী সম্পর্কে আমাদের ধারণা ছিল এটা হচ্ছে মুক্তবেণী - যেখানে গঙ্গা যমুনা ও সরস্বতী আলাদা হয়েছে । কিন্তু ত্রিবেণীতে সেরকম কিছুই চোখে পড়ল না । গঙ্গার একটা সাদামাটা ঘাট যেখানে যাত্রীবাহী নৌকো চলাচল করে । ত্রিবেণীর ঘাট থেকে বাসস্টপেজে যাওয়ার পথে কিছু মন্দির চোখে পড়ল - যেগুলো সুন্দর দেখতে ।


ত্রিবেণীর বাসস্ট্যান্ডটা বেশ বড় - এখান থেকে বিভিন্ন জায়গায় যাওয়ার বাস রিক্সা অটো ট্যাক্সি সবই পাওয়া যায় । চাইলে গাড়ি ভাড়াও করা যেতে পারে । আমরা একটা অটোয় উঠলাম যেটা আমাদের ব্যান্ডেল চার্চের সামনে নামিয়ে দিল । ভাড়া মাথাপিছু ৮.৫০ টাকা । সেখান থেকে আরেকটা অটোয় স্টেশন । আমাদের ট্রেনের সময় ছিল দুপুর ৩ টে ৪১ মিনিট - ৩ টে ৩৭ মিনিটে আমরা ব্যান্ডেল স্টেশনে এসে পৌঁছলাম ।

সারসংক্ষেপঃ

১. কলকাতা থেকে একদিনের ঘোরার পক্ষে ব্যান্ডেল খুবই সুন্দর জায়গা - এর সবথেকে বড় সুবিধে হচ্ছে জায়গাটা খুব কাছে ।
২. কলকাতা থেকে বাসে ব্যান্ডেল যাওয়া যায়, চাইলে গাড়ি ভাড়া করেও যাওয়া যায় । তবে শিয়ালদহ বা হাওড়া থেকে ট্ট্রেনে যাওয়া খুবই সুবিধেজনক আর তার খরচও খুব কম ।
৩. ব্যান্ডেলে ঘোরার জায়গা বলতে প্রধানতঃ তিনটে - চার্চ, ইমামবাড়া আর হংসেশ্বরী মন্দির । কোনটা আগে আর কোনটা পরে দেখা উচিৎ এর কোনও নিয়ম নেই - তবে চার্চ বিকেল পাঁচটায় বন্ধ হয়ে যায় আর মন্দির দুপুরে বন্ধ থাকে । তাই সেইমতো হিসেব করে গেলে সবগুলোই দেখা যাবে ।
৪. ত্রিবেণীও একটা দেখার জায়গা - তবে জায়গাটা সম্পর্কে ভালো করে জেনে তবেই যাওয়া উচিৎ - না হলে দেখার মতো কিছু নাও পাওয়া যেতে পারে ।
৫. ব্যান্ডেলে খুব ভালো খাওয়ার জায়গা পাওয়ার আশা না করাই ভালো - যেগুলো আছে সবই মোটামুটি একইরকম । মাছ ডিম মাংস ভাত পাওয়া যাবে - আরসালান এর বিরিয়ানির দেখা মিলবে না ।

উপসংহারঃ

নৈহাটী-ব্যান্ডেল লোক্যাল
কলকাতা থেকে ঢিল ছোঁড়া দুরত্বে ব্যান্ডেল । ষোড়শ শতাব্দীতে শহর আর চার্চ তৈরি হয় যা তারপরবর্তীকালে আরও বড় ও উন্নত হয়েছে । এখানে একসময়ে ফরাসীদের উপনিবেশ ছিল । শহরে বহু প্রাচীন ঐতিহ্যের নিদর্শন বর্তমান । সাধারণ জায়গা - কিন্তু ঐতিহাসিক গুরুত্ব অসাধারণ । ট্যুরিস্ট স্পট - কিন্তু এখানকার মানুষের জীবনযাপন আটপৌরে । দেখার জায়গা বলতে একটা মন্দির, একটা মসজিদ আর একটা গির্জা - আর চারপাশে সর্বধর্মসমন্বিত মানুষের সহাবস্থান - এটাই হয়তো সাধারণ ব্যান্ডেলের অসাধারণ হয়ে ওঠার চাবিকাঠি ।


ব্যান্ডেল ভ্রমণের আরও ছবি দেখতে হলে click here:

Sunday, August 29, 2010

বক্‌খালি ভ্রমণ

বেড়ানোর তথ্যভান্ডার হিসেবে দেখাতে গেলে প্রথমেই যেটা করার দরকার হয় সেটা হচ্ছে সময়ের উল্লেখ, কারণ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে একটা জায়গার অনেক কিছুই বদলে যায়, বিশেষ করে জিনিসের দাম । তাই যদি বলে দিই আমি কোন  সময়ে গেছিলাম, তাহলে পরবর্তীকালে যারা এই লেখা follow করে যাবে (যদি আদৌ কেউ করে !) তাদের পক্ষে estimate করাটা সহজ হতে পারে ।

ডায়মন্ডহারবার
২৮শে আগস্ট, ২০১০ শনিবার সকালে আমরা বক্‌খালির উদ্দেশ্যে রওনা দিই । দলে আমি ছাড়া সব্যসাচী, অয়ন, সুমন, নৈঋতা আর কাকলি । সকাল সাড়ে ছটায় উল্টোডাঙ্গার হাডকোর মোড় থেকে একটা টাটা সুমোয় আমাদের যাত্রা শুরু । আমি আর সুমন ছাড়া সবাই হাডকো থেকেই উঠেছিল, আমরা যথাক্রমে হায়াত ও রুবির মোড় থেকে । এরপর E M Byepass কামালগাজীর মোড় নরেন্দ্রপুর হয়ে আমাদের গাড়ি বারুইপুর পর্যন্ত গেল । সেখান থেকে ভেতরের অলিগলি দিয়ে আমরা পৌঁছলাম আমতলায় । এই আমতলা পর্যন্ত যাওয়ার জন্য আরও পরিচিত রাস্তা আছে, সেটা খিদিরপুর থেকে ডায়মন্ডহারবার রোড ধরে যাওয়া যায় । কিন্তু সেই রাস্তায় যানজটের সম্ভাবনা বেশি, তাই আমাদের রাস্তাটাই শ্রেয় । এরপর আমতলা থেকে ডায়মন্ডহারবার রোড ধরে পৌঁছলাম ডায়মন্ডহারবারে । এখানে গাড়ি দাঁড়াল মিনিট পনেরো । চা খাওয়ার জায়গা আছে, চাইলে কিছু টিফিনও করে নেওয়া যেতে পারে, কারণ বক্‌খালি পৌঁছতে এখনও দেরি আছে । ডায়মন্ডহারবারের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য খুবই মনোরম, গঙ্গা এখানে বিশাল চওড়া, আর জলের মধ্যে ছোট ছোট নৌকো চলতে থাকে যা দেখতে খুব সুন্দর লাগে ।

নামখানা
এরপর আরও ঘন্টাখানেক চলার পর পড়বে নামখানা । কলকাতা থেকে নামখানা পর্যন্ত দুরত্ব ১৫০ কিমি - র সামান্য কিছু বেশি । এখানে vessel এ করে নদী পেরোতে হয় । সবমিলিয়ে ব্যাপারটা বেশ মজার, বাস লরি মারুতি সুমো সবকিছু জেটি থেকে সোজা vessel এ উঠে যায়, আর গোটা জিনিসটা সবকিছু সমেত নদীর অন্য পারে চলে যায় । সুমোর জন্য জেটির ভাড়া ৩০ টাকা আর vessel এর ভাড়া ১৬০ টাকা । দুটোই সরকার নির্ধারিত আর বিলও পাওয়া যায় । এর মধ্যে ৩০ টাকাটা আর ফেরার সময়ে দিতে হয় না, তবে তার জন্য বিলটা নিজের সঙ্গে রেখে দিতে হবে । এই নামখানায় প্রচুর মাছ ধরার ট্রলারকে দাঁড়িয়ে থাকতে বা চলতে দেখা যায় আর এখানে খুব টাটকা মাছ খুব সস্তায়ও পাওয়া যায় ।

নামখানা থেকে বক্‌খালির দুরত্ব ৩৫ - ৪০ কিমি - র মতো, আর এই রাস্তাটাও খুব সুন্দর । আমাদের ড্রাইভারের হাত খুব ভালো, একঘন্টার কমসময়ে আমরা বক্‌খালি পৌঁছে গেলাম । রাস্তার দু'পাশে কিছুটা দুরত্ব বজায় রেখে পরপর হোটেলগুলো আছে, আমাদের বুকিং ছিল 'ডলফিন হোটেল' এ, খুঁজে পেতে অসুবিধে হল না ।

ডলফিন হোটেল
হোটেলের বিবরণ খুব বিস্তারিত দিচ্ছি না, তবে এটুকু বলতে পারি ডলফিন বক্‌খালির ঘ্যাম হোটেলগুলোর একটা, আর তার Double Bed Non AC ঘরগুলোর ভাড়া ৫০০ টাকা (যদিও আমরা discount দিয়ে ৪০০ টাকায় পেয়েছিলাম) কিন্তু দেখে বুঝলাম ঘরগুলো থাকার পক্ষে উপযুক্ত নয় । বিশেষ করে যাদের বেড়াতে গিয়ে হোটেলের ঘর নিয়ে খুঁতখুঁতুনি থাকে তাদের পক্ষে এই ঘর বুক করা মোটেই ভালো সিদ্ধান্ত নয় । দোতলায় Double Bed AC আর তিনতলায় Double Bed AC Deluxe ঘর আছে, তবে চাইলে AC ব্যবহার না করে ভাড়া কমিয়ে অর্ধেক করে নেওয়া যায় ।

হোটেলের খাবার সবমিলিয়ে ভালো, আর খাবার জায়গাটাও ভালো । খাওয়ার পর আমরা গেলাম সমুদ্রে চান করতে । এখানে একটা খুব দরকারি তথ্য দেওয়ার আছে যেটায় আমরা ঠকেছি । কলকাতায় হোটেল বুকিং এর সময়ে আমাদের বলেছিল আমাদের হোটেল থেকে সমুদ্র হেঁটে ৫ মিনিট, যেটা সম্পূর্ণ বাজে কথা । প্রথমতঃ বক্‌খালিতে বিচের কাছে কোনও হোটেল নেই আর কোনও হোটেল থেকেই হেঁটে বিচে যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না । নিজের গাড়িতে না গেলে অন্য উপায় হচ্ছে লোকাল ভ্যান-এ যাওয়া । আর ডলফিন হোটেল থেকে গাড়িতে বিচে যেতে ৫ - ১০ মিনিট লাগবেই ।

সমুদ্র - ভাঁটার সময়ে
বিচ্‌টা বেশ সুন্দর তবে সমুদ্র দেখে হতাশ হলাম । আমরা সমুদ্রে গেছি দুপুর ৩ টে নাগাদ, সমুদ্রের জলে কোনও ঢেউ নেই । নেই মানে নেইই । দেখে কোনও বড় নদীর সঙ্গে পার্থক্য করা যায় না । মাঝখানে চরাও দেখা যায় । তখন সমুদ্রে ভাঁটা চলছে যদিও তাতে আমাদের উৎসাহে ভাঁটা পড়েনি, ওই ঢেউবিহীন সমদ্রেও ঘন্টা দুই দাপাদাপি করলাম । বাকি ব্যাপারটা গতানুগতিক, ভিজে বা আধ-শুকনো জামাকাপড় পরে হোটেলে ফেরা আর তারপর আরেক দফা চান করা ।

সন্ধ্যেবেলা আমরা আবার বিচে গেলাম । এবারও গাড়ি ছাড়া গতি নেই । বিচের কাছে হোটেল না থাকলেও বেশ কিছু খাওয়ার জায়গা আছে, সেরকমই একটা জায়গা থেকে সন্ধ্যের জলখাবার খেয়ে নেওয়া হল । খাবারের দাম বেশ সস্তাই, আর মানও খুব একটা ভালো কিছু নয় । আটটা চিকেন পকোড়ার প্লেট এর দাম ৬০ টাকা ।

এরপর সমুদ্রের ধারে গিয়ে বসলাম । সন্ধ্যেয় সমুদ্রের চেহারা দুপুরের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা । সন্ধ্যেবেলা জোয়ার ছিল, সেই সময়ে সমুদ্রকে দেখে সমুদ্রই মনে হয় । সমুদ্রের ধারে বসার জন্য চেয়ার পাওয়া যায় যার রেট ২০ টাকায় ৬ টা । সেই চেয়ারে মোটামুটি রাত দশটা পর্যন্ত বসে সমুদ্রের হাওয়া ও সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়, তারপর পুলিশ আর অনুমতি দেয় না । আর যদি হোটেলে খাওয়ার পরিকল্পনা না থাকে তাহলে এর চেয়ে বেশি দেরি করলে খাবার জায়গা খোলা নাও পাওয়া যেতে পারে । আমরা আমাদের সন্ধ্যের রেস্তোরাঁই রাতের খাবার খেয়ে নিলাম । সবাই মিলে রুটি চিলি-চিকেন ফ্রাইড রাইস চাউমিন অর্ডার দিয়ে ভাগ করে খাওয়া হল । বলা বাহুল্য, এই খাওয়ারও খরচ সেরকম বেশি কিছু না ।

এরপর হোটেলে ফিরে এসে শুয়ে পড়লাম । পরেরদিন সকালে সূর্যোদয় দেখার জন্য ছটায় যাওয়ার কথা ।

হেনরি আইল্যান্ড এর টাওয়ার থেকে
সকালে যথাসময়ে উঠে দেখলাম আকাশ মেঘে ঢাকা, তাই যাওয়ার কোনও প্রশ্নই ওঠে না । তার বদলে সাতটা নাগাদ বেরিয়ে গাড়ি করে গেলাম 'হেনরি আইল্যান্ড' (আমি জানি না কেন জায়গাটার নাম 'আইল্যান্ড' কারণ জায়গাটা মূল ভুখন্ডের সঙ্গেই যুক্ত) দেখতে । আমাদের হোটেল থেকে গাড়িতে মিনিট কুড়ি মতো সময় লাগে । জায়গাটা পশ্চিমবঙ্গ সরকারের মৎস্য প্রকল্পের জায়গা, এখানে ঢোকার সময়ে টিকিট লাগে, মাথাপিছু ৫ টাকা আর গাড়ির জন্য ১৫ টাকা । আমরা শুনেছিলাম ওখানে একটা টাওয়ার আছে যেটার ওপর থেকে চারপাশের অনেক কিছু দেখা যায় । সেটাই প্রধান আকর্ষণ । গেলাম দেখলাম এবং হতাশ হলাম । টাওয়ার মানে একটা তিনতলা বাড়ির ছাদ আর সেখান থেকে দেখার জায়গা বলতে দিগন্তবিস্তৃত জঙ্গল (যার মধ্যে কোনও বন্য জন্তু দেখতে পাওয়ার কোনও সম্ভাবনা নেই) আর বহুদূরের সমুদ্র । স্বাভাবিকভাবেই জায়গাটা দেখতে বেশি সময় লাগল না ।

সমুদ্র - ঠিক যেরকমটি চাই
এরপর নটা নাগাদ জলখাবার খেয়ে ঝাঁপ দিলাম সমুদ্রে । সেই সমুদ্র যার জন্য বক্‌খালি আসা, সেই সমুদ্র যাতে ঢেউ আছে, সেই সমুদ্র যার দেখা আমরা আগেরদিন দুপুরে পাইনি । আরও বহু মানুষ ছিল সমুদ্রে, সবাই মিলে চান করার মজাই আলাদা । যারা সমুদ্রে চান করেছে তাদের জন্য এই জিনিস ব্যাখ্যা করার দরকার হয় না, আর যারা করেনি তাদের জন্য করার মানে হয় না । ঘন্টা দুই মতো জলে থাকার পর প্রবল অনিচ্ছাসত্ত্বেও উঠতে হল - এটা আমার সবসময়ই হয় আর আমার বিশ্বাস আমার মতো আরও অনেকেরই হয় ।

এরপরের বিবরণ সংক্ষিপ্ত । হোটেলে গিয়ে দ্বিতীয়বারের চান করা আর তারপর হোটেল থেকে চেক্‌-আউট করে হোটেলেই খাওয়াদাওয়া করে নিলাম । তারপর ঠিক দুপুর একটার সময়ে গাড়ি করে ফেরার পথ ধরলাম । আমরা ফেরার সময়ে রাস্তায় কিছুটা জায়গায় প্রচন্ড বৃষ্টি পেয়েছিলাম, সেই বৃষ্টি এতই প্রবল যে একসময়ে গাড়ি থামানোরও উপক্রম হয়েছিল, যাই হোক শেষ পর্যন্ত সেটার আর দরকার হয়নি ।

ডায়মন্ডহারবার - ফেরার পথে
নামখানায় এসে আবার নদী পেরোনো আর তারপর সোজা ডায়মন্ডহারবার । এখানে মিনিট পনেরো বিরতি নিয়ে আবার যাত্রা । ঠিক সন্ধ্যে ছটায় আমরা আবার আমাদের প্রিয় শহর কলকাতায় ।








সারসংক্ষেপঃ

১. কলকাতা থেকে নামখানার দুরত্ব ১৫০ কিমির মতো, আর বকখালি ২০০ কিমির কিছু কম । আমরা ওখানকার সব ঘোরাঘুরি গাড়িতে করেছিলাম তাই আমাদের সব মিলিয়ে ৪৫০ কিমির মতো হয়েছিল ।
২. কলকাতা থেকে নামখানা ট্রেনে যাওয়া যায়, শিয়ালদা থেকে একটানা ট্রেনও আছে, তবে ছুটির দিন ছাড়া ট্রেনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়াটা ঠিক হবে না । কারণ, শিয়ালদা থেকে ট্রেনে বসে গেলে নিত্যযাত্রীরা বারুইপুরে উঠিয়ে দেবেই । ফলে মাঝের অনেকটা পথ মালপত্র নিয়ে দাঁড়িয়ে যেতে হতে পারে, যেটা মোটেই বেড়াতে যাওয়ার পক্ষে সুখকর নয় ।
৩. ধর্ম্মতলার বাসডিপো থেকে বক্‌খালির সরাসরি বাসও পাওয়া যায়, কম খরচে মোটামুটি আরামদায়কভাবে যাওয়ার জন্য এটাই সবচেয়ে ভালো উপায় ।
৪. বক্‌খালি থেকে 'হেনরি আইল্যান্ড' ছাড়াও দেখার জায়গা আছে 'কুমীর প্রকল্প', যেটা হোটেল থেকে সমুদ্রে যাওয়ার পথেই পড়ে । এখানে  কিছু কুমীর আর হরিণ আছে বলে শুনেছি, কিন্তু খুব বিস্তারিত কিছু বলতে পারছি না কারণ আমরা এখানে যাইনি ।
৫. এছাড়া দেখার জায়গা আছে 'জম্বুদ্বীপ' যেটা মূল ভুখন্ডের সঙ্গে যুক্ত নয়, বক্‌খালি থেকে গাড়িতে এক জায়গা পর্যন্ত গিয়ে তারপর লঞ্চে যেতে হয় । আমাদের হোটেল থেকে বলে দিয়েছিল বর্ষার সময়ে ওখানে না যাওয়াই ভালো কারণ দ্বীপের বিভিন্ন জায়গায় কাদা হয়ে থাকে আর লঞ্চের লোকেরা ইচ্ছে করে সেইরকম জায়গাতেই নামায় যেখানে লোকে বেশি ঘুরতে না পারে । তাই এই জায়গাতেও আমরা যাইনি ।
৬. বক্‌খালিতে থাকা বা খাওয়ার জন্য খুব হাই-ফাই হোটেল বা রেস্তোরাঁ আশা না করাই ভালো, করলে নিরাশ হতে হবে । মোটামুটি থাকা-খাওয়া যায় এরকম চলনসই জায়গা আছে, এইটুকু বলা যায় ।
৭. যাদের কেনাকাটা করার অভ্যেস আছে, তাদের জন্য বলছি, কেনাকাটা করার জন্য একমাত্র সমুদ্রের কাছে কিছু দোকান আছে, এছাড়া আর কোথাও কিছু নেই । দোকানের সংখ্যা খুবই কম আর হয়তো সেই কারণেই কোনওকিছুর দাম প্রায় কমানোই যায় না । যাই হোক, নিকট আত্মীয় বা বন্ধুদের দেওয়ার জন্য পছন্দমতো উপহার পাওয়া যেতে পারে ।

উপসংহারঃ


বক্‌খালি
দীঘা পুরী মন্দারমণি শঙ্করপুর তালসারী তাজপুর ঘুরে যাদের সমুদ্র দেখার জন্য কাছাকাছি অন্য কোথাও যেতে ইচ্ছে করে তাদের জন্য বক্‌খালি একটা option. বক্‌খালিতে সমুদ্র ছাড়া সেরকম কিছুই নেই, আমরা আশাও করিনি । একরাতের বেশি কাটানোর কোনও মানেও হয় না, সেই জন্য weekend trip হিসেবে মন্দ নয় । জায়গাটা খুব সাধারণ আর সেটাই এর অসাধারণত্ব । জায়গাটার একটা স্বাভাবিক সৌন্দর্য আছে, যেটা খুব জনবহুল জায়গায় কখনওই পাওয়া যায় না । দীঘা পুরী মন্দারমণির মতো ঘ্যাম নয়,  অল্প হোটেল-দোকান আর শান্ত নিরিবিলি পরিবেশ নিয়ে বক্‌খালি থাকুক বক্‌খালিতেই ।

বক্‌খালি ভ্রমণের আরও ছবি দেখতে হলে click here: