আমি ব্লগ লেখার খুব বেশি সমর্থক কোনওদিনও ছিলাম না, সত্যি কথা বলতে কি এখনও যে আছি তা নয় । তার একটা প্রধান কারণ আমার ধারণা ব্লগ লেখার থেকেও পড়া অনেক বেশি ক্লান্তিকর । অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, অনেক সময়ই পড়তে শুরু করে শেষ করা হয়ে ওঠে না । নিজের ধৈর্য এবং/অথবা আগ্রহের অভাবকে 'ঠিক আছে, বাকিটা পরে পড়ব' জাতীয় অজুহাত দিয়ে ঢেকে দিই - আর আমরা সবাই জানি সেই 'পরে' টা আর কখনওই আসে না । তো, এই কারণে আমি ঠিক করেছি আমার ব্লগকে কখনওই অন্যের ক্লান্তির কারণ ঘটাব না, আমার ব্লগের বিষয় হবে প্রধানতঃ ভ্রমণ । আমার মতো যেসব বাঙালিরা ঘুরতে ভালোবাসে, তাদের জন্য আমার ব্লগ হবে তথ্যের একটা উৎস । আমার নিজের একটা অভ্যেস আছে, কোনও জায়গায় বেড়াতে যাওয়ার আগে সেই জায়গাটা সম্পর্কে কিছুটা জেনে নেওয়ার চেষ্টা করি, আর ইন্টারনেট ঘাঁটতে গিয়ে আমার বরাবরই মনে হয়েছে যে ইন্টারনেটে লেখালেখি করার ব্যাপারে বাঙালিদের থেকে কুঁড়ে খুব কম শিক্ষিত জাতই আছে । আমার মতো যেসব বাঙালিরা আছে, যারা ইন্টারনেটে কোনো একটা ইংরিজীতে লেখা দেখলেই না পড়ার চেষ্টা করে, তাদের জন্য আমার ব্লগ সহায়ক হবে, এই বিশ্বাস নিয়ে শুরু করছি আমার ভ্রমণকাহিনী । আগেই বলে রাখি, আমি স্ট্যাটিসটিক্সের ছাত্র ছিলাম, তাই আমার ব্লগে তত্ত্বের থেকে তথ্যের দেখাই মিলবে বেশি ।

Sunday, March 25, 2012

কৃষ্ণনগর ভ্রমণ

কৃষ্ণনগর । কলকাতা থেকে রেলপথে দুরত্ব ঠিক ১০০ কিলোমিটার । আর সড়কপথে ১০৮ কিলোমিটার । মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের কৃষ্ণনগর । গোপালভাঁড়ের কৃষ্ণনগর । মাটির পুতুলের কৃষ্ণনগর । সরপুরিয়া-সরভাজার কৃষ্ণনগর । বাংলার ইতিহাসের পাতা থেকে উঠে আসা কৃষ্ণনগর । সেই কৃষ্ণনগর ভ্রমণ নিয়েই আমার ব্লগের এবারের পোস্ট ।

২৫ শে মার্চ, ২০১২ রবিবার সকালে একটা 'কৃষ্ণনগর সিটি জংশন' লোকাল ট্রেন ধরে আমরা গেছিলাম । সঙ্গী আমার স্ত্রী অমৃতা । সারাদিনে শিয়ালদহ থেকে কৃষ্ণনগর যাওয়ার অনেকগুলো ট্রেন চলে । ভাড়া ২০ টাকা । সপ্তাহের অন্যদিনে এই ট্রেনগুলো গ্যালপিং হলেও রবিবার সব স্টেশনে থামে । শিয়ালদহ থেকে কৃষ্ণনগর যেতে লাগে প্রায় পৌনে তিন ঘন্টা । কাজেই ট্রেনে বসতে পাওয়াটা খুব দরকারি । তবে যদি প্রথমে বসতে নাও পাওয়া যায়, নৈহাটীর পর থেকে মোটামুটি ফাঁকা হয়ে যায়ই ।

আমরা ধরেছিলাম সকাল ৯:৩৫ এর ট্রেন যেটা কৃষ্ণনগর পৌঁছল বেলা ১২:২০ তে । ট্রেন থেকে নেমে স্টেশনের বাইরে গিয়ে একটা সমস্যা হতে পারে যেটার সম্মুখীন আমরা হয়েছিলাম ।কৃষ্ণনগর জায়গাটা ঠিক ঘুরতে যাওয়ার জন্য প্রসিদ্ধ নয় । এর আগে ব্যান্ডেলে গিয়ে যেমন দেখেছিলাম রিক্সা আর অটোওয়ালারা আমাদের দেখেই 'চার্চ চার্চ' বা 'ইমামবাড়া ইমামবাড়া' বলে হেঁকেছিল, এবারে সেরকম হল না । আসলে কৃষ্ণনগর নদীয়া জেলার যাকে বলে সদর, এখানে প্রচুর লোক চাকরি করতে যায়, তাই এখানকার মানুষ অতিথিদের ব্যাপারে বিশেষ উদ্যোগী নয় ।

কিন্তু এরা আমাদের ব্যাপারে উদ্যোগী না হলে কি হবে, আমরা তো ঘুরতে গেছি । কাজেই উদ্যোগটা আমাদেরই নিতে হল । কৃষ্ণনগরে দেখার জায়গা বলতে প্রধানতঃ চারটে - রাজবাড়ি, ঘুর্ণি, ক্যাথলিক চার্চ আর কলেজ । এগুলো আমরা আগে থেকেই জেনে গেছিলাম । একজন স্থানীয় লোকের সঙ্গে কথা বলে এগুলোর কোনটা কিভাবে যাওয়া যায়, জেনে নিলাম । এদের মধ্যে কলেজটা 'কৃষ্ণনগর কলেজ' নামেই বিখ্যাত - এটা একটা বহু পুরনো কলেজ । কিন্তু রিক্সাওয়ালাকে বোঝাতেই পারলাম না আমরা ঠিক কোন কলেজটায় যেতে চাইছি । বারবারই বলতে থাকল "এখানে সব মিলিয়ে পাঁচটা কলেজ আছে, আপনারা কোথায় যেতে চান বলুন ।"

রাজবাড়ির প্রধান দরজা
কলেজ আমাদের লিস্ট থেকে বাদ দিতে হল । রিক্সা করে প্রথমে গেলাম রাজবাড়ি । নদীয়াধিপতি মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের বিখ্যাত রাজপ্রাসাদ । পাঁচিল দিয়ে ঘেরা বিরাট বড় রাজবাড়ি, কিন্তু ভেতরে ঢুকতে দেয় না । বাইরে থেকে ভেতরটা যতদূর দেখা যায় দেখলাম । রাজবাড়ি সংলগ্ন মাঠে কিছুদিনের মধ্যে একটা মেলা বসবে, তার প্রস্তুতি চলছে । এই মেলা হচ্ছে কৃষ্ণনগরের বিখ্যাত মেলা, প্রতি বছর এপ্রিল মাসে ১৫ দিনের জন্য বসে । এই সময়ে রাজবাড়ির দরজা সর্বসাধারণের জন্য খুলে দেওয়া হয় । আরও জানলাম রাজবাড়িতে বর্তমানে কেউ থাকে না, রাজার বংশধর কলকাতায় থাকেন (কথা শুনে মনে হল এটা আন্দাজে বলছে, তবে এখানে সত্যি-মিথ্যে যাচাই করার কোনও উপায় নেই) আর মেলার সময়ে এখানে আসেন ।

দোকানে রাখা মাটির পুতুল
পরবর্তী গন্তব্য ঘুর্ণি । এখানেই কৃষ্ণনগরের জগদ্বিখ্যাত মাটির পুতুল তৈরি ও বিক্রি হয় । পাশাপাশি সার দেওয়া পরপর দোকান, সেখানে বসেই কারিগর তৈরি করছেন ও বিক্রি করছেন । সে এক দেখার মতো জিনিস ! কোনও ছাঁচ নেই, শুধু হাত ও নানারকম ছোটখাটো ছুরি চিমটে দিয়ে পরপর পুতুল তৈরি হয়ে চলেছে । দুর্গা, গণেশ, রাধাকৃষ্ণ, কালী, চৈতন্যদেব থেকে শুরু করে সাঁওতাল দম্পতি, গ্রামের ছেলে-বুড়ো, সব্জী বিক্রেতা, কামার, কুমোর সবার মুর্তিই তৈরি হয় । মাটির গয়নাও পাওয়া যায় । সব দোকানে প্রায় একই জিনিস পাওয়া যায়, কিন্তু তাও আমরা প্রত্যেকটা দোকান আলাদা আলাদা করে ঘুরে দেখলাম । হাতে অফুরন্ত সময় ছিলনা সেজন্য বেরিয়ে আসতে হল, তা না হলে আরও অনেকক্ষণ থাকতাম ।

এরপর রিক্সাওয়ালাকে বললাম আমাদের একটা খাবারের হোটেলে নিয়ে যেতে । ঘুর্ণির বাসস্ট্যান্ডটা বেশ বড়, রিক্সাওয়ালা আমাদের সেখানে একটা খাবারের হোটেলের সামনে ছেড়ে দিল । স্টেশন থেকে রাজবাড়ি হয়ে ঘুর্ণি ঘুরে এ'পর্যন্ত ছেড়ে দেওয়ার জন্য রিক্সাওয়ালা নিল মোট ৬০ টাকা । খাবারের হোটেলে ঢুকলাম । হোটেলটা সেরকম impressive কিছু নয়, পরিষ্কার - এ'টুকু বলা যায় । ভাত-ডাল আর একটা সব্জী - ১৫ টাকা । চিকেন ৬০ টাকা । একবারে যা ভাত দেয়, সেটা একজনের পক্ষে যথেষ্ট । আমাদের দু'জনের মোট বিল হল ১৫০ টাকা ।

এরপর আমাদের গন্তব্য চার্চ । হোটেলের সামনে থেকেই আরেকটা রিক্সা ধরে গেলাম চার্চে । এবারে ভাড়া নিল ১৫ টাকা । এই দুরত্বটার ভাড়া স্থানীয় লোকের জন্য ১০ টাকা, কিন্তু আমাদের থেকে ১৫ টাকাই নিল । একটা কথা এখানে লেখা দরকার যে কলকাতার তুলনায় কিন্তু কৃষ্ণনগরের রিক্সাভাড়া কম । ঘুর্ণির বাসস্ট্যান্ড থেকে চার্চের যা দুরত্ব, সেই দুরত্ব কলকাতায় কিছুতেই ১০ টাকায় যাওয়া যায় না ।

Christo Mandir এর ভেতরে
চার্চ দেখে মন ভরে গেল । এমনিতেই চার্চ জায়গাটা খুব পরিষ্কার আর শান্ত হয়, তাই চার্চের ভেতরে গেলে একটা অন্যরকম অনুভূতি হয় । সেটা ঈশ্বরে ভক্তি না থাকলেও হয় । এখানে প্রধান চার্চের পাশে আরেকটা ছোট চার্চ আছে, সেটার নাম Christo Mandir । প্রধান চার্চটা দুপুরে বন্ধ থাকে, বিকেল ৪ টের সময়ে খোলে । Christo Mandir সারাক্ষণ খোলা । এখানে জুতো পরে ঢোকা বা ছবি তোলার কোনও বিধিনিষেধ নেই, যেটা আছে সেটা একটা অনুরোধ - নীরবতা বজায় রাখার । বলাই বাহুল্য, সেটা অগ্রাহ্য করার কোনও প্রশ্নই ওঠে না । বিশাল একটা ছ'কোণা হলঘরের মতো জায়গা যার সমস্ত দেওয়াল জুড়ে যীশুর জীবনী । সিলিংটা গম্বুজের মতো, সেখানে আবার আকাশের তারার মতো নক্সা করা আছে । সব মিলিয়ে খুব সুন্দর ।

Christo Mandir এর বাইরে - কলম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কার
এই Christo Mandir এর বাইরেটাও খুব অভিনব । কলম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কার থেকে শুরু করে গান্ধীজির ডান্ডি অভিযান - সব কিছুরই বিশাল বিশাল মূর্তি আছে । এছাড়া আছে বিভিন্ন Saint দের মূর্তি । একটা চার্চে এরকম জিনিস আমরা কখনও দেখিনি । কিন্তু এগুলোর বিশেষত্ব কী, সেটা জানার কোনও উপায় নেই, কারণ ত্রিসীমানার মধ্যে আমরা দু'জন ছাড়া আর কোনও লোক নেই ।


এই Christo Mandir থেকে বেরিয়ে প্রধান চার্চে গেলাম । চার্চ বন্ধ, তবে কম্পাউন্ডের ভেতরে ঢোকা যায় । খুব সুন্দর করে ঘাস ছাঁটা একটা মাঠ, আর একপাশে সুন্দর ফুলের বাগান ।

ধাপের একেবারে ওপরে
এখান থেকে বেরিয়ে আরেকটা জায়গা আছে, সেটাকে কি বলা উচিৎ সেটা বলা মুস্কিল । দু'দিকে সিঁড়ির মতো উঠে গেছে যার ধাপে ধাপে crucifiction এর ঘটনাটার মূর্তি রাখা আছে । সিঁড়ি দিয়ে উঠে যেখানে পৌঁছনো যায়, সেখানে ক্রুশবিদ্ধ যীশুর একটা মূর্তি আছে ।





স্টেশন - ফেরার পথে
এবার ফেরার পালা । ২০ টাকা রিক্সাভাড়া দিয়ে চার্চ থেকে সোজা স্টেশনে চলে এলাম । ঘোরা মোটামুটি ভালই হয়েছে, শুধু বাকি আছে কৃষ্ণনগরের বিখ্যাত সরপুরিয়া-সরভাজা কেনা । স্টেশনের কাছে কোনও দোকান নেই, তাই আমাদের আবার কিছুটা হেঁটে শহরের দিকে যেতে হল । সেখানেও একটাই দোকান খোলা পাওয়া গেল । সরপুরিয়া-সরভাজা দু'টোরই দাম ৩০০ টাকা/কেজি ।


আমাদের ফেরার ট্রেনের সময় ছিল বিকেল ৪:২৫ ; মিষ্টি কিনে স্টেশনে এসে দেখলাম ট্রেন এসে গেছে । ট্রেন ছাড়ল যথাসময়ে । ফেরার পথে ট্রেনে সাংঘাতিক ভীড় হয়েছিল, সৌভাগ্যবশতঃ আমরা আগে থেকে উঠেছিলাম বলে বসতে পেয়েছিলাম । শিয়ালদহে ট্রেন পোঁছল সাতটার একটু পরে ।

সারসংক্ষেপঃ

১. কলকাতা থেকে রেলপথে ঠিক ১০০ কিলোমিটার দূরে কৃষ্ণনগর একটা বেশ সুন্দর দেখার জায়গা । ট্রেনে যাওয়ার খরচ সবচেয়ে কম, এছাড়া কলকাতা থেকে বাসে বা গাড়ি ভাড়া করেও যাওয়া যেতে পারে ।
২. জায়গাটা ঠিক ঘোরার জায়গা হিসেবে প্রসিদ্ধ নয়, তাই আগে থেকে একটু জেনে যাওয়ার দরকার যে এখানে কি কি দেখার জিনিস আছে, সেগুলোর কোনটা কোথায় আর কিভাবে যেতে হয় ।
৩. ২ জন ঘোরার জন্য রিক্সা হচ্ছে সবচেয়ে সুবিধেজনক । তবে লোকসংখ্যা বেশি হলে অটো ভাড়া করে নেওয়া যেতে পারে ।
৪. এখানে দেখার জায়গা বলতে রাজবাড়ি, কলেজ, ঘূর্ণি আর চার্চ । এর মধ্যে রাজবাড়ির ভেতরে ঢুকতে দেয় না ।
৫. ঘূর্ণি অবশ্যই দেখা উচিৎ । এখানকার মাটির পুতুল পৃথিবীবিখ্যাত আর তার কারণটা এখানে গেলে স্পষ্ট বোঝা যায় ।
৬. চার্চটা দুপুরে বন্ধ থাকে, বিকেল ৪ টেয় খোলে । চার্চের পাশে একটা Christo Mandir আছে যেটা সারাক্ষণ খোলা থাকে । এটা খুব বৈশিষ্ট্যপূর্ণ ।
৭. খাওয়াদাওয়া এককথায় চলনসই । সাধারণ ভাতের হোটেল আছে অনেক, তবে তার চেয়ে বেশি ভালো রেস্টুরেন্ট আশা না করাই উচিৎ ।

উপসংহারঃ


কৃষ্ণনগর
কৃষ্ণনগর দেখার জায়গা হিসেবে খুব আকর্ষণীয় কিছু নয়, কাজেই 'না দেখলে জীবন অসম্পূর্ণ' - তা নয় কখনওই । কিন্তু যদি ছোটখাটো জায়গায় ঘোরার নেশা থাকে আর তার সঙ্গে 'একদিনে ঘুরে আসতে হবে' এরকম বাধ্যবাধকতা থাকে তাহলে এখানে যাওয়া যেতে পারে । অল্প টাকা খরচ হবে, আর যেটা হবে সেটা উশুল হয়ে যাবে এটা জোর দিয়ে বলাই যায় । মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের রাজধানী এই শহরে এমন অনেক কিছু আছে, যা দেখলে সেই সময়টাকে ছোঁওয়া যায় । কৃষ্ণনগর পর্যটককে হয়তো সেভাবে 'আকর্ষণ' করে না, কিন্তু beauty lies in the eyes of the beholder - এই কথাটা কৃষ্ণনগরের জন্য আশ্চর্যজনকভাবে সত্য !

কৃষ্ণনগর ভ্রমণের আরও ছবি দেখতে হলে click here:

Monday, February 13, 2012

চাঁদিপুর ভ্রমণ

দীর্ঘদিন পরে আবার ব্লগকে আপডেট্‌ করার সময় এসেছে । এবার গেছিলাম চাঁদিপুর । উড়িষ্যা আর পশ্চিমবঙ্গের সীমানা থেকে ঢিল ছোঁড়া দুরত্বে এই জায়গা কাজের চাপ থেকে মুক্তির স্বাদ পেতে দু'দিনের ঘোরার পক্ষে খুবই উপযুক্ত । আমাদের পুরো বেড়ানোটাই একটা গাইডের কাজ করবে, তাই আমাদের বেড়ানোর নির্ভেজাল বিবরণ দিতে শুরু করি ।

ট্রেনে যাওয়ার পথে
১১ই ফ্রেব্রুয়ারী, ২০১২ শনিবার আমাদের যাত্রা শুরু । কে কে গেছিলাম, তা আর বিস্তারিতভাবে লিখছি না কারণ একটা বাচ্চাসহ আমাদের দলের মোট সদস্য সংখ্যা ছিল ৩৪ ! এর মধ্যে ২৭ জন আমাদের অফিসের আর বাকিরা কয়েকজনের পরিবারের সদস্য । ট্রেনে চাঁদিপুর যাওয়ার জন্য বালেশ্বরে নামতে হয় । হাওড়া থেকে বালেশ্বর যাওয়ার অনেক ট্রেন আছে, আমরা 'ধৌলি এক্সপ্রেস' ঠিক করেছিলাম । 2S এর ভাড়া ৮৫ টাকা । এটা সকাল ছ'টায় হাওড়া থেকে ছাড়ে । স্লিপার ক্লাস নেই, বসে যেতে হয় । দুরত্বটা খুবই কম, মাত্র ২৩৪ কিলোমিটার, কাজেই সবাই মিলে হৈ হৈ করতে করতে গেলে বসে যাওয়াটা কষ্টকর তো নয়ই, বরং আনন্দের । ট্রেনে দরকার মতো খাবারদাবার সবই ওঠে, এছাড়া IRCTC র নিজস্ব প্যান্ট্রিও আছে ।

OTDC র বাস
ট্রেন পৌঁছনোর কথা ০৯:২৬ এ, আর আমাদের ট্রেন একেবারেই দেরি করেনি । বালেশ্বর থেকে চাঁদিপুরের দুরত্ব ১৬ কিলোমিটারের মতো - এই পথটা যাওয়ার জন্য স্টেশন থেকে অনেক গাড়ি পাওয়া যায় । চাঁদিপুরে অল্প কিছু হোটেল আছে, তবে থাকার জন্য শ্রেষ্ঠ জায়গা Orissa Tourism এর 'পান্থ নিবাস' - এই পান্থ নিবাসের নিজস্ব pick and drop এর ব্যবস্থা আছে, এরাই আমাদের স্টেশন থেকে হোটেল পর্যন্ত নিয়ে গেল । মাথাপিছু ভাড়া ৫০ টাকা । কয়েকটা Bolero আর একটা ১৩ সীট্‌ এর সিটি বাস এ করে প্রায় ত্রিশ মিনিট চলার পর আমরা এসে পৌঁছলাম আমাদের গন্তব্যস্থল - চাঁদিপুর এর পান্থ নিবাসে ।

পান্থ নিবাস-এ পৌঁছে
হোটেল (হ্যাঁ, নাম যাইই হোক, সুবিধের জন্য হোটেলই বলছি । আর শেক্সপীয়ার তো বলেইছেন 'নামে কি আসে যায় ?') দেখে সবারই পছন্দ হল । হওয়ার মতনই । বিরাট হোটেল, বিশাল ব্যবস্থা । সবথেকে আকর্ষণীয় ব্যাপার হল সমুদ্রের নৈকট্য । এই অংশে বিচ্‌টা হোটেলের নিজস্ব, এখানে বাইরের কাউকে ঢুকতে দেওয়া হয় না । হোটেলের গেট থেকে বিচ্‌ পর্যন্ত হেঁটে খুব বেশি হলে দু'মিনিট লাগে । হোটেলের গেটের সামনে নিজস্ব বাগান আর একটা ছোট্ট জলাশয় আছে, সেখানে আবার একটা কচ্ছপ আছে । হোটেলের সামনের দিকের ঘরগুলো AC Delux ইত্যাদি ইত্যাদি । বলা বাহুল্য এই ঘরের সবগুলো থেকেই সমুদ্র দেখা যায় । আমাদের ঘরগুলো সাধারণ 2 Bed বা 4 Bed ঘর, সেগুলো, স্বভাবতই, অপেক্ষাকৃত কম ঘ্যাম । 2 Bed এর ভাড়া ৮০০ টাকা আর 4 Bed এর ভাড়া ১,০০০ টাকা ।

হোটেলের গোলাকার ব্যালকনি
রিসেপশনের ফর্ম্যালিটি মিটিয়ে আমরা একে একে ঘর দখল করলাম । আমরা ৪ জন দোতলায় একটা ঘরে ছিলাম । হোটেলের আকৃতিটা অদ্ভুত রকমের গোলাকার । এরকম গোল হোটেল আমি এর আগে কখনও দেখিনি । ব্যালকনির সামনে হোটেলের একটা বেশ বড় মাঠ আছে, যেখানে দোলনা, স্লিপ ইত্যাদি আছে । এছাড়া কিছু ফুলের গাছও আছে । সবমিলিয়ে একটা শান্ত নিরিবিলি আর পরিচ্ছন্ন ভাব যেটা একটা জায়গাকে ভাল লাগার জন্য বেশ উপযোগী ।

হাঁটুজলে হাঁটাহাঁটি
পোশাক পরিবর্তন করে এবার সমুদ্রে ঝাঁপানোর পালা । আগেই বলে রাখি চাঁদিপুরের প্রধান আকর্ষণ কিন্তু সমুদ্রের ঢেউ বা সমুদ্রে চান করা নয় । (আকর্ষণটা কি, সেটা যথাসময়ে বলব) চান করতে গিয়ে দেখলাম জলে কোনও ঢেউ নেই বললেই চলে, গভীরতাও খুব কম । হাঁটু জলকে কোমর পর্যন্ত তুলতে প্রায় তিন-চারশ' মিটার হেঁটে ফেললাম, আর তারপর এক কিলোমিটার হেঁটেও সেই জল আর কোমরের ওপরে উঠল না ! (মনে হচ্ছিল হাঁটতে হাঁটতে আন্দামানও পৌঁছে গেলেও, জলের গভীরতা একই থাকবে !) ঘন্টাদুয়েক কোমরজলে ঘোরাঘুরি (এটাই সঠিক শব্দ) করে তারপর ফিরে এলাম । এরপর হোটেলে আরেকদফা চান ।

বিশাল ডাইনিং রুমে খাওয়াদাওয়া
পান্থনিবাসের নিজস্ব খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা আছে । ডিম, মাছ, মাংস সবই পাওয়া যায় । তবে variety খুব কম । মাছ বলতে পোনা বা পমফ্রেট আর মাংস বলতে শুধু মুরগী । পাঁঠার মাংস পাওয়া সম্ভব একমাত্র যদি সেটা ৩৪ জনের সবার জন্যই অর্ডার দেওয়া হয় । আমরা আর সে'চেষ্টা করিনি । আমাদের প্রথমদিন দুপুরের খাবার কলকাতা থেকেই অর্ডার দেওয়া ছিল, তাই সেই নিয়ে কোনও সমস্যায় পড়তে হয়নি । হোটেলের ডাইনিং হলটা বিরাট আর আমরা একটা বড় দল ছিলাম বলে আমাদের খাবার ওরা সবসময়েই ব্যুফে দিত । অর্থাৎ, মাছ বা মাংস নির্দিষ্ট পরিমাণে পাওয়া যেত, কিন্তু সেটা ছাড়া ডাল আলুভাজা তরকারি চাটনি পাঁপড় সবই অফুরন্তভাবে পাওয়া যেত । এখানে একটা কথা জানিয়ে রাখি, হোটেলের রান্নাকে চলনসই বললেই ঠিক বলা হয়, ভালোর পর্যায়ে পড়ে না । কিন্তু যেহেতু আমাদের হাতে আর কোনও বিকল্প নেই, কাজেই এতেই চালাতে হবে । খাবারের রেট হল - পোনামাছভাত ৯০ টাকা, মাংসভাত ১১০ টাকা ।

এরপর দুপুরে অনেকেই নিজের ঘরে চলে গেল । কিছু লোক সমুদ্রের ধারে বেড়াতে গেল আর আমরা কয়েকজন সামনের মাঠটায় গিয়ে বসলাম । এর আগে আরেকটা দরকারি কাজ সেরে আসা হয়েছে সেটা হল ম্যানেজারের সঙ্গে দেখা করে আমাদের দু'দিনের খাওয়াদাওয়া এবং ঘোরার একটা প্ল্যান করা । আমাদের এই ট্রিপের ম্যানেজার ছিল কঙ্কনাদি যার অসামান্য ভালো ম্যানেজমেন্ট স্কিল এই ট্রিপের সাফল্যের অন্যতম কারণ । আমি নিজে ছিলাম ফান্ড ম্যানেজার কাম অ্যাকাউনটেন্ট ।

বহুদূরে সমুদ্র
সমস্তকিছু নিখুঁতভাবে প্ল্যান করে আমরা গেলাম সমুদ্রের ধারে । কিন্তু কোথায় সমুদ্র ? দিগন্তরেখা পর্যন্ত যতদূর চোখ যায় শুধু বালি আর বালি ! সেই বালি কিন্তু নরম বালি নয়, শক্ত ভিজে বালি । হ্যাঁ, এটাই চাঁদিপুরের প্রধান আকর্ষণ । এখানে ভাঁটার সময়ে সমুদ্র পাড় থেকে ৩ কিলোমিটার দূরে চলে যায় । পাড় থেকে আর জলের রেখা দেখাও যায় না । জোয়ারভাঁটার মধ্যে এই বিশাল পার্থক্যটা আমি যতদূর শুনেছি সারা ভারতবর্ষে আর কোথাও নেই, সারা পৃথিবীতেও আর শুধুমাত্র অস্ট্রেলিয়ায় এক জায়গায় আছে । বিকেল সাড়ে চারটে বাজে, সূর্য ক্রমশঃ দিগন্তের দিকে ঢলে পড়ছে, এর পরে হলে আর এই বিচে হাঁটা যাবে না, তাই আমরা কয়েকজন জলের দিকে হাঁটতে শুরু করলাম । ৩ কিলোমিটার শক্ত বালির ওপর হেঁটে চলা সহজ নয়, আর মাঝে মাঝে গোড়ালি ডোবানো জমা জল কাজটাকে আরও কঠিন করে দেয়। তাও পাড় থেকে এক-দেড় কিলোমিটার মতো এগিয়ে আমরা আবার হোটেলে ফিরে এলাম ।

লে পাগলু ডান্স ডান্স ডান্স !
হোটেলে বিকেলে চা আর তার সঙ্গে পিঁয়াজি অর্ডার দেওয়া হয়েছিল । একপ্লেট পিঁয়াজি চারজনের জন্য যথেষ্ট, তবে আমরা ১ : ২ অনুপাতে অর্ডার দেওয়ায় অনেক বেশি হয়ে গেছিল । এরপর ঠিক হল এই মাঠের একটা অংশে Bonfire করা হবে । হোটেলের লোকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল যে তাদের কোনও অসুবিধে নেই । তারাই খুব কম সময়ের মধ্যে কাঠ আর music system এর ব্যবস্থা করে দিল । এর জন্য আমাদের মোট ৮০০ টাকা লাগল । ঘন্টাখানেকের মধ্যেই সবাই তৈরি হয়ে নিল 'সাংস্কৃতিক নৃত্যানুষ্ঠান'-এ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে অংশগ্রহণ করার জন্য । আর তারপর - 'লে পাগলু ডান্স ডান্স ডান্স' !

পূর্ণচন্দ্র - রাত সাড়ে এগারোটা
আমি বিচ্‌ এ গিয়ে বসলাম । সাধারণতঃ সমুদ্রের ধারে বেড়াতে গেলে আমি সন্ধ্যেবেলা যতটা সম্ভব সময় একা বিচ্‌ এ বসে কাটানোর চেষ্টা করি, এবারেও সেটা করলাম । পাড়ে যে স্ট্রীটলাইটগুলো আছে, সেগুলোর রেঞ্জ খুব বেশি নয় । আমি বালির ওপর বসে ছিলাম আর তখন, আক্ষরিক অর্থেই ত্রিসীমানার মধ্যে কেউ নেই । হঠাৎ স্ট্রীটলাইটগুলো নিভিয়ে দেওয়া হল (দু'দিনের অভিজ্ঞতায় দেখেছিলাম ওগুলো ঠিক রাত ৮টার সময়ে নেভানো হয়) - যার ফলে চারপাশটা ঘুটঘুটে অন্ধকার হয়ে গেল । আমার একটু সমস্যা হল কারণ আমি বসেছিলাম হোটেলের মেইনগেট থেকে কিছুটা দূরে, তাই মোবাইলের টর্চ জ্বেলে আস্তে আস্তে ফিরে এলাম । তারপর এমন একটা জায়গায় বসলাম যেখানে হোটেলের আলো কিছুটা হলেও এসে পৌঁছয় । রাত ন'টার সময়ে হোটেলে ফিরে এলাম । বলা বাহুল্য, তখনও 'অনুষ্ঠান' চলছে । এরপর সাড়ে দশটায় ডিনার । অর্ডার আগেই দেওয়া ছিল, আর আমাদের সুবিধের জন্য এবার ওরা খাবার মাঠেই সার্ভ করল ।সবকিছু মিটতে মিটতে এগারোটা বেজে গেল । তারপর আমরা অনেকে আবার বিচ্‌এ গিয়ে বসলাম । আমরা গেছিলাম পুর্ণিমার দু'দিন পরে, কাজেই পূর্ণচন্দ্রও দেখা গেল ।

হোটেলে ফিরলাম তখন বারোটা । পরেরদিন সকাল ছ'টা আঠারোয় সূর্যোদয়, ঠিকসময়ে অ্যালার্ম দিয়ে শুয়ে পড়লাম ।

সূর্যোদয়ের কিছুক্ষণ পরে
১২ই ফ্রেব্রুয়ারী, রবিবার সকাল ছ'টায় উঠে গেলাম বিচ্‌ এ । আকাশের অবস্থা দেখেই মনে হল সূর্যোদয় দেখা যাবে না, কারণ মেঘ করে ছিল । বেশ কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করে চলে এলাম । হোটেল থেকে ঘরে ঘরে চা দেয় আর এই চা টা complementary । এরপর আমরা ব্রেকফাস্ট করলাম ডাইনিং হল-এ । এটাও complementary । ব্রেকফাস্টের দু'রকম option আছে, লুচি-তরকারি আর পাঁউরুটি টোস্ট ।

এরপর আবার সমুদ্র । আগেরদিনের থেকে নতুন কিছু নেই, তাই আর পুনরাবৃত্তি করছি না । বরং দুপুরে খাওয়ার পর ২ টোর সময়ে sightseeing করতে বেরোলাম, সেটার কথা বলি । এ'ক্ষেত্রেও হোটেল থেকেই গাড়ির ব্যবস্থা করা হয়েছিল । পান্থ নিবাসের নিজস্ব গাড়িগুলো করেই আমরা ঘুরতে বেরিয়েছিলাম । ওরা মোট চারটে জায়গা দেখায়, ভাড়া মাথাপিছু ২৫০ টাকা ।

বুড়িবালাম এর তীরে
প্রথম গন্তব্য বুড়িবালাম । আমাদের হোটেল থেকে ৩ কিলোমিটার মত দূরে জায়গাটা আপাতভাবে একটা নদীর ধার - এখান থেকে মাছ ধরার ট্রলার ছাড়ে । ঐতিহাসিক গুরুত্ব হচ্ছে এখানে বিপ্লবী বাঘা যতীন (যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়) ইংরেজদের সঙ্গে যুদ্ধ করেছিলেন । জায়গাটায় দেখার সেরকম কিছুই নেই, দশ মিনিটের বেশি সময় দেওয়ার কোনও মানেই হয় না ।

এই জলস্রোতের নিচেই পঞ্চলিঙ্গেশ্বর


পরবর্তী দেখার জায়গা পঞ্চলিঙ্গেশ্বর । ৪৮ কিলোমিটার দূরে পাহাড়ের ওপর মন্দির । যেতে সময় লাগল ১ ঘন্টা ২০ মিনিটের মতো । এখানে পাহাড়ের ওপরে উঠতে ২৮৬ টা সিঁড়ি (এটা আমাদের ড্রাইভার কাম গাইড বলল, আমরা কেউই গুনিনি) ভাঙতে হয় । তবে কাজটা সেরকম কঠিন কিছু না । সব জায়গাতেই বসার ব্যবস্থা আছে, কাজেই ওঠার ফাঁকে জিরিয়ে নেওয়া যেতে পারে । ওঠার পথের বিভিন্ন জায়গা থেকে প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখে চোখ জুড়িয়ে যায় । পঞ্চলিঙ্গেশ্বরের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এখানে একটা ছোট্ট ঝরনার জলের নিচে পাঁচটা শিবলিঙ্গ আছে (প্রকৃতপক্ষে পাঁচটা বিভিন্ন আকারের এবড়োখেবড়ো পাথর, সেগুলোকেই শিবলিঙ্গ বলা হয়) যেগুলো জলের নিচে থাকায় ওপর থেকে দেখা যায় না, শুধু 'হাত দিয়ে অনুভব' করা যায় । এখানে পুজো দেওয়ার ব্যবস্থাও আছে, যথারীতি ।

সেই বাঁদর - মাল লুট করার পরে
নামার সময়ে একটা ঘটনা ঘটল যেটার জন্য আমরা কেউই তৈরি ছিলাম না । আমাদের দলের সঙ্ঘমিত্রার হাতের প্যাকেটে পুজোর প্রসাদ (প্রধানতঃ কলা) দেখে হঠাৎ একটা বাঁদর ওকে আক্রমণ করল । ব্যাপারটা এতটাই দ্রুত ঘটল যে কেউ কিছু react করার আগেই দেখা গেল প্যাকেট বাঁদরের কব্জায় ! আশেপাশের স্থানীয় লোকজনের প্রতিক্রিয়া দেখে বুঝলাম এরকম ঘটনা ওখানে নতুন নয় । তাই যাদের হাতে পুজোর প্রসাদ থাকবে, তাদের বলছি 'সাবধান' !

নীলাগিরির মন্দির
এরপর নীলাগিরি । দুরত্ব ১০ কিলোমিটার, যেতে লাগল আরও ২০ মিনিট মতো । এখানে একটা জগন্নাথের মন্দির আছে আর তার পাশে আছে এখানকার রাজার বাড়ি । বাড়ির কিছুটা অংশ ভাঙ্গা - পোড়োবাড়ির মতো, আর কিছুটা অংশ মেরামত করে এখনকার রাজা থাকেন । আমাদের দলের কয়েকজন 'রাজার সঙ্গে দেখা করে আসি' বলে সেদিকে এগিয়েছিল, কিন্তু ব্যাপারটা একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে বলে তাদের নিরস্ত করা হল । এই রাজবাড়ির পাশেই আছে নীলাগিরি পাহাড়, যেটার একেবারে ওপরে না হলেও অনেকদূর পর্যন্ত ট্রেকিং করে ওঠা যায় ।

শ্রী চৈতন্যদেবের পায়ের ছাপ - এটা আসল
সন্ধ্যে প্রায় ছ'টা বাজে । নীলাগিরির সামনে কিছু চায়ের দোকান আছে । আমরা চা-টা খেয়ে নিয়ে এগিয়ে গেলাম আমাদের পরবর্তী তথা শেষ গন্তব্য - রেমুনা । ৯ কিলোমিটার দুরত্ব, ৩০ মিনিট লাগল । এখানকার বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এখানেও একটা জগন্নাথের মন্দির আছে । এই মন্দিরে শ্রী চৈতন্যদেবের দু'জোড়া পায়ের ছাপ রাখা আছে - একটা আসল আরেকটা নকল । ('নকল পায়ের ছাপ ব্যাপারটা আসলে কি, বুঝলাম না । তবে দলের সকলকে বলা হল 'নকল হইতে সাবধান' !) এখানকার সবথেকে বড় আকর্ষণ হল এখানে অত্যন্ত (পড়ার সময়ে 'অত্‌ত্‌ত্‌ত্যন্ত' পড়া উচিৎ !) উৎকৃষ্ট মানের ক্ষীর পাওয়া যায় । দাম ১০ টাকা, ২০ টাকা আর ৪০ টাকা । আমরা বেশ কিছু কিনলাম । কিছু বাড়ি নিয়ে আসার সঙ্কল্প করা হল আর কিছু ফেরার পথেই খেয়ে নেওয়া হল ।

ব্যালকনি থেকে
Sightseeing শেষ । এরপর সোজা হোটেল । ঘড়ি বলছে সন্ধ্যে সাড়ে সাতটা । সারাদিন ঘোরা হয়েছে, তবে সেরকম কিছু পরিশ্রম হয়নি । তাই লোকজনের প্রবল উৎসাহে হোটেলে ফিরে এসে আবার নাচানাচির ব্যবস্থা করা হল । তবে আজ আর আগুন জ্বালানো হল না, শুধু music system ভাড়া করে নাচা হল । রাত সাড়ে দশটায় ডিনার । আজ আমাদের চাঁদিপুরে শেষ রাত্রি, তাই ডিনারে বিশেষ মেনু রাখা হয়েছিল । মিক্স্‌ড ফ্রাইড রাইস, মিক্স্‌ড চাউমিন আর চিলি চিকেন । যারা চিকেন খায় না তাদের জন্য চিলি পনীর । এর রেট ছিল ১২০ টাকা করে ।

বেড়ানোর (এবং post এর ও !) মোটামুটি শেষের দিকে চলে এসেছি, কাল সকালেই আমরা এখান থেকে পাততাড়ি গোটাব, তাই ডিনারের পরে ম্যানেজারের সঙ্গে formality গুলো সেরে নিলাম । যাবতীয় হিসেবপত্র করে full and final payment করতে একঘন্টা সময় লাগল । তারপর কিছুক্ষণ বিচ্‌ এ গিয়ে বসলাম । হোটেল থেকে বিচ্‌ এ যাওয়ার পথে যে লোহার গেটটা আছে সেটা রাত একটায় বন্ধ হয়, আর বন্ধ হলেও সেটা টপকে অনায়াসে যাতায়াত করা চলে ।

ঝাউবন
১৩ই ফ্রেব্রুয়ারী, সোমবার - আমাদের ফেরার দিন । সকালে আরেকবার সূর্যোদয় দেখার ব্যর্থ চেষ্টা করে আমরা বিচ্‌ ধরে হাঁটতে শুরু করলাম । প্রায় তিন কিলোমিটার হাঁটার পর একটা ঝাউবন পড়ে যেটা বেশ সুন্দর । চাঁদিপুরের বিচ্‌ এ আরেকটা জিনিস অফুরন্ত পাওয়া যায়, সেটা হচ্ছে গোটা ঝিনুক । বিভিন্ন আকারের বিভিন্ন রঙের অসংখ্য ঝিনুক পাওয়া যায় যা কুড়িয়ে কুড়িয়ে শেষ হওয়ার নয় ।

বালেশ্বর স্টেশন
হোটেলের চেক-আউটের সময় সকাল ৮ টা । আমাদের ফেরার ট্রেন ইস্ট কোস্ট এক্সপ্রেস এর সময় সকাল ১১:৪২, তাই হোটেল থেকে সাড়ে দশটায় বেরোনোই যথেষ্ট । এই সময়টুকু যেকোনো হোটেলই থাকতে দেয় আর বিশেষ করে যখন এটা season নয় । চানটান করে আমরা সকাল সাড়ে ন'টার মধ্যে ঘর ছেড়ে দিলাম । তারপর ব্রেকফাস্ট করে গাড়িতে উঠলাম । এই গাড়ি আমাদের বালেশ্বর স্টেশন পর্যন্ত পৌঁছে দেবে । আমাদের আগে থেকেই হোটেলে বলা ছিল - পোলাও আর মাংস লাঞ্চ প্যাক করিয়ে নিয়েছিলাম । সেইসব নিয়ে স্টেশনে এসে পৌঁছলাম তখন এগারোটা ।

ইস্ট কোস্ট এক্সপ্রেস । স্লিপার ক্লাস, ভাড়া ১৩২ টাকা । লেট করার ব্যাপারে ইস্ট কোস্ট এক্সপ্রেসের বেশ সুনাম আছে, কিন্তু আমাদের বেলায় সৌভাগ্যবশতঃ সেই সুনাম বজায় রইল না । মাত্র দশ মিনিট দেরিতে ট্রেন এল আর খুব আশ্চর্যজনকভাবে বেশ কিছুটা before time এ পৌঁছে দিল । বিকেল চারটেয় আমরা হাওড়ায় আর তারপর ... যে যার নিজস্ব ডেরায় !

সারসংক্ষেপঃ

১. কলকাতা থেকে খুবই কাছের সমুদ্রতট যেগুলো আছে, চাঁদিপুর তাদের মধ্যে অন্যতম । নিরিবিলি আর শান্ত পরিবেশে সমুদ্র দেখতে চাইলে চাঁদিপুর একটা বেশ ভালো option ।
২. হাওড়া থেকে বালেশ্বর পর্যন্ত কোনও ট্রেনে গিয়ে বাকিটা গাড়িতে যেতে হয় ।
৩. থাকার জায়গা হিসেবে OTDC পান্থ নিবাস খুবই ভালো । এছাড়া আরও কিছু হোটেল আছে তবে সেগুলো ততটা ভালো নয় । পান্থ নিবাসের ভেতরে একটা SBI ATM আছে ।
৪. পান্থ নিবাস থেকে complementary বেড-টী এবং ব্রেকফাস্ট দেওয়া হয় । এখানকার খাবারের মান খুব উন্নত কিছু নয়, তবে এই এলাকায় সবচেয়ে ভালো ।
৫. পান্থ নিবাস থেকে বিচ্‌ খুবই কাছে । বিচ্‌টা পান্থ নিবাসের নিজস্ব, তাই বাইরের লোকের উৎপাত একেবারেই নেই ।
৬. চাঁদিপুরের সমুদ্র চান করার পক্ষে খুব একটা উপযোগী নয়, তবে এখানে ভাঁটার সময়ে জল অনেকদূর চলে যায়, যেটা একটা ভালো দেখার জিনিস ।
৭. চাঁদিপুরে যে অল্প কয়েকটা ঘোরার জায়গা আছে তার মধ্যে পঞ্চলিঙ্গেশ্বর, নীলাগিরি আর রেমুনা উল্লেখযোগ্য । ঘোরার জন্য গাড়ির ব্যবস্থা পান্থ নিবাস থেকেই করা যায় । মাথাপিছু ২৫০ টাকা ।
৮. যাদের ঘুরতে গিয়ে কেনাকাটা করার অভ্যেস আছে, তাদের জন্য চাঁদিপুরে প্রায় কিছুই পাওয়া যাবে না । এখানে সবমিলিয়ে ৬ টা দোকান আছে আর সেখানে ঝিনুকের বা প্লাস্টিকের যা যা পাওয়া যায়, তার কোনওটাই এখানে তৈরি নয় (এই তথ্য আমি স্বয়ং দোকানদারের থেকে পেয়েছি !), সবই ভুবনেশ্বর বা কলকাতা থেকে আনানো ।
৯. পান্থ নিবাসের যোগাযোগঃ B. K. Pattajoshi - Ph: 91-6782-270051/270151 Mo: +91-9437190368. এছাড়া কলকাতা থেকে যোগাযোগ করার জন্য Orissa Tourism Development Corporation - Ph: (033)22654556.

উপসংহারঃ

চাঁদিপুর বিচ্‌
Weekend এ ঘোরার পক্ষে চাঁদিপুর খুব আদর্শ জায়গা । OTDC র নিজস্ব ব্যবস্থায় এখানে যে সুন্দর পর্যটন গড়ে উঠেছে তার সৌন্দর্য অন্য কোনও জায়গার সঙ্গে তুলনীয় নয় । এখানে ভাঁটার সময়ে সমুদ্র বহুদূরে চলে যায়, পাড় থেকে তাকে দেখা যায় না । এটাই এই জায়গার প্রধান আকর্ষণ । আশেপাশে কয়েকটা জায়গা আছে যেখানে ইচ্ছে হলে ঘুরতে যাওয়া যেতে পারে, কিন্তু কোনওটাই 'must visit' নয় । শান্ত পরিবেশে নিজেকে আর নিজের খুব কাছের কাউকে সময় দেওয়ার জন্য চাঁদিপুর খুব ideal জায়গা । এখানে প্রায় কিছুই নেই, কিন্তু তার মধ্যেও এমন কিছু আছে যার স্বাদ যারা একবার পাবে, চাঁদিপুর তাদের বারবার টেনে নিয়ে যাবে - এটা হল্‌ফ্‌ করে বলা যায় !


চাঁদিপুর ভ্রমণের আরও ছবি দেখতে হলে click here: