আমি ব্লগ লেখার খুব বেশি সমর্থক কোনওদিনও ছিলাম না, সত্যি কথা বলতে কি এখনও যে আছি তা নয় । তার একটা প্রধান কারণ আমার ধারণা ব্লগ লেখার থেকেও পড়া অনেক বেশি ক্লান্তিকর । অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, অনেক সময়ই পড়তে শুরু করে শেষ করা হয়ে ওঠে না । নিজের ধৈর্য এবং/অথবা আগ্রহের অভাবকে 'ঠিক আছে, বাকিটা পরে পড়ব' জাতীয় অজুহাত দিয়ে ঢেকে দিই - আর আমরা সবাই জানি সেই 'পরে' টা আর কখনওই আসে না । তো, এই কারণে আমি ঠিক করেছি আমার ব্লগকে কখনওই অন্যের ক্লান্তির কারণ ঘটাব না, আমার ব্লগের বিষয় হবে প্রধানতঃ ভ্রমণ । আমার মতো যেসব বাঙালিরা ঘুরতে ভালোবাসে, তাদের জন্য আমার ব্লগ হবে তথ্যের একটা উৎস । আমার নিজের একটা অভ্যেস আছে, কোনও জায়গায় বেড়াতে যাওয়ার আগে সেই জায়গাটা সম্পর্কে কিছুটা জেনে নেওয়ার চেষ্টা করি, আর ইন্টারনেট ঘাঁটতে গিয়ে আমার বরাবরই মনে হয়েছে যে ইন্টারনেটে লেখালেখি করার ব্যাপারে বাঙালিদের থেকে কুঁড়ে খুব কম শিক্ষিত জাতই আছে । আমার মতো যেসব বাঙালিরা আছে, যারা ইন্টারনেটে কোনো একটা ইংরিজীতে লেখা দেখলেই না পড়ার চেষ্টা করে, তাদের জন্য আমার ব্লগ সহায়ক হবে, এই বিশ্বাস নিয়ে শুরু করছি আমার ভ্রমণকাহিনী । আগেই বলে রাখি, আমি স্ট্যাটিসটিক্সের ছাত্র ছিলাম, তাই আমার ব্লগে তত্ত্বের থেকে তথ্যের দেখাই মিলবে বেশি ।

Monday, April 15, 2013

ফারাক্কা ভ্রমণ

তুমি কি এমন কাউকে চেনো যিনি ষাটের দশকে বা তার আগে কখনও উত্তরবঙ্গে গেছিলেন ? আমার মা এরকম একজন মানুষ । মায়ের মুখে শুনেছি সেই সময়ে, যখন মুর্শিদাবাদ আর মালদার সীমানা দিয়ে বয়ে যাওয়া গঙ্গার ওপরে কোনও ব্রীজ ছিল না, তখন এদিক থেকে ট্রেনে চড়ে মুর্শিদাবাদের সীমানায় গিয়ে নামতে হত আর তারপর নৌকো করে গঙ্গা পেরিয়ে ওপার থেকে আবার ট্রেনে উঠতে হত (যদি তুমি এরকম কাউকে চেনো যিনি উত্তরবঙ্গ থেকে দক্ষিণবঙ্গে এসেছিলেন, তাহলে ব্যাপারটা উলটে যাবে আর কি !) । এরপর গঙ্গার ওপরে তৈরি হল একটা সেতু কাম ব্যারেজ - ফারাক্কা । এই ব্রীজের ওপর দিয়ে অনেকবার যাতায়াত করলেও ভালো করে দেখার সুযোগ হয়নি কখনও । সেই ব্রীজ এবং ব্যারেজ দেখতেই আমাদের এবারে বেরিয়ে পড়া - ফারাক্কা ভ্রমণ ।

নিউ ফারাক্কা স্টেশন - নির্ধারিত সময়ের আগে !
১৪ই এপ্রিল ২০১৩, রবিবার শিয়ালদহ থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসে আমাদের যাত্রা শুরু হল সকাল ৬:৩৫ এ । মাথাপিছু ভাড়া ১৭০ টাকা । আমাদের চারজনের দল - আমি, আমার স্ত্রী, বাবা ও মা । যাত্রাপথের বিবরণ দেওয়ার মতো বিশেষ কিছু নেই তাই একেবারে ফারাক্কায় ট্রেন থেকে নামা দিয়ে শুরু করি । নামলাম তখন বেলা ১২:৩৫ বাজে । সময়টা উল্লেখযোগ্য কারণ কাঞ্চনজঙ্ঘার ফারাক্কায় পৌঁছনোর কথা ১২:৫০ এ । এটা একেবারেই অপ্রত্যাশিত - বিশেষ করে ভারতীয় রেল এর কাছে !

হোটেল সোনার বাংলা - ৫০০ টাকার ঘর
যাই হোক, স্টেশন থেকে নেমে লোকজনকে জিজ্ঞেস করে আমাদের হোটেলে পৌঁছলাম । স্টেশন থেকে হোটেল খুবই কাছে এবং সঙ্গে বেশি মালপত্র না থাকায় হেঁটেই গেলাম । ফারাক্কার হোটেলগুলো সবই প্রায় একই জায়গায় আর সবগুলোই একই মানের । আমাদের হোটেলের নাম 'সোনার বাংলা' - এখানে আমাদের আগে থেকেই বুকিং করা ছিল । গিয়ে দেখলাম আমরাই হোটেলের একমাত্র অতিথি ! হোটেলে এ সি এবং নন্‌ - এ সি দু'রকম ঘরই আছে । এ সি র ভাড়া ১,০০০ টাকা আর নন্‌ - এ সি র ৫০০ টাকা । আমাদের দু'টো নন এ সি ঘর নেওয়া ছিল ।

এরপর একদফা চানটান করে বেরোলাম খেতে । এখানে খাওয়ার জন্য কোনও রেস্ট্যুরেন্ট আশা কোরো না একেবারে সাধারণ 'ভাতের হোটেল' এর ওপরেই নির্ভর করতে হবে । সেইরকম একটা হোটেলে ভাত ডাল তরকারি দেশী মুরগীর ঝোল টক দই খাওয়া হল । চারজনের খরচ পড়ল ৪৩৫/- ।

ফারাক্কা ব্যারেজগামী রেল লাইন - দূরে ব্যারেজ
এরপর হোটেলে ফিরে এসে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে সাড়ে চারটে নাগাদ বেরোলাম আমাদের এখানে আসার প্রধান উদ্দেশ্য নিয়ে - ব্যারেজ দেখতে । আমাদের হোটেল থেকে ব্যারেজ হেঁটে মিনিট দশেক । ব্যারেজের সামনে গিয়ে একটা সাইনবোর্ড দেখলাম যেটা একেবারেই আশা করিনি । 'Photography Strictly Prohibited' । ভাবলাম 'এরকম লেখা তো অনেক জায়গাতেই থাকে, সুযোগ বুঝে তুলে নেব ।' কিন্তু ব্রীজের ওপরে হাঁটা শুরু করার আগেই একজন সিকিউরিটি গার্ড আমার গলায় ক্যামেরা ঝোলানো দেখে ডেকে বলল কোনওভাবেই যেন কোনও ছবি তোলার চেষ্টা না করি । কি আর করা যাবে, ব্যারেজটা নিজেরাই দেখলাম - তোমাকে দেখাতে পারছি না ।

এবার একটু ব্যারেজের বিবরণ দেওয়া যাক । ফারাক্কার মূল ব্যারেজের ওপর মোট ১০৯ টা লক্‌ গেট আছে । পুরো ব্যারেজের দৈর্ঘ্য ২ কিলোমিটারের একটু বেশি । হাঁটতে হাঁটতে নিচের জল খুব বেশি দেখা যায় না, তবে খেয়াল করলে লক্‌গেটগুলোর খোলা-বন্ধ অবস্থা থেকে অনেক কিছু শেখা যায় । (আমি খেয়াল করিনি, তাই শিখিওনি) আমরা রাস্তার বাঁদিকের ফুটপাথ ধরে হাঁটছিলাম - শুধু বাঁদিক ধরেই হাঁটার অনুমতি আছে । আমাদের আরও বাঁদিকে রেললাইন - সেখান দিয়ে অনবরত যাত্রীবাহী ট্রেন এবং মালগাড়ি যাতায়াত করছিল । বিকেলে রোদ্দুরের তাপ বেশ কম ছিল, তাই এই দীর্ঘ রাস্তাটা হেঁটে যেতে বেশ মনোরমই লাগছিল । প্রায় একঘন্টা হেঁটে পুরো ব্যারেজটা পেরিয়ে যখন মালদায় পৌঁছলাম, তখন প্রায় সূর্য্যাস্তের সময় হয়ে গেছে ।

গঙ্গার ওপর সূর্য্যাস্ত
ওপারে গিয়ে গঙ্গার পাড়ে গেলাম । এখান থেকেও ব্যারেজের ছবি তোলার নিয়ম নেই । ফারাক্কায় গঙ্গা বিশাল চওড়া - ওপারে সূর্য্যাস্ত দেখতে খুব সুন্দর লাগে । আমরা কিছুক্ষণ পাড়ে বসে রইলাম । সূর্য্যাস্তের পরে একটা অটো করে আবার এ'পারে ফিরে এলাম । ভাড়া মাথাপিছু ৫ টাকা ।




সন্ধ্যেবেলা ফারাক্কায় জাস্ট কিছু করার নেই, তাই হোটেলেই বসে রইলাম । রাতে আমাদের হোটেলের পাশের 'ভাতের হোটেল' থেকে রুটি, তরকা আর চিকেন কষা নিয়ে এসে খাওয়া হল । অর্ডার দিয়ে আসার পরে এরা হোটেলের ঘরেই ডেলিভারি দিয়ে যায় । ২১০/- ।

পরেরদিন, ১৫ই এপ্রিল, ২০১৩ - বাংলা ১লা বৈশাখ, ১৪২০ সাল । গঙ্গার ওপরে নতুন বছরের প্রথম সূর্য্যোদয় দেখার সুযোগ অবশ্য হল না কারণ আকাশ মেঘলা করে ছিল । এখানে একটা কথা বলে নিই - ফারাক্কার তাপমাত্রা কলকাতার চেয়ে তুলনামূলকভাবে বেশি এবং এই সময়ে ফারাক্কায় গরম সাংঘাতিক হলেও আমরা ফারাক্কায় যে ২৪ ঘন্টা ছিলাম, সেই সময়ের বেশিরভাগটাই মেঘলা ছিল । ফলে কখনওই আমাদের বিশেষ গরম লাগেনি ।

ফীডার ক্যানেল
সকালে চা খেয়ে গেলাম স্টেশনের কাছে । সেখান থেকে একটা সাইকেল ভ্যান ভাড়া করে আশপাশটা ঘুরতে যাওয়া হল । ফারাক্কায় দেখার জায়গা বলতে গেলে প্রায় কিছুই নেই - একটা গান্ধীঘাট আর তার পাশে একটা কালীমন্দির (কোনও অজ্ঞাত কারণে লোকে কালীমন্দিরকে 'কালীবাড়ি' বলে !) আছে । এই গান্ধীঘাটে যাওয়ার রাস্তাটা ব্যারেজের পাশ দিয়ে আর এখানে আরেকটা ছোট ব্যারেজ পেরোতে হয় । এটার নাম 'ফীডার ক্যানেল' । (পরে google map দেখে জেনেছি এই ফিডার ক্যানেল থেকেই আমাদের পশ্চিমবঙ্গের গঙ্গা বা ভাগীরথী-হুগলীর সৃষ্টি হয়েছে) এই ফিডার ক্যানেলের ওপর ৯ টা লক্‌গেট আছে - যেগুলো খোলা থাকায় প্রচন্ড জোরে গঙ্গা থেকে জল ফিডার ক্যানেলে প্রবেশ করছে । এখানেও ছবি তোলা বারণ । গান্ধীঘাটে যাওয়ার রাস্তাটা বেশ সুন্দর ।

গান্ধীঘাট
গান্ধীঘাটে পৌঁছলাম সাড়ে আটটার কিছু পরে । এখান থেকে ফারাক্কার ব্যারেজটা ভালই দেখা যায় । এখান থেকেও কিছু ছবি তুললাম । গান্ধীঘাটে কিছু লোকজন দেখলাম যারা পিক্‌নিক্‌ গোছের কিছু করতে গেছিল বোধহয় ।






কালী মন্দির (অথবা কালীবাড়ি !)
এখান থেকে গেলাম কালীমন্দিরে । মন্দিরটা বেশি পুরনো নয়, আর এখানে লোকজনও সেরকম আসে না, তাই বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন । এখানেও কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করে ফিরে এলাম । আমাদের এই পুরো ঘোরার জন্য ভ্যান নিল ৬০ টাকা ।






এরপর একটা মিষ্টির দোকানে পরোটা এবং মিষ্টি খাওয়া হল । খাবারের মান - এক কথায় চলনসই ।

ফারাক্কা ব্যারেজ
হোটেলে ফিরে চানটান করে নিলাম । আমাদের ফেরার ট্রেন কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসের সময় দুপুর ১:০৯ আর হোটেল থেকে চেক্‌আউট আগে আমাদের হাতে আরও ঘন্টাখানেকের বেশি সময় আছে দেখে একটু হেঁটে জায়গাটা ঘোরাঘুরি করলাম । এবার গেলাম গঙ্গার পুব দিকের পাড়ে । এখান থেকে ব্যারেজটা খুব স্পষ্ট দেখা যায় । সত্যি কথা বলতে কি, এখান থেকেই ব্যারেজটা সবথেকে ভালো দেখা যায় । আমরা এখান থেকে আরও কিছু ছবি তুললাম ।

এরপর ফেরার সময় এসে গেল । বারোটা নাগাদ হোটেলের পর্ব চুকিয়ে দিয়ে মালপত্র নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে স্টেশনের কাছে একটা খাবারের হোটেলে এলাম । এই হোটেলটা আগেরদিনের থেকে ভালো - খাবারের মান প্রায় একই কিন্তু দাম অনেকটাই কম । এখানে মাছ মাংস ভাত মিলিয়ে ২০৪ টাকা লাগল ।

এবার ফেরার পালা !
তারপর স্টেশনে এসে ট্রেনের জন্য অপেক্ষা । আসার সময়ে ট্রেন যেমন 'বিফোর টাইম' এ এসে গেছিল, ফেরার সময়ে সেরকম উদারতা দেখাল না । এল নির্ধারিত সময়ের প্রায় চল্লিশ মিনিট পরে আর শিয়ালদা পৌঁছল নির্ধারিত সময়ের একঘন্টা পরে । খেল্‌ খতম্‌ !




সারসংক্ষেপঃ

১. ফারাক্কা ঠিক একটা ঘুরতে যাওয়ার মতো জায়গা নয়, যদি ফারাক্কা ব্যারেজ সম্পর্কে আগ্রহ থাকে তবেই যাওয়া উচিৎ ।
২. ফারাক্কায় ঘোরার জায়গা প্রধানতঃ একটাই - ব্যারেজ । আর ব্যারেজ দেখতে চাইলে গাড়িতে বা রিক্সার ঘুরে লাভ নেই, হেঁটেই যাওয়া ভাল ।
৩. মূল ব্যারেজ ছাড়া ফীডার ক্যানেলটা আরেকটা দেখার মতো জায়গা । এখান থেকে যে জল ছাড়া হয়, সেটা থেকে আমাদের পশ্চিমবঙ্গের গঙ্গায় জল আসে ।
৪. এছাড়া দেখার জায়গা হল গান্ধীঘাট আর কালীমন্দির যেগুলোর কোনওটাই 'মাস্ট ওয়াচ্‌' নয় - তবে দেখে আসা যেতে পারে ।
৫. ফারাক্কায় খাবারের দাম একটু বেশি । বেশি অর্থাৎ দাম যতটা, খাবার সেই অনুপাতে ভালো নয় ।
৬. ফারাক্কায় একদিনের বেশি কোনও কারণেই থাকার কোনও মানে হয় না, এমনকি ছুটি কাটানোর জন্যও নয় ।
৭. ফারাক্কায় গেলে সূর্য্যাস্ত বা সূর্য্যোদয় (যদিও আমি দেখতে পাইনি) মিস্‌ করা একেবারেই উচিৎ নয় ।

উপসংহারঃ


চুম্বক !
দক্ষিণবঙ্গের সঙ্গে উত্তরবঙ্গের সংযোগের একমাত্র সেতু হল ফারাক্কা তাই বাণিজ্যিক বা যোগাযোগের দিক থেকে এর গুরুত্ব অপরিসীম । হোটেলের সামনে দিয়ে ৩৪ নং জাতীয় সড়ক দিয়ে সারাক্ষণ যাতায়াত করছে গাড়ি, লরি ট্রাক । সবমিলিয়ে বেশ শব্দমুখর জায়গা যে শব্দ রাত্রেও কমে না । ফারাক্কায় সাধারণতঃ কেউ ঘুরতে যায় না - আমরা সম্ভবতঃ একমাত্র ট্যুরিস্ট । ফারাক্কার প্রধান আকর্ষণ ফারাক্কা ব্যারেজ আর এই আকর্ষণই আমাদের টেনে নিয়ে গেছিল । (ঈশ্বর যেমন বিভিন্ন ভক্তদের বিভিন্ন মন্দিরে টানেন, অনেকটা সেরকমই বোধহয় !) যদি তোমার হাতে অল্প পুঁজি আর অল্প সময় থাকে আর সেইসঙ্গে ফারাক্কা ব্যারেজের বিশালতা আর uniqueness তোমাকে চুম্বকের মতো টানে, তাহলে যেদিন ইচ্ছে ফারাক্কা ভ্রমণের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে যাও !

ফারাক্কার আরও ছবি দেখতে হলে click here: