আমি ব্লগ লেখার খুব বেশি সমর্থক কোনওদিনও ছিলাম না, সত্যি কথা বলতে কি এখনও যে আছি তা নয় । তার একটা প্রধান কারণ আমার ধারণা ব্লগ লেখার থেকেও পড়া অনেক বেশি ক্লান্তিকর । অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, অনেক সময়ই পড়তে শুরু করে শেষ করা হয়ে ওঠে না । নিজের ধৈর্য এবং/অথবা আগ্রহের অভাবকে 'ঠিক আছে, বাকিটা পরে পড়ব' জাতীয় অজুহাত দিয়ে ঢেকে দিই - আর আমরা সবাই জানি সেই 'পরে' টা আর কখনওই আসে না । তো, এই কারণে আমি ঠিক করেছি আমার ব্লগকে কখনওই অন্যের ক্লান্তির কারণ ঘটাব না, আমার ব্লগের বিষয় হবে প্রধানতঃ ভ্রমণ । আমার মতো যেসব বাঙালিরা ঘুরতে ভালোবাসে, তাদের জন্য আমার ব্লগ হবে তথ্যের একটা উৎস । আমার নিজের একটা অভ্যেস আছে, কোনও জায়গায় বেড়াতে যাওয়ার আগে সেই জায়গাটা সম্পর্কে কিছুটা জেনে নেওয়ার চেষ্টা করি, আর ইন্টারনেট ঘাঁটতে গিয়ে আমার বরাবরই মনে হয়েছে যে ইন্টারনেটে লেখালেখি করার ব্যাপারে বাঙালিদের থেকে কুঁড়ে খুব কম শিক্ষিত জাতই আছে । আমার মতো যেসব বাঙালিরা আছে, যারা ইন্টারনেটে কোনো একটা ইংরিজীতে লেখা দেখলেই না পড়ার চেষ্টা করে, তাদের জন্য আমার ব্লগ সহায়ক হবে, এই বিশ্বাস নিয়ে শুরু করছি আমার ভ্রমণকাহিনী । আগেই বলে রাখি, আমি স্ট্যাটিসটিক্সের ছাত্র ছিলাম, তাই আমার ব্লগে তত্ত্বের থেকে তথ্যের দেখাই মিলবে বেশি ।

Sunday, October 12, 2014

দিল্লী – আগ্রা – জয়পুর ভ্রমণ

ছোটবেলায় 'বিখ্যাত ব্যবসায়ী' (বা নামান্তরে 'ভারতীয় ব্যবসায়', 'দ্য বিজনেস') খেলার কথা মনে পড়ে ? আমার যে বোর্ডটা ছিল তাতে 'আরম্ভ' থেকে বেরিয়ে প্রথম যে তিনটে জায়গার ওপর দিয়ে যেতে হত তাদের নাম দিল্লী – আগ্রা – জয়পুর । আর এগুলোর টিকিট একই রঙের হত (অর্থাৎ এই তিনটি জায়গা অধিকার করতে পারলে ভাড়া দ্বিগুণ হত) । সেই দিল্লী, আগ্রা আর জয়পুর ভ্রমণ নিয়েই আমার ব্লগের এবারের পোস্ট ।

দিল্লী ভ্রমণঃ

দিল্লী । ছোটবেলার ইতিহাস বই থেকে শুরু করে বড় হওয়ার পর খবরের কাগজ এবং অন্যান্য গণমাধ্যমে যে জায়গাটার নাম সবচেয়ে বেশি শোনা যায় সেই দিল্লী । দিল্লী বলতেই প্রথমে কি মনে আসে সেটা জিজ্ঞেস করলে এত লোক এত রকমের উত্তর দেয় (যেমন কেউ বলে দিল্লী মানে লাল কেল্লা, কেউ বলে দিল্লী মানে রাষ্ট্রপতি ভবন, কেউ বলে দিল্লী মানে পার্লামেন্ট, কেউ বলে দিল্লী মানে আই এস আই – আই আই টি আবার কেউ বলে দিল্লী মানে দিল্লী কা লাড্ডু যেটা কিনা ...) আর এর থেকেই বোঝা যায় দিল্লীর ভার্সেটাইলিটিটা ঠিক কতটা বেশি । ঠিক কবে থেকে জানি না, তবে দিল্লীর সিংহাসন, দিল্লীর মসনদের ওপর শাসকদের চিরকালীন আকাঙ্খা – আজ ২০১৪ সালেও একইভাবে বর্তমান ।

দিল্লী মানে যার কাছে যাই হোক না কেন, দিল্লী বলতে আমাদের মনে যেটা প্রথমেই এসেছিল সেটা হল রাজধানী এক্সপ্রেস । ঠিক হয়েছিল দিল্লী যখন যাচ্ছিই তখন সেটা রাজধানীতে হলেই সবচেয়ে ভালো হয় । জীবনে অন্ততঃ একবার রাজধানীতে চড়ার ইচ্ছে বোধহয় সব ভারতীয়রই থাকে – সে যেখানকার মানুষই হোক না কেন । টিকিট পাওয়া সহজ ছিল না, কিন্তু ভাগ্যক্রমে এ সি থ্রি টিয়ারের টিকিট পেয়ে গেছিলাম আই আর সি টি সি থেকে । ৫ ই অক্টোবর, ২০১৪ রবিবার শিয়ালদহ থেকে আমাদের ট্রেন ছাড়ল কাঁটায় কাঁটায় বিকেল ৪ টে ৫০ মিনিটে । এ'বার আমাদের দল ছ'জনের - আমি, আমার স্ত্রী অমৃতা, বাবা, মা আর আমার সহকর্মী কঙ্কনাদি, অমিতদা, মিনকা (শিশুশিল্পী) ।

রাজধানী এক্সপ্রেস - দিল্লী পৌঁছনোর কিছু আগে
ট্রেন ছাড়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই ট্রেনের ভেতরে যান্ত্রিক ঘোষণা শুরু হল । আমি এর আগে কোনওদিন ট্রেনের ভেতরে স্পীকার দেখিনি তাই ঘোষণা শুনে একটু অবাকই হলাম । ঘোষিকা হিন্দী এবং ইংরিজীতে আমাদের ট্রেনের সম্পর্কে কিছু তথ্য জানালেন যেমন – আমাদের ট্রেন মোট কতটা রাস্তা যাবে, সর্বোচ্চ কত গতিতে যাবে, যাত্রাপথে কোথায় কোথায় থামবে, ট্রেনে আমাদের কখন খাবার দেওয়া হবে ইত্যাদি । এখানে একটা কথা জানিয়ে রাখি আমি শুনেছিলাম যে রাজধানীর যাত্রাপথে নাকি প্রায় কখনওই হলুদ সিগন্যাল দেখানো হয় না, অর্থাৎ ট্রেন স্টেশনের কাছে ছাড়া কখনওই ধীরে ধীরে চলে না । এটা একটা ডাহা মিথ্যে কথা ! আমাদের ট্রেন ছাড়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই ধীরে ধীরে চলল এবং এই ব্যাপারটা পুরো রাস্তায় অনেকবার হয়েছে । স্টেশনবিহীন জায়গায় মাঝে মাঝে দাঁড়িয়েও গেছে । যাই হোক, আমাদের প্রথম খাবার দেওয়া হল দমদম পেরিয়ে যাওয়ার একটু পরে – এটা বিকেলের জলখাবার । যা দিয়েছিল, সেটা বিকেলের জলখাবার হিসেবে ভালোই । এছাড়া চা বা কফি । ডিনার দিল রাত আটটার একটু পরে । ডিনারে ভাত এবং রুটি দুইই দেয় আর সেইসঙ্গে ডাল, চিকেন ইত্যাদি । পরেরদিন সকালে ব্রেকফাস্ট । আমি মেনু লিখছি না তবে এটা বলতে পারি খাবার যা দেয় সেটা মোটামুটিভাবে পেট ভরার পক্ষে যথেষ্ট ।

আমাদের ট্রেনের গন্তব্যে পৌঁছনোর নির্ধারিত সময় সকাল ১০ : ২৫ হলেও সে পৌঁছল সাড়ে বারোটার পরে । মালপত্র নিয়ে আমরা নিউ দিল্লী স্টেশনের বাইরে বেরোলাম । স্টেশন চত্বর বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন এবং সাজানো গোছানো (হতেই হবে, দিল্লী বলে কথা !) । আমাদের বুকিং ছিল পাহাড়গঞ্জে আরাকাশান রোডে 'হোটেল লভ্‌-কুশ' এ - যেটা স্টেশন থেকে হেঁটে মিনিট দশেকের বেশি না । আমরা মালপত্র নিয়ে তিনটে রিক্সা করে হোটেলে পৌঁছলাম ।

হোটেলের ঘরগুলো যে খুব দারুণ কিছু তা নয়, তবে থাকার জন্য চলনসই । ঘরগুলোর প্রধান সমস্যা ঘরগুলো বেশ ছোট, তবে স্টেশনের খুব কাছে হওয়ায় আমরা এই হোটেলটা পছন্দ করেছিলাম । হোটেলে পৌঁছে চানটান করে ফ্রেশ হয়ে নিয়ে লাঞ্চের অর্ডার দিয়ে দেওয়া হল । এই হোটেলে কিন্তু খাবারের দাম একটু বেশিই । ভাত ডাল আলুভাজা চিকেন নিয়ে ছ'জনের মোট খরচ হল ১,৩৭৫ টাকা । খাবারের মান -ঠিকঠাক ।

রাজীব চক-এ
লাঞ্চের পর আমরা হোটেলের ম্যানেজারের সঙ্গে কথা বলে আমাদের পরেরদিনের সাইট সিয়িং-এর গাড়িটা ঠিক করে নিলাম । প্রথমদিন বিকেলে আমাদের আর করার বিশেষ কিছু নেই, তাই কোথায় যাওয়া যায় জিজ্ঞেস করে ম্যানেজারের থেকে জানতে পারলাম সোমবার দিল্লীতে বেশিরভাগ জায়গাই বন্ধ থাকে । তাই আমাদের সেভাবে কোথাও যাওয়ার নেই । আমরা নিজেরা রাজীব চকে (কনট প্লেসে) যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম । সেইমতো ১০০ টাকা করে দু'টো অটো ধরে আমরা যখন রাজীব চকে পৌঁছলাম তখন প্রায় সন্ধ্যে। রাজীব চক হচ্ছে দিল্লীর যাকে বলে অভিজাত এলাকা । জামাকাপড়ের বড় ব্র্যান্ডের শো-রুম থেকে শুরু করে কে এফ সি, পিৎজা হাট সবকিছুরই দোকান আছে এই অঞ্চলে । জায়গাটা বেশ সুন্দর করে সাজানো গোছানো এবং পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন । এখানে একটা হকার্স মার্কেটও আছে যেখানে জামাকাপড় শীতের পোষাক বেশ শস্তায় পাওয়া যায় । এছাড়া এই অঞ্চলে আছে 'পালিকা বাজার' যেখানে দরদাম করে কিনতে পারলে ভালো জিনিস পাওয়া যায় ।

দিল্লীতে এসে দিল্লীর মেট্রো চড়ব না ? ঠিক হল 'রাজীব চক্‌' থেকে মেট্রো চড়ে আমরা 'করোল বাগ' পর্যন্ত যাব । সময়টা বিকেলের অফিস টাইম, মেট্রো করে ঘোরার পক্ষে একেবারেই আদর্শ নয় । কিন্তু ভীড় আমাদের উৎসাহে বাধা দিতে পারল না । মাথাপিছু ১০ টাকার টিকিট কেটে আমরা ব্লু-লাইনের মেট্রোয় চড়লাম ।

গফফর মার্কেট
করোল বাগ রাজীব চক থেকে তিনটে স্টেশন পরে । করোল বাগে নেমে আমরা গেলাম এখানকার গফ্‌ফর মার্কেটে । মার্কেট বলতে একটা লম্বা রাস্তার ওপর সারি সারি দোকান যারা প্রধানতঃ জামাকাপড় ঢেলে বিক্রি করছে । আর দাম ভীষণরকমই কম । ৩০০ - ৩৫০ টাকায় জ্যাকেট পাওয়া যাচ্ছে । আমি এখান থেকে ১০০ টাকা করে দু'টো শার্ট কিনেছি আর তার মধ্যে একটা পরেরদিন পরেও দেখেছি । দিব্যি !

গফফর মার্কেট থেকে আবার ফেরার ট্রেন ধরে রাজীব চকে ফিরে এলাম । যাতায়াত দু'বারই ট্রেন বেশ ভীড় ছিল কিন্তু যেটা ভালো লাগল ভীড় থাকলেও ট্রেনে ওঠার জন্য কেউ মারামারি করে না । ট্রেনের ফ্রিকোয়েন্সি খুবই বেশি এবং ওঠানামার জন্য যাত্রীদের নিয়মানুবর্তিতা চোখে পড়ার মতো । দিল্লীতে মোট ছ'টা রঙের মেট্রো চলে - লাল, হলুদ, নীল, কমলা, সবুজ আর বেগুনি । আলাদা রঙের ট্রেন আলাদা রুটে চলে । কিছু কিছু জাংশন স্টেশনে দরকার মতো রঙ পরিবর্তন করে নেওয়া যায় (এই ব্যাপারটা আমার বেশ ভালো লেগেছে । রঙ পরিবর্তনের জন্য দিল্লীর থেকে ভালো জায়গা আর কি হতে পারে ?) ।

রাজীব চকে ফিরে এসে কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করে অল্প কিছু চাট্‌ ইত্যাদি খেয়ে নেওয়া হল । তারপর আবার অটো ধরে হোটেলে ফিরে এলাম । দুপুরে হোটেলের খাবার খুব একটা পছন্দ হয়নি বলে কাছাকাছি আরাকাশান রোডেই একটা হোটেলে যাওয়া হল । 'লোকনাথ রেস্ট্যুরেন্ট' । হোটেলের বাইরে বাংলায় লেখা দেখেই ভেতরে ঢুকলাম আর দেখলাম ভেতরে আরও বাঙালী রয়েছে । আরকাসান রোডের এই হোটেলে না খেতে যাওয়ার জন্যই সবাইকে বলব কারণ এদের বৈশিষ্ট্য হল দেরিতে সার্ভ করা । আমাদের অর্ডার ছিল রুটি আর চিকেন । এই সামান্য অর্ডার সার্ভ করতেই এরা দেড় ঘন্টা বসিয়ে রাখল । আর আমরাই একমাত্র লোক নই যাদের এরা দেরি করে সার্ভ করেছে ।

রাতে হোটেলে ফিরে এসে ঘুমিয়ে পড়লাম । পরেরদিন আমাদের দিল্লী ভ্রমণের দিন ।

৭ই অক্টোবর, ২০১৪ মঙ্গলবার । একটা এ সি ইনোভায় আমরা বেরোলাম দিল্লী ঘুরতে । দিল্লীতে ঘোরার জায়গা সবমিলিয়ে কম নয়, তবে একটা সুবিধে হল এর মধ্যে বেশিরভাগগুলোই কাছাকাছি । আমরা সকালে বেরিয়েছি সাড়ে দশটা নাগাদ, আমাদের প্রথম গন্তব্যে পৌঁছলাম ১১ টার একটু পরে ।

ইন্ডিয়া গেট
ইন্ডিয়া গেট
টিকিট - লাগে না
ফটো - তোলা যায়, চার্জ লাগে না
দিল্লীর সবচেয়ে আকর্ষণীয় দেখার জায়গাগুলোর একটা (মুম্বইতে আমরা যেটা দেখে এসেছি সেটা কিন্তু 'গেটওয়ে অফ্‌ ইন্ডিয়া' আর এটা 'ইন্ডিয়া গেট' । দু'টোর মধ্যে গুলিয়ে ফেললে চলবে না !) । প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ে যেসব ভারতীয়রা ব্রিটীশদের হয়ে যুদ্ধে প্রাণ দিয়েছিল এটা তাদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে ১৯২১ সালে তৈরি করা হয় । এখানে আমরা ভারতীয় সেনাবাহিনীর সৈন্যদের মার্চ করা দেখলাম । ইন্ডিয়া গেটের ভেতরে আছে 'অমর জওয়ান জ্যোতি' - সেই বিখ্যাত রাইফেল এবং তার ওপরে হেলমেট রাখা ।

রাষ্ট্রপতি ভবন
রাষ্ট্রপতি ভবন
টিকিট - লাগে না
ফটো - তোলা যায়, চার্জ লাগে না
ইন্ডিয়া গেটের থেকে বেরিয়ে রাজপথ ধরে সোজা এগোলেই 'রাষ্ট্রপতি ভবন' । এই রাস্তাটা একেবারে সোজা আর যত এগোনো যায় ততই রাষ্ট্রপতিভবনটা স্পষ্ট হয়ে যায় । একেবারে সামনে পৌঁছলে রাস্তাটা ঢালু হয়ে ওপর দিকে উঠে যায় । রাষ্ট্রপতিভবনের দু'পাশে মন্ত্রীদের অফিস । এই অঞ্চলে গাড়ি থামানো যায় না, তাই আমাদের গাড়ি একটা গোল চক্কর মারল । আমি এখানে নেমে কিছু ছবি তুলে নিলাম । (ভেতরে ছিলেন রাষ্ট্রপতি মাননীয় শ্রী প্রণব মুখোপাধ্যায় মহাশয় । আমরা এসেছি শুনে আমাদের চা খাওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন, কিন্তু আমাদের হাতে সময় কম ছিল বলে সবিনয়ে প্রত্যাখ্যান করতে হল ।)

লোকসভা ভবন
টিকিট - লাগে না
ফটো - তোলা যায়, চার্জ লাগে না
রাষ্ট্রপতি ভবন থেকে বেরোনোর সময়ে বাঁদিকে পড়ে লোকসভা ভবন । এখানে আমরা আর গাড়ি থেকে নামিনি কারণ গাড়িতে বসেই পুরোটা দেখা যায় । আর নামলেও ভেতরে ঢোকার নিয়ম নেই । তাই এগিয়ে চললাম পরবর্তী গন্তব্যের দিকে ।

গান্ধী মিউজিয়ামে গান্ধিজীর চরকা
গান্ধী মিউজিয়াম
টিকিট - লাগে না
ফটো - তোলা যায়, চার্জ লাগে না
লোকসভা ভবন থেকে অল্প দূরে মহাত্মা গান্ধীর বাসস্থান । জায়গাটা খুব সুন্দরভাবে সাজানো এবং সেইসঙ্গে গান্ধীজীর জীবনের বিভিন্ন ঘটনা, ব্যবহৃত আসবাবপত্র ইত্যাদি নিয়ে সংগ্রহশালা । বিভিন্ন মডেলের সাহায্যে গান্ধীজীর নীতি আদর্শের ব্যাখ্যা করা হয়েছে । এগুলো বেশ ইন্টার‍্যাকটিভ ।

ইন্দিরা গান্ধী মিউজিয়াম
ইন্দিরা গান্ধী মিউজিয়াম
টিকিট - লাগে না
ফটো - তোলা যায়, চার্জ লাগে না
গান্ধী মিউজিয়াম থেকে অল্প দূরে ইন্দিরা গান্ধীর বাসস্থান । পরবর্তীকালে রাজীব গান্ধীও এখানেই থাকতেন । এখানে ইন্দিরা গান্ধী এবং রাজীব গান্ধীর ব্যবহৃত আসবাবপত্র, জিনিসপত্র রাখা আছে । রাজীব গান্ধীর একটা কম্পিউটার ছিল যেটাকে আসলে একটা ল্যাপটপ বলাই ভাল । আজ থেকে প্রায় ২৫ বছর আগে, যখন ভারতের বেশিরভাগ মানুষ কম্পিউটার কি, তাইই জানত না, সেই সময়ে রাজীব গান্ধী একটা ল্যাপটপ নিয়ে প্লেনে বসে কাজ করছেন সেই ছবি দেখে বেশ অবাক হলাম । এছাড়া এই মিউজিয়ামে আরেকটা জিনিস রাখা আছে সেটা হল রাজীব গান্ধীর পাওয়া 'ভারতরত্ন' পুরষ্কার । এই জিনিস চট্‌ করে চোখের সামনে দেখার সুযোগ হয় না (যতক্ষণ না আমি নিজে পাচ্ছি !) তাই এটা ভালো করে দেখে নিলাম ।

রাজীব গান্ধী যখন বোমা বিস্ফোরণে মারা গিয়েছিলেন, তখন তাঁর পোশাকের যে ছিন্নভিন্ন অংশগুলো পাওয়া গেছিল, সেগুলোও এখানে রাখা আছে । রাজীব গান্ধীকে যখন হত্যা করা হয়েছিল তখন আমি বেশ ছোট, কিন্তু ঘটনাটা আর সেইসঙ্গে টিভিতে দেখানো দৃশ্যগুলো আমাকে যে বেশ নাড়া দিয়েছিল, সেটা এখনও মনে আছে ।

মিউজিয়াম থেকে বেরিয়ে সেই অংশটা দিয়ে যেতে হয় যেখানে নিজের দেহরক্ষীর গুলিতে মারা গিয়েছিলেন ইন্দিরা গান্ধী । জায়গাটাকে একটা ফাইবারের শেড দিয়ে আলাদা করা আছে । ঘটনাটা ঠিক কখন কিভাবে ঘটেছিল, সেটার একটা সংক্ষিপ্ত বিবরণও এখানে লেখা আছে ।

কুতুব মিনার
কুতুব মিনার
টিকিট - মাথাপিছু ১০ টাকা (১৫ বছরের উর্ধ্বে)
ফটো - তোলা যায়, চার্জ লাগে না
৭৩ মিটার উঁচু কুতুব মিনার ভারতের দ্বিতীয় উচ্চতম মিনার । ১২০০ খ্রীষ্টাব্দে দিল্লীর প্রথম মুসলিম শাসক কুতুব-উদ্‌-দিন আইবকের সময়ে শুরু হয়ে এর নির্মাণ শেষ হয় ১৩৬৮ খ্রীষ্টাব্দে ফিরোজ শাহ তুঘলকের আমলে । বর্তমানে 'ভারতীয় পুরাতত্ত্ব বিভাগ' এর রক্ষণাবেক্ষণ করে । আর এই কারণেই জায়গাটা যথেষ্ট পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ওয়েল মেইনটেইন্ড । এর ভেতরে দিয়ে ওপরের ওঠার সিঁড়ি থাকলেও দর্শনার্থীদের ওপরে ওঠার নিয়ম নেই ।

কুতুব মিনারের পাশেই আছে লৌহ স্তম্ভ । এই স্তম্ভের বৈশিষ্ট্য হল সম্পূর্ণ লোহা দিয়ে তৈরি হওয়া সত্ত্বেও এত বছরের এতে একটুও মরচে ধরেনি ।

কুতুব মিনারে পাশে দাঁড়িয়ে ছবি তোলার সময়ে সবাইই মিনারের মাথায় হাত দিয়ে একটা করে ছবি তোলে । এই ব্যাপারটা বেশ কমন্‌ হয়ে গেলেও প্রচুর লোক করে । আমরাও করেছি !

এরপর ড্রাইভার আমাদের নিয়ে গেল একটা হোটেলে - লাঞ্চের জন্য । আমরা সবসময়েই শুনে থাকি যে এইসব হোটেলের সঙ্গে ড্রাইভারদের যোগসাযোগ থাকে আর এখানকার খাবারের দাম দেখে সেটা আরও বেশি করেই মনে হচ্ছিল । খাবারের মান বেশ ভালো হলেও দাম বেশ চড়া । শুধুমাত্রা ভাত আর চিকেনের কিছু ডিশ নিয়ে আমাদের মোট খরচ পড়ল মোট ১,৫৭৫ টাকা ।

বিকেল চারটে বাজে । আমাদের হাতে যা সময় আছে তাতে দিল্লীর সব জায়গাগুলো দেখার আশা ত্যাগ করতে হবে । ঠিক হল আমরা এখন অক্ষরধাম মন্দির যাব আর যাওয়ার পথে লোটাস মন্দির দেখে নেব ।

লোটাস মন্দির
লোটাস মন্দির
টিকিট - লাগে না
ফটো - বাইরে থেকে তোলা যায়, ভেতরে ঢুকে তোলার জন্য অনুমতি প্রয়োজন
আমরা রাস্তা থেকেই লোটাস টেম্পল দেখে নিলাম কারণ এর ভেতরে যাওয়ার সেরকম কোনও মানে হয় না । বিশেষ করে রাস্তা থেকেই এখানে ঢোকার যা লাইন দেখলাম তাতে ঢোকার ইচ্ছে সম্পূর্ণভাবেই চলে গেল । আর সত্যি বলতে কি, এখানে ঢুকে দেখার সেরকম কিছু নেই । বাইরে থেকে যা দেখা যায়, ভেতরে ঢুকেও প্রায় সেরকমই । রাস্তার ধার থেকে ছবিটবি তুলে আমরা এগিয়ে চললাম আমাদের পরবর্তী গন্তব্যের দিকে ।

অক্ষরধাম মন্দির
অক্ষরধাম মন্দির
টিকিট - লাগে না
ফটো - তোলা যায় না
অক্ষরধাম মন্দিরের কোনও ঐতিহাসিক গুরুত্ব নেই, তবে সম্পূর্ণভাবে মার্বেলে তৈরি এবং খুবই সুন্দর । এখানে ভেতরে ক্যামেরা, মোবাইল, ব্যাগ (মানিব্যাগ ছাড়া) কিছুই নিয়ে যাওয়া যায় না । মন্দিরটা ভগবান স্বামীনারায়ণের উদ্দেশ্যে তৈরি । ভেতরে তাঁর মূর্তি ইত্যাদি রয়েছে । মন্দিরের কারুকার্য অত্যন্ত সুন্দর এবং চিত্তাকর্ষক ।

মন্দির থেকে বেরোনোর পথের সামনে একটা ফুডকোর্ট রয়েছে । মন্দির চত্বরে হেঁটে হেঁটে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম তাই এই ফুডকোর্ট থেকে মিল্ক শেক, লস্যি ইত্যাদি খেয়ে ক্লান্তি দূর করে নিলাম (তার মানে এই নয় যে ক্লান্ত না হয়ে খেতাম না !)

লালকেল্লা
সন্ধ্যে সাতটা বাজে, আমাদের ঘোরাঘুরি মোটামুটি এখানেই শেষ করে দিতে চাইছিল আমাদের ড্রাইভার । সন্ধ্যে ছ'টায় বন্ধ হয়ে গেছে জেনেও আমরা একরকম জোর করেই 'লাল কেল্লা' নিয়ে যেতে বললাম । লালকেল্লা পুরোনো দিল্লীতে পড়ে যেটা কিছুটা অপরিষ্কার এবং তার থেকেও বড় কথা ঘিঞ্জি । গিয়ে বুঝলাম আমাদের ড্রাইভার কেন এখানে আসতে চাইছিল না । রাস্তায় বেশ যানজট - গাড়ি এগোতে সময় লাগে । সন্ধ্যের পরে এখানে নাকি কোনও ড্রাইভারই আসতে রাজী হয় না । আমাদের কাছে এসব কথার কোনও মানে হয় না, কারণ আমাদের সময়সীমা এখনও শেষ হয়নি আর ভেতরে যেতে না পারলেও বাইরে থেকে লালকেল্লা না দেখার কোনও কারণ নেই । যাতায়াত মিলিয়ে দেড়ঘন্টার বেশি সময়ে ব্যয় করে আমরা লালকেল্লা দেখে এলাম । গাড়ি থেকে নেমে কোনও লাভ নেই বলে গাড়িতে বসেই দেখলাম । বলা যেতে পারে শুধু চোখের দেখাই হল, কিন্তু হল । সারাদিনের দিল্লী ঘোরার জন্য আমাদের গাড়ি নিল মোট ২,৫০০ টাকা ।

আমাদের যে যে উল্লেখযোগ্য জায়গাগুলো দেখা হল না তার মধ্যে আছে - জামা মসজিদ, শক্তিস্থল, বিজয় ঘাট, রাজ ঘাট, যন্তর মন্তর, বিড়লা মন্দির ইত্যাদি । এগুলোর জন্য আমাদের আরেকবার দিল্লী আসতে হবে ।

হোটেলে ফিরে একটু পরে খেতে বেরোলাম । আগেরদিনের হোটেলটা একেবারেই সুবিধের ছিল না তাই স্টেশনের দিকে হাঁটলাম । যেটা পাওয়া গেল সেটা একটা অত্যন্ত সাধারণ ভাতের হোটেল যদিও সেখানে বিরিয়ানি থেকে শুরু করে সবই পাওয়া যায় । বাকিরা রুটি, চিকেন কারি, পনীর বাটার মশালা ইত্যাদি খেল আর আমি দিল্লীর বিরিয়ানি নিলাম । একটা বিরিয়ানি একজনের জন্য বেশি (হ্যাঁ, আমার জন্যও !) যদিও ভেতরে প্রচুর মাংস ছিল । সবমিলিয়ে খরচ পড়ল ৫৩৫ টাকা । রাতে হোটেলে এসে শুয়ে পড়লাম । আমাদের 'দিল্লী ভ্রমণ' এখানেই শেষ - পরবর্তী গন্তব্য আগ্রা ।

সারসংক্ষেপঃ

১. কলকাতা বা হাওড়া থেকে দিল্লী যাওয়ার অনেক ট্রেন আছে, তবে রাজধানী হচ্ছে সবচেয়ে ঘ্যাম ট্রেন । বিকেলে প্রায় একই সময়ে শিয়ালদহ এবং হাওড়া থেকে রাজধানী ছাড়ে যা পরেরদিন সকালে প্রায় একই সময়ে নিউ দিল্লী পৌঁছয় ।
২. দিল্লীতে যেখানে খুশি থাকা যেতে পারে, তবে ভোরের ট্রেন ধরতে সুবিধে হবে বলে আমরা স্টেশন থেকে খুব কাছে পাহাড়গঞ্জে আরাকাশান রোডে 'হোটেল লভ্‌-কুশ' এ ছিলাম । এখানকার ভাড়া বেশ কম, যদিও ঘরগুলোও বেশ ছোট । http://hotel.makemytrip.com/makemytrip/site/hotels/ থেকে এদের বুকিং করা যায় অথবা ফোনে এদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করা যায় । ফোন নম্বর - 011-23511376.
৩. দিল্লীতে অনেকগুলো জায়গা সোমবার বন্ধ থাকে । দিল্লী ভালোভাবে ঘোরার জন্য একদিন যথেষ্ট নয়, তাই সোমবারের ব্যাপারটা মাথায় রেখে পরিকল্পনা করলে ভালো হয় ।
৪. দিল্লীর মেট্রো রেলওয়ে একটা অত্যন্ত উপযোগী পরিবহন ব্যবস্থা । যদি গাড়ির আরামটা উপেক্ষা করা যায়, তাহলে দিল্লী ঘোরার জন্য মেট্রো হচ্ছে আদর্শ । প্রায় সবক'টা দেখার জায়গার কাছাকাছিই মেট্রোর স্টেশন আছে আর স্টেশন থেকে অটো ধরে অনায়াসে গন্তব্যে পৌঁছে যাওয়া যায় ।এই ব্যবস্থায় খরচ অনেক কম ।
৫. দিল্লীতে দেখার জায়গাগুলোর মধ্যে ইন্ডিয়া গেট, কুতুব মিনার, রাষ্ট্রপতি ভবন, লোকসভা ভবন, লোটাস টেম্পল, অক্ষরধাম টেম্পল, রাজঘাট, হুমায়ুন সমাধি, যন্তর মন্তর, লাল কেল্লা, জামা মসজিদ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য । দিল্লী ঘোরার জন্য দিল্লী ট্যুরিজমের সঙ্গে যোগাযোগ করা যেতে পারে । এদের ওয়েবসাইট http://www.delhitourism.gov.in/delhitourism/index.jsp আর ফোন নম্বর 011-24647005, 24698431, 24618026 ।
৬. দিল্লীতে খাবাদের দাম একটু বেশির দিকেই । মোটামুটি চলনসই জায়গা থেকে খেতে গেলেও সারাদিনে মাথাপিছু ৫০০ টাকার বেশি খাবার খরচ পড়ে যায় ।

আগ্রা ভ্রমণঃ

দিল্লী থেকে আগ্রা অনেকভাবেই যাওয়া যায় আর সারাদিনে অনেক ট্রেন আছে । আমরা 'ভূপাল শতাব্দী' পছন্দ করেছিলাম । নিউ দিল্লী থেকে সকাল ছ'টায় ছেড়ে আগ্রা ক্যান্টনমেন্ট পৌঁছয় সকাল ৮ : ০৬ এ । দিল্লীর হোটেল থেকে স্টেশন হাঁটাপথ - ৮ই অক্টোবর ২০১৪, বুধবার সকালে হেঁটেই আমরা পৌঁছলাম স্টেশনে । নির্ধারিত সময়ে ট্রেন ছাড়ল । শতাব্দী ভারতীয় রেলের অন্যতম সেরা ট্রেন, এখানেও ব্যবস্থা রাজধানীর মতো । ট্রেন ছাড়ার পরেই মাইকে ঘোষণা, একটু পরে ব্রেকফাস্ট - সবই পাওয়া গেল । যাত্রাপথের বিবরণ দেওয়ার কিছু নেই, সাড়ে আটটা নাগাদ আমরা আগ্রা ক্যান্টে পৌঁছলাম ।

আগ্রায় দু'টো স্টেশন - 'আগ্রা ক্যান্ট' আর 'আগ্রা ফোর্ট' । আমাদের হোটেল আগ্রা ফোর্টের একেবারে পাশে । আগ্রা ক্যান্ট থেকে আগ্রা ফোর্ট ৪ - ৫ কিলোমিটার দূরে । স্টেশনে প্রি-পেইড ট্যাক্সি বুথ আছে, সেই সঙ্গে নানারকম জায়গায় যাওয়ার রেট চার্ট আছে । সেখান থেকে ট্যাক্সি নিয়ে আমরা গেলাম আমাদের 'হোটেল অজয় ইন্টারন্যাশনাল'-এ । যাওয়ার সময়ে ড্রাইভারের কথায় মনে হল এরা কেউই অজয় ইন্টারন্যাশনালকে পছন্দ করে না । আমরা ইন্টারনেটে রিভিউ পড়ে এই হোটেল বুক করেছি, তাই কিছুটা অবাক হলাম । এই অপছন্দের কারণ পরে বুঝেছিলাম, সেটা পরেই লিখব ।

'অজয় ইন্টারন্যাশনাল' আগ্রা ফোর্ট স্টেশনের একেবারে পাশে । হোটেলটা রাস্তার ওপরে আর এই রাস্তায় প্রচুর দোকানপাট - তাদের মধ্যে মশলাপাতির দোকানই বেশি । জায়গাটা বেশ কোলাহলপূর্ণ । কিন্তু হোটেলে ঢুকে তিনতলার ঘরে পৌঁছে আমাদের ধারণা বদলে গেল । রাস্তার আওয়াজ তিনতলায় এসে পৌঁছয় না । ঘরের সামনে একটা বেশ বড় ছাদ । এই ছাদ থেকে আগ্রা ফোর্ট স্টেশন এবং স্টেশনের ওপারে আগ্রা ফোর্টের পাঁচিল দেখতে পাওয়া যায় । আমরা তিনতলায় তিনটে ঘর নিয়েছিলাম ।

হোটেলে পৌঁছেই আমাদের যেটা করতে হল সেটা হল 'পূর্ণিমার রাতে তাজমহল দর্শন'-এর টিকিট সংগ্রহের জন্য বেরোনো । সবার যাওয়ার দরকার নেই, আমি আর অমিতদা বেরোলাম । একটা অটো নিয়ে আমাদের যেতে হল আগ্রায় 'ভারতীয় পুরাতত্ত্ব বিভাগ'-এর অফিসে । পূর্ণিমার রাতে তাজমহল দেখার ব্যাপারটা অনেকেই জানে । ৮ই অক্টোবর ২০১৪, পূর্ণিমার দিন । ভারতীয় পুরাতত্ত্ব বিভাগ পূর্ণিমার রাত ছাড়াও দু'দিন আগে এবং দু'দিন পরে রাতের তাজমহল দেখার ব্যবস্থা করে । অর্থাৎ অক্টোবর মাসে ৬, ৭, ৮, ৯ এবং ১০ । এর মধ্যে ১০ তারিখ আবার শুক্রবার, তাজমহল বন্ধ থাকে । রাতের তাজমহল দেখার টিকিট পুরাতত্ত্ব বিভাগের অফিস থেকে কাটতে হয়, প্রত্যেকের আসল পরিচয়পত্র (ভোটার আই-কার্ড ইত্যাদি তবে প্যানকার্ড নয়) দেখিয়ে এবং পরিচয়পত্রের ফোটোকপি জমা দিয়ে । টিকিটের দাম ৫১০ টাকা । রাত সাড়ে আটটা থেকে দেখানো শুরু হয় এবং আধঘন্টার স্লটে ৪০ জনের একেকটা দলকে ঢুকতে হয় । আমরা সাড়ে আটটার টিকিট কাটলাম । তার মানে রাত সাড়ে আটটা থেকে ন'টা পর্যন্ত আমরা চাঁদের আলোয় তাজমহল দেখতে পাব । এখানে আরেকটা তথ্য দেওয়া খুবই দরকার । পুরাতত্ত্ব বিভাগের অফিসে কিন্তু দিনের দিন টিকিট পাওয়া যাবে না, পরেরদিনের টিকিট পাওয়া যাবে । অর্থাৎ ৮ই অক্টোবর আমরা পেলাম ৯ই অক্টোবরের তাজমহল দেখার টিকিট । এটা একটা খুবই দরকারী তথ্য । আমরা যখন টিকিটের লাইনে দাঁড়িয়েছিলাম তখন অনেককেই ফিরে যেতে দেখেছি শুধুমাত্র এই তথ্যটা তাদের জানা ছিল না বলে - ফলস্বরূপ তাঁদের হোটেল বুকিং এবং অন্যান্য ব্যবস্থা করা ছিল না ।

টিকিট কেটে আবার হোটেলে ফিরে এলাম । দু'টো অটো ঠিক করা হল যারা আমাদের আগ্রা ঘুরিয়ে দেখাবে । হোটেলে এসে চানটান করে লাঞ্চ করে বেরোতে বেরোতে প্রায় দু'টো বেজে গেল । বেরিয়ে প্রথমেই গেলাম - হ্যাঁ, তাজমহল ।

তাজমহল
টিকিট - মাথাপিছু ২০ টাকা (১৫ বছরের উর্ধ্বে)
ফটো - তোলা যায়, চার্জ লাগে না
তাজমহল । শাহজাহানের ভালোবাসার তাজমহল, মুমতাজের সমাধি তাজমহল, শ্বেতপাথর দিয়ে তৈরি অসাধারণ স্মৃতিসৌধ তাজমহল, মুঘল আমলের অনবদ্য কীর্তি তাজমহল, পৃথিবীর সপ্ত-আশ্চর্যের সেরা তাজমহল, বিদেশীদের থেকে ভারত সরকারের আয়ের অন্যতম প্রধান উৎস তাজমহল ।
তাজমহল ঘোরা নিয়ে ব্লগের একটা আলাদা পোস্ট হয়ে যায়, কিন্তু আমি কোনও কিছু নিয়েই বাড়াবাড়ি করতে চাই না ।

তাজমহল
তাজমহল, বলা বাহুল্য, ভারতীয় পুরাতত্ত্ব বিভাগ দেখাশোনা করে । আমরা দক্ষিণ দিকের গেট দিয়ে ঢুকেছিলাম । এছাড়া আছে পূর্ব ও পশ্চিমদিকের গেট । সবক'টা গেট দিয়েই একই জায়গায় পৌঁছনো যায় । এই জায়গা থেকে আরেকটা দ্বিতীয় গেট আছে যেটা দিয়ে মূলচত্বরে ঢোকা যায় । এই গেটটা দিয়ে ঢুকে তাজমহলকে একেবারে সোজাসুজি দেখা যায় । সামনে সেই জলাশয় যেখানে তাজমহলের প্রতিবিম্ব দর্শকদের মুগ্ধ করে । পুরো জায়গাটাই বেশ ভালো ভীড়, কিন্তু এই গেটের পরের জায়গাটা সাংঘাতিক ভীড় । এই ভীড়ের পরিমাণ এমনই বেশি যে, চাইলেও অন্য কাউকে না নিয়ে শুধুমাত্র তাজমহলের কোনও ছবি তোলা সম্ভব নয় ।

আমরা এগিয়ে চললাম তাজমহলের দিকে । দু'দিকের বাগান, সুন্দর করে কাটা ঘাস - সবই সুন্দর । ভেতরে জুতো পরে ঘোরা যায়, শুধুমাত্র তাজমহলের ওপরে জুতো পরে ওঠা যায় না । এ'জন্য কোনও পয়সা দিয়ে জুতো রাখার দরকার নেই, তাজমহলে ওঠার ঠিক সামনেই কর্তৃপক্ষ জুতো জমা রাখার ব্যবস্থা করেছে । সেখানে জুতো খুলে আমরা উঠে পড়লাম তাজমহলের ওপরে ।

তাজমহলের পিছনে যমুনা নদী
তাজমহল সত্যিই খুব সুন্দর । সম্পূর্ণভাবে মার্বেল দিয়ে তৈরি এই নির্মাণ শুধুমাত্র ঐতিহাসিক দিক থেকেই নয়, সৌন্দর্য্যের দিক থেকেও অসাধারণ । আমরা তাজমহলের পিছন দিকে পৌঁছলাম । সেখান দিয়ে বয়ে চলেছে যমুনা নদী । যমুনা নদী বিভিন্ন জায়গায় শুকিয়ে গেলেও এই জায়গাটায় কিছুটা জল আছে । বিকেল প্রায় চার‍টে বাজে, সূর্য্য আস্তে আস্তে নেমে যাচ্ছে - এই আলোয় সবমিলিয়ে খুব ভালো লাগছিল ।

কথিত আছে, যমুনার অন্যপারে এই জায়গায় ঠিক তাজমহলের অনুকরণে আরেকটা তাজমহল নির্মাণ করতে চেয়েছিলেন শাহজাহান - পার্থক্য হল সেটা হত কালো পাথরের । শাহজাহানের ইচ্ছে ছিল তাঁর মৃত্যুর পরে তাঁকে সেখানে সমাধিস্থ করা হবে । কিন্তু ছেলে ঔরঙ্গজেব শাহজাহানকে বাধা দেন এবং 'কালো তাজমহল'-এর পরিকল্পনাটির এখানেই সমাপ্তি ঘটে । কিন্তু এই ঘটনার কোনও ঐতিহাসিক প্রমাণ নেই বলে অনেকেই একে স্বীকার করেন না । তবে তাজমহলের মতো একটা দূর্দান্ত শিল্পকীর্তির সঙ্গে এরকম একটা মুখরোচক গল্প লোকে বেশ খায় !

ঔরঙ্গজেব বাধ সেধেছিলেন বলে শাহজাহানের আর যমুনার ওপারে প্রকল্পিত কালো তাজমহলে সমাধিস্থ হওয়া হয়নি । শাহজাহানকে সমাধিস্থ করা হয় তাজমহলের মধ্যেই - মুমতাজের সমাধির পাশে । আমরা তাজমহলের ভেতরে ঢুকে সেই সমাধিগুলো দেখলাম (আসল সমাধি দেখা যায় না, তার প্রতিলিপি দেখা যায়) ।

আমরা মহারাষ্ট্র ভ্রমণ-এর সময়ে ঔরঙ্গাবাদে দাক্ষিণাত্যের তাজমহল 'বিবি কা মক্‌বারা' দেখেছি, এবার আসলটা দেখলাম । এটা ঠিক যে ওটার সঙ্গে এটার কোনও তুলনাই হয় না । কিন্তু আমি ওখানে যে কথাটা লিখেছিলাম, সেটা এখানে আরেকবার তুলে দিচ্ছি ।

আমি ব্যক্তিগতভাবে তাজমহলের থেকে বিবি কা মক্‌বারাকে বেশি নম্বর দেব আর সেটা ঐতিহাসিক কারণে । আকবরের তৈরি করা অর্থভান্ডার শাহজাহান প্রায় নিঃশেষ করেছিলেন নিজের বিলাসিতা এবং শিল্পনির্মাণে । আর এই বিপুল অর্থভান্ডারের একটা বড় অংশ ব্যয় হয় তাজমহল তৈরিতে । সেদিক দিয়ে দেখতে গেলে বিবি কা মকবারা যখন ঔরঙ্গজেব তৈরি করান, তখন মুঘল সাম্রাজ্যের অর্থভান্ডার তলানিতে । সেইজন্যই হয়তো বিবি কা মক্‌বারার শুধু নিচের দিকটাই মার্বেল দিয়ে তৈরি । মুঘল সাম্রাজ্যের সেই ভরাডুবির সময়ে তাজমহলের আদলে আরেকটা স্মৃতিসৌধ তৈরি করার চেষ্টা করাটা রীতিমতো দুঃসাহসের পরিচয় !

আমাদের তাজমহল দেখা শেষ দিনের আলোয় তাজমহল দেখা শেষ, তাই আমরা বেরিয়ে পড়লাম আমাদের পরবর্তী গন্তব্যের দিকে ।

আগ্রা ফোর্ট
আগ্রা ফোর্ট
ঢোকার টিকিট - মাথাপিছু ২০ টাকা (১৫ বছরের উর্ধ্বে)
লাইট অ্যান্ড সাউন্ডের টিকিট - মাথাপিছু ৫০ টাকা (১২ বছরের উর্ধ্বে)
ফটো - তোলা যায়, চার্জ লাগে না
১৫২৬ সালে প্রথম পানিপথের যুদ্ধের পরে বাবর ইব্রাহিম লোদীর কাছ থেকে আগ্রা ফোর্ট দখল করে নেন । এর অন্য নাম লাল কেল্লা (ইব্রাহিম লোদীর কাছ থেকে কেল্লা দখলের সময়ে বাবর এই কেল্লার অর্থভান্ডারও দখল করেন । এই অর্থভান্ডারে বহু ধনরত্নের সঙ্গে ছিল কোহ-ই-নূর হীরে) । এরপর মুঘল আমলে আগ্রা ফোর্টকে আরও বড় করে তৈরি করা হয় । বর্তমানে আগ্রা ফোর্টের বেশিরভাগ অংশটাই ভারতীয় সামরিক বাহিনীর জায়গা - এক চতুর্থাংশই শুধুমাত্র ট্যুরিস্টদের জন্য খোলা আছে (তবে একটা কেল্লার এক চতুর্থাংশ মানেও অনেকটা, সেটা ঘোরার সময়ে বুঝলাম) ।

আগ্রা ফোর্টের ভেতরে
১০০ টাকা দিয়ে একজন গাইড নেওয়া হল । সে আমাদের শিশু জাহাঙ্গীরের চান করবার বাথটব থেকে শুরু করে পাকশালা, কোষাগার, দেওয়ান-ই-আম, দেওয়ান-ই-খাস, মীনা বাজার সবই দেখাল । দিল্লী দখলের আগে আকবরের রাজধানী ছিল এই আগ্রা এবং তার মধ্যে আগ্রা ফোর্ট । তাই এই জায়গা ঐতিহাসিক দিক থেকে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ । আগ্রা ফোর্টও যমুনার একেবারের ধারে, তাই আগ্রা ফোর্টের বিভিন্ন জায়গা থেকে তাজমহল দেখা যায় । দিল্লীর সিংহাসন দখল করার পরে ঔরঙ্গজেব শাহজাহানকে এই আগ্রা ফোর্টেই নজরবন্দী করে রেখেছিলেন । অর্থাৎ কেল্লার ভেতরে ঘোরাঘুরির জন্য শাহজাহানের অনুমতি ছিল কিন্তু বাইরে বেরোতে পারতেন না । এখানে বসে বসে তিনি তাজমহলের দিকে তাকিয়ে থাকতেন আর দীর্ঘশ্বাস ফেলে অপেক্ষা করতেন নিজের মৃত্যুর জন্য (শেষেরটা অবশ্য আমি যোগ করলাম একটু নাটকীয়তা আনার জন্য) ।

দেওয়ান-ই-আম
লাইট অ্যান্ড সাউন্ড শো শুরু হয় সন্ধ্যে সাতটা থেকে । সাতটা থেকে আটটা হিন্দী আর আটটা থেকে ন'টা ইংরিজী । আমরা হিন্দীটাই নিয়েছিলাম । শো-টা খুব ইন্টারেস্টিং না হলেও খুব ইনফরমেটিভ । সবমিলিয়ে মন্দ নয়, বেশ সময় কেটে যায় । প্রধান ধারাভাষ্যের গলাটা প্রখ্যাত চলচ্চিত্রাভিনেতা নাসিরউদ্দীন শাহ-এর, এ'ছাড়াও বেশ কিছু চেনা গলা ছিল । লাইট অ্যান্ড সাউন্ড দেখে যখন হোটেলে ফিরলাম তখন সাড়ে আটটা বেজে গেছে । আগ্রায় সাইট সিয়িং-এর জন্য দু'টো অটো আমাদের কাছ থেকে ১,২০০ টাকা নিল ।

হোটেল 'অজয় ইন্টারন্যাশনাল' অজয় ভার্গব ও অনিল ভার্গব নামে দুই যমজ ভাই চালান । আমরা হোটেলে ফেরার পর পরেরদিনের 'ফতেপুর সিক্রি' যাওয়ার গাড়ি বুক করার জন্য অজয় ভার্গবের সঙ্গে কথা বললাম । ওনার ঘরে আমরা বেশ অনেকক্ষণ বসেছিলাম আর সেইসঙ্গে অনেক গল্প হল । ওনার কাছ থেকে কিছু দরকারি তথ্য জানলাম যা শুধু আগ্রা নয়, যেকোনও জায়গায় ঘুরতে গেলেই আমাদের কাজে লাগতে পারে ।

কথাবার্তা হিন্দীতেই হয়েছিল, আমি এখানে বাংলা করে দিচ্ছি ।
আমরা জিজ্ঞেস করেছিলাম - পরেরদিন ফতেপুর সিক্রিতে গেলে আমরা কোথায় খাওয়াদাওয়া করব ?
উনি বললেন - ড্রাইভার সাধারণতঃ সেইসব জায়গাতেই নিয়ে যায় যেখানে তাদের কমিশন থাকে । আপনারা চাইলে সেসব জায়গাতে যেতেও পারেন অথবা যাওয়ার পথে যদি কোনও ভালো হোটেল চোখে পড়ে, ড্রাইভারকে ফেরার সময়ে সেখানেও নিয়ে যেতে বলতে পারেন । কিন্তু একটা বিষয়ে খেয়াল রাখবেন । এইসব হোটেলগুলোয় সাধারণতঃ দু'তিনটে মেনুকার্ড থাকে । একই লেখা, একই আইটেম শুধু দাম আলাদা । আপনি হয়তো চায়ের অর্ডার দিলেন মেনুকার্ডে ২০ টাকা দাম দেখে, বিল যখন এল তখন দেখলেন দাম ৩০ টাকা । আপনি মানলেন না । মেনু কার্ড দেখতে চাইলেন । ওরা তখন আপনাকে ডুপ্লিকেট মেনুকার্ডটা দেখাবে । আপনি কনফিউসড হয়ে যাবেন ।
আমরা মুগ্ধ হয়ে শুনে যাচ্ছি । অজয় ভার্গব বলে চললেন - এমন নয় যে শুধু আগ্রাতেই এইরকম দু'তিনধরনের মেনুকার্ড চলে । যেকোনও ট্যুরিস্ট স্পটে এই জিনিস চলে । আপনাদের কলকাতাতেও এরকম আছে । আপনারা ওখানকার লোক, সেজন্য খবর রাখেন না । যাই হোক, এখন এর থেকে উদ্ধার পাবেন কি করে ?
- কি করে ?
- যখনই খাবারের অর্ডার দেবেন, কোনও একটা বাহানা করে একটা মেনুকার্ড নিজেদের কাছে রেখে দেবেন । তাহলে ওরা আর এই জিনিস করতে পারবে না । যদি দেখেন বয় সেটা মানছে না, মেনুকার্ডটা বারবার চাইছে, বুঝবেন কিছু সমস্যা আছে আর সেই হোটেলে না খাওয়াই ভালো ।

আমাদের অবাক ভাবটা তখনও কাটেনি । অজয় ভার্গব আমাদের জানালেন ওনারা আসলে 'আগ্রা হোটেল অ্যান্ড ট্যুরিজম অ্যাসোসিয়েশন'-এর মেম্বার এবং গত কুড়ি বছর ধরে এই সংস্থাটা এই নিয়েই কাজ করছে যাতে ট্যুরিস্টদের কোনও ব্যাপারে কোনও অসুবিধের মধ্যে পড়তে না হয় । এইভাবে ওনারা জনসচেতনতা বাড়ানোর চেষ্টা করছেন । বললেন - "দেখিয়ে ভাইরাস যো হ্যায়, উসে খতম নেহি কিয়া যা সক্‌তা । লেকিন ইসি তরহা লোগোঁমে অ্যাওয়ারনেস বাড়াকে হাম উস ভাইরাসসে বচ সক্‌তে হ্যায় ।" আমি বুঝলাম কেন গাড়ির ড্রাইভারদের ওনাদের হোটেলের ওপর রাগ । সে'কথা ভদ্রলোককে বলতেই উনি হেসে বললেন যে ওনারা সেটা জানেন ।

অনেক আড্ডা হয়েছে । এবার ভ্রমণ কাহিনী এগোক !

রাতে ডিনার করে শুয়ে পড়লাম । পরেরদিনটা আমাদের একটা বিশেষ দিন - দিনের বেলা ফতেপুর সিক্রি, রাতে তাজমহল ।

৯ই অক্টোবর, ২০১৪ বৃহস্পতিবার আমরা একটা সুমোয় করে ফতেপুর সিক্রির উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম তখন বেলা দশটা । ফতেপুর সিক্রি আগ্রা থেকে ৪২ কিলোমিটার দূরে, যেতে প্রায় দেড়ঘন্টা লাগল । আগ্রা থেকে ফতেপুর সিক্রি যাওয়ার ট্রেনও আছে, তবে তাদের সময়টা বেশ বিটকেল । যাই হোক, ফতেপুর সিক্রি ১৩ বছর আকবরের রাজধানী ছিল, তাই জায়গাটা বিশেষ ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ ।

ফতেপুর সিক্রির ভেতরে
ফতেপুর সিক্রি
টিকিট - মাথাপিছু ২০ টাকা (১৫ বছরের উর্ধ্বে)
ফটো - তোলা যায়, চার্জ লাগে না
বাসের টিকিট - মাথাপিছু ১০ টাকা
ফতেপুর সিক্রিটা আসলে পাহাড়ের ওপরে আর গাড়ি থামে পাহাড়ের নিচে । সেখান থেকে আবার বাস ধরতে হয় ওপরে যাওয়ার জন্য । ফতেপুর সিক্রি ভারতীয় পুরাতত্ত্ব বিভাগ রক্ষণাবেক্ষণ করে । জায়গাটা বিশাল বড় । আগ্রার পর আকবর এখানে রাজধানী স্থানান্তরিত করেন । মুঘল আমলে একটা রাজধানীতে যা যা থাকত, তার সবই এখানে রয়েছে । দেওয়ান-ই-আম, দেওয়ান-ই-খাস, নওবত খানা, রসুই ঘর, অনুপ তালাও, পঞ্চ মহল, বীরবলের মহল ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য । জায়গাটা ঘুরে দেখতে বেশ অনেকটা সময় লাগে । আমরা গাইড নিইনি তবে তার জন্য দেখতে বা বুঝতে অসুবিধে হয়েছে এমন নয় । সব জায়গাতেই ইংরিজীতে বোর্ড লাগানো আছে আর সেগুলো পড়লে জায়গাগুলো সম্পর্কে ভালোই জানা যায় (অবশ্য বেশিরভাগ লোকই পড়ে না, "বাড়ি গিয়ে পড়ব" ভেবে একটা করে ছবি তুলে নেয় । তারপর সেই ছবিগুলোও পড়া হয়ে ওঠে না !) । এখানে একটা যোধাবাঈ এর মহলও আছে, যদিও এখানে যোধাবাঈ এসে কখনও থাকেননি । সেই মহলে হিন্দু দেবদেবীর পূজা করার ব্যবস্থাও করা আছে ।

বুলন্দ দরওয়াজা
ফতেপুর সিক্রির অনেকগুলো গেট আছে, তার মধ্যে সবচেয়ে বড় আর সবচেয়ে বিখ্যাত হল 'বুলন্দ দরওয়াজা' । ৫৫ মিটার উঁচু এই বুলন্দ দরওয়াজা দিয়ে ফতেপুর সিক্রির জামা মসজিদে ঢোকা যায় । বুলন্দ দরওয়াজার সামনে পৌঁছতে গেলে অনেকগুলো সিঁড়ি ভাঙতে হয় - তবে একটা ঢালু পথও আছে । বুলন্দ দরওয়াজা দিয়ে ঢুকে একটা বিশাল চত্বর - এর একপাশে সেলিম চিস্তির দরগা । কথিত আছে - নিঃসন্তান আকবর এই সেলিম চিস্তির দরগায় এসে সন্তান ভিক্ষা করার পরেই যোধাবাঈ এর কোলে আকবরের প্রথম সন্তান সেলিম জন্ম নেয় । তাই মনে করা হয় এই সেলিম চিস্তির দরগা খুব জাগ্রত ।
এগুলো নিজের নিজের বিশ্বাসের ব্যাপার, আমি এগুলোর সমর্থন বা বিরোধিতা কিছুই করি না । তবে এটা বিশ্বাস করি শুধুমাত্রা কোনও দরগায় বা মন্দিরে বা গির্জায় মাথা ঠেকালে কিছু হয় না, তার সঙ্গে নিজেকেও চেষ্টা করতে হয়, যেমন আকবর করেছিলেন (নিশ্চয়ই করেছিলেন !)

ফতেপুর সিক্রিতে আর বিশেষ কিছু দেখার নেই, তাই আমরা এখান থেকে বেরিয়ে গেলাম । ফেরার সময়েও একই ব্যবস্থা - পাহাড় থেকে নিচে নামতে হয় বাসে করে । নিচে নেমে এসে গাড়িতে না উঠে আমরা আগে লাঞ্চ সেরে নিলাম । এখানে একটা মার্কেট আছে, সেখানে নানারকম ঘরসাজানোর জিনিস পাওয়া যায় । এই মার্কেটের মধ্যেই কিছু খাবারের দোকান আছে, তারই একটা থেকে লাঞ্চ করে নেওয়া হল । রেষ্ট্যুরেন্টটা বেশ ভালো । যদিও আমরা খুব বেশি খাবার নিইনি, কিন্তু ভাত চিকেন ইত্যাদি মিলিয়ে মোট খরচ পড়ল মাত্র ৬০০ টাকা ।

ফতেপুর সিক্রি থেকে গাড়িতে উঠলাম তখন প্রায় চারটে । আমাদের দেখার বাকি আছে 'ইৎমদ-উদ-দৌলা' এবং 'সিকান্দ্রা'য় আকবরের সমাধি । আমাদের হাতে যা সময় আছে তাতে শুধুমাত্র একটা জায়গাই দেখা সম্ভব কারণ সূর্য্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গে এই দু'টো জায়গাই বন্ধ হয়ে যাবে । তাই ঠিক হল আমরা ইৎমদ-উদ-দৌলা যাব কারণ সেটা বেশি দেখার মতো ।

ইৎমদ-উদ-দৌলার গেট
ইৎমদ-উদ-দৌলা
টিকিট - মাথাপিছু ১০ টাকা (১৫ বছরের উর্ধ্বে)
ফটো - তোলা যায়, চার্জ লাগে না
আমরা আবার আগ্রায় ফিরে এলাম । আগ্রা ফোর্ট এলাকা থেকে ইৎমদ-উদ-দৌলা খুব বেশি দূরে নয় - তবে যমুনার অন্য পারে । ইৎমদ-উদ-দৌলা আসলে নূরজাহানের পিতার সমাধি (নূরজাহানকে মনে আছে তো ? জাহাঙ্গীরের স্ত্রী - পাওয়ার বিহাইন্ড দ্য থ্রোন, মনে পড়ছে ?) । এই নির্মাণটির বৈশিষ্ট্য হল এটাও সম্পূর্ণভাবে মার্বেল দিয়ে তৈরি এবং সেইসঙ্গে এর গায়ের বিভিন্ন রঙের পাথরের অসাধারণ কাজ আছে । এর নির্মাণকাল ১৬২২ খ্রীষ্টাব্দ, অর্থাৎ তাজমহল তৈরির প্রায় ২০ বছর আগে । এটা মনে করা হয় যে ইৎমদ-উদ-দৌলা থেকেই শাহজাহান তাজমহল তৈরির কথা ভাবেন - সেদিক থেকে এই ইৎমদ-উদ-দৌলাকে তাজমহলের অনুপ্রেরণা বলা যেতে পারে ।

ইৎমদ-উদ-দৌলা
আমরা এখানে বেশ কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করলাম । আমাদের আগ্রায় আর কিছু দেখার বাকি নেই, শুধু রাতের আলোয় তাজমহল ছাড়া । আর সত্যি কথা বলতে কি, এখানে আমাদের সবারই বেশ ভালো লাগছিল । জায়গাটা বেশ সুন্দর, তাজমহলের মতো অত ভীড় নয় এবং বেশ চুপচাপ নিস্তব্ধ । কোনও সুন্দর জিনিসের সৌন্দর্য্যকে উপলব্ধি করার জন্যও একটা বিশেষ পরিবেশের দরকার হয় যেটা আমরা আগেরদিন তাজমহলে পাইনি । আর সেটা এই ইৎমদ-উদ-দৌলায় খুব ভালোভাবে পেলাম । তাই সবমিলিয়ে প্রায় ঘন্টাখানেক কাটিয়ে আমরা বেরোলাম ইৎমদ-উদ-দৌলা থেকে ।

আমাদের গাড়ি আমাদের হোটেলের থেকে কিছুটা দূরে নামিয়ে দিল কারণ বিকেলের যানজটে আমাদের হোটেল পর্যন্ত আসা সম্ভব ছিল না । আমরা ঐ গাড়ি করেই আবার রাতের তাজমহল দেখতে যাব, আর তার জন্য আমাদের বেরোতে হবে সন্ধ্যে সাতটা থেকে সাড়ে সাতটার মধ্যে ।

হোটেলে বিশেষ কিছু করার ছিল না, চা টা খেয়ে সাতটার একটু পরে আবার বেরিয়ে পড়লাম । আমাদের গাড়ি আমাদের যেখানে নামিয়েছিল, সেখান থেকেই তুলল । এবার আমাদের যেতে হবে তাজমহলের পূর্বদিকের গেটে - এই জায়গাটার নাম 'শিল্পগ্রাম' । মনে রাখতে হবে রাতের তাজমহল দেখার জন্য শুধুমাত্র এই গেট দিয়েই ঢোকা যায় এবং এখান থেকেই সিকিউরিটি চেকিং শুরু হয় । আমাদের রাতের তাজমহল দেখার সময় সাড়ে আটটা থেকে ন'টা, আর তার সিকিউরিটি চেকিং-এর জন্য রিপোর্টিং টাইম রাত আটটা । আমাদের গাড়ি যথাস্থানে আমাদের নামিয়ে দিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল ।

পূর্ণিমার রাতের তাজমহল
টিকিট - মাথাপিছু ৫১০ টাকা (১৫ বছরের উর্ধ্বে)
ফটো - তোলা যায়, চার্জ লাগে না
এখানে সিকিউরিটি চেকিংটা বাড়াবাড়ি রকমের । তাজমহল দেখতে যাওয়ার সময়ে সঙ্গে এরা প্রায় কিছুই রাখতে দেয় না । মোবাইল, ব্যাগ, ক্যামেরা ট্রাইপড থেকে শুরু করে প্রায় সবকিছুই এদের লকারে জমা রেখে যেতে হয়, অবশ্য চাবি আমাদের কাছেই থাকে । শুধুমাত্র ক্যামেরা নিয়ে ঢোকার নিয়ম আছে । এছাড়া ভালোভাবে গায়ে হাত দিয়ে দেখে নেয় আর কিছু আছে কিনা । সমস্ত সিকিউরিটি চেকিং শেষ হলে এদের নিজস্ব ব্যাটারীচালিত বাসে করে তাজমহলের গেট পর্যন্ত নিয়ে যায় (এই বাসের কোনও ভাড়া লাগে না, এটা নাইট-ভিউয়িং এর এন্ট্রি ফি এর মধ্যে ধরে নেওয়া হয়) । এই বাসে আবার সামনে-পেছনে সশস্ত্র মিলিটারি গার্ড বসে থাকে । এই শেষ রাস্তাটা প্রায় এক কিলোমিটার । বাস যখন আমাদের তাজমহলের পূর্বদিকের গেটে নামিয়ে দিল, তখন সাড়ে আটটা বেজে গেছে । আমরা সবাই মিলে ভেতরে ঢুকলাম ।

আগেই বলেছি তাজমহলের সবক'টা গেট দিয়ে একই জায়গায় পৌঁছনো যায় আর সেখান থেকে দ্বিতীয় গেট দিয়ে ঢুকলে তাজমহল দেখা যায় । রাতের তাজমহল দেখার জন্য যাত্রা এই দ্বিতীয় গেট পর্যন্তই সীমিত । এখানকার সমস্ত আলো নিভিয়ে দেওয়া হয় যাতে শুধুমাত্র চাঁদের আলোতেই তাজমহলকে দেখা যায় ।

চাঁদের আলোয় তাজমহল
এলাম - দেখলাম - হতাশ হলাম । আসল পরিচয়পত্র দেখিয়ে ৫১০ টাকার টিকিট, আগেরদিন টিকিট কাটার ব্যবস্থা, চূড়ান্ত সিকিউরিটি চেকিং, সামনে পেছনে মিলিটারি গার্ড নিয়ে তাজমহল দেখতে আসা - এই সবকিছুর পরিপ্রেক্ষিতে পুরো ব্যাপারটা সম্পর্কে যে একটা 'না জানি কি দেখব' গোছের ধারণা তৈরি হয়েছিল, সেটা এই আধঘন্টায় বেশ জোরে ধাক্কা খেল । সত্যি কথা বলতে কি, এত রকমের নিয়মের মধ্যে দিয়ে আর যাই হোক কোনওকিছু উপভোগ করা যায় না । চাঁদের আলোয় খালি চোখে মোটামুটি দেখা গেলেও সেই আলো ছবি তোলার জন্য যথেষ্ট নয়, তার জন্য দরকার ক্যামেরার এক্সপোজার বাড়ানো । আর সেটা করতে গেলে ক্যামেরা হাতে ধরে থাকা সম্ভব নয়, দরকার ট্রাইপড যেটা কিনা আবার ভেতরে নিয়ে যাওয়ার নিয়ম নেই । আর আধঘন্টারও কম সময়ে প্রায় ৩০০ মিটার দূর থেকে একটা জিনিস দেখা তাও কিনা আবার চাঁদের আলোয় - ব্যাপারটা শুনতে যতটা থ্রিলিং বাস্তবে ততটা নয় ।

ঠিক ন'টার সময়ে আলো জ্বালিয়ে দেওয়া হল আর আমাদেরও গুটিগুটি পায়ে তাজমহল থেকে বেরিয়ে পড়তে হল । ফেরার পথে আবার এদেরই বাস, সেই বাস আমাদের গাড়ির স্ট্যান্ড পর্যন্ত পৌঁছে দিল । গাড়ি করে আমরা যখন হোটেলে পৌঁছলাম তখন প্রায় দশটা বাজে । রাতের আলোয় তাজমহল দেখার ব্যাপারে আমাদের সকলেরই যতটা উৎসাহ ছিল, দেখার পর ঠিক ততটাই হতাশ হয়েছি । যাদের এই ব্যাপারটা সম্পর্কে এতটুকুও আগ্রহ আছে তাদের সবাইকেই বলছি এটা হচ্ছে সম্পূর্ণভাবে সময় এবং টাকার অপচয় । তাজমহল যতটা দেখা যায়, দিনের আলোতেই দেখে নেওয়া ভালো, কারণ রাতে প্রকৃতপক্ষে কিছুই পাওয়া যায় না । আমাদের ফতেপুর সিক্রি, সাইট সিয়িং আর রাতের আলোয় তাজমহল দেখা - এই সব মিলিয়ে গাড়িকে ২,৫০০ টাকা দিতে হল ।

হোটেলে ফেরার পথে একটা দোকান থেকে আগ্রায় বিখ্যাত 'পেঠা' কিনে নেওয়া হল । পেঠা জিনিসটা আসলে 'কুমড়োর মেঠাই' বা 'মোরব্বা', তবে পার্থক্য হল আগ্রায় এগুলো নানারঙের এবং নানা আকারের পাওয়া যায় ।

হোটেলে ফিরে এসে ডিনার করে শুয়ে পড়লাম । আমাদের 'আগ্রা ভ্রমণ' এখানেই শেষ । পরেরদিন সকালে ট্রেন ধরে আমরা যাব আমাদের এই ভ্রমণের শেষ অংশে - জয়পুরে ।

সারসংক্ষেপঃ

১. দিল্লী থেকে আগ্রা যাওয়ার অনেক ট্রেন আছে আমরা তার মধ্যে শতাব্দী এক্সপ্রেসে গিয়েছিলাম । ট্রেনে ছাড়া গাড়িতেও দিল্লী থেকে আগ্রা যাওয়া যায় এবং যেতে তিন থেকে চার ঘন্টা সময় লাগে ।
২. আগ্রায় দু'টো স্টেশন - আগ্রা ফোর্ট আর আগ্রা ক্যান্টনমেন্ট । আগ্রা ফোর্ট এলাকাটা কিছুটা ঘিঞ্জি, তাই বেশিরভাগ লোক ক্যান্টনমেন্টের কাছেই থাকে ।
৩. আগ্রা ফোর্ট স্টেশনের একেবারে কাছে আমরা ছিলাম হোটেল অজয় ইন্টারন্যাশনালে । বাজারের মধ্যে হলেও এই হোটেলের পরিবেশ খুব সুন্দর এবং যথেষ্ট শান্তিপূর্ণ । এদের নিজস্ব ওয়েবসাইট http://www.hotelajayinternationalagra.com/ থেকে অথবা মেকমাইট্রিপ থেকে বুকিং করা যেতে পারে । হোটেলের ফোননম্বর 09897477602 / 09837160369 / 0562-3290963 / 0562-2251076 ।
৪. আগ্রা ফোর্ট স্টেশন থেকে, বিশেষ করে ভোরের ট্রেন ধরার জন্য অজয় ইন্টারন্যাশনাল খুব ভালো হোটেল । এদের হোটেল থেকে স্টেশনের গেটে হেঁটে পৌঁছতে মিনিট পাঁচেক লাগে (আমি বোধহয় বাড়িয়ে বলছি) ।
৫. আগ্রায় দেখার জায়গার মধ্যে রয়েছে তাজমহল, আগ্রা ফোর্ট, ইৎমদ-উদ-দৌলা, সিকান্দ্রা, জামা মসজিদ এবং ফতেপুর সিক্রি । এদের মধ্যে সিকান্দ্রা এবং জামা মসজিদ অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ, তাই সময়ের অভাবে এগুলো আমাদের লিস্ট থেকে বাদ দিতে হয়েছিল ।
৬. আগ্রায় বেশিরভাগ জায়গা শুক্রবার বন্ধ থাকে । পরিকল্পনা করার সময়ে এটা মাথায় রাখতে হবে ।
৭. ভারতীয় পুরাতত্ত্ব বিভাগ প্রতিমাসে পূর্ণিমা ও তার আগে পরে দু'দিন করে মোট পাঁচটা রাতে চাঁদের আলোয় তাজমহল দেখার ব্যবস্থা করে । এর টিকিট মাথাপিছু ৫১০ টাকা । যদি অর্থ, সময়, পরিশ্রম অপচয় করার ইচ্ছে না থাকে, তাহলে এটা দেখতে যাওয়ার কোনওই মানে হয় না । তাজমহল দেখতে হলে দিনেরবেলা দেখাই ভালো ।
৮. দিল্লী থেকে একদিনের ট্যুরে আগ্রা ঘুরে আসার ব্যবস্থা রয়েছে । কিন্তু আগ্রা এবং সেইসঙ্গে ফতেপুর সিক্রি দেখার জন্য আগ্রায় একদিন থাকলে ভালো হয়, সেক্ষেত্রে এইসব সুন্দর ঐতিহাসিক জায়গাগুলো তাড়াহুড়ো করে দেখতে হয় না ।

জয়পুর ভ্রমণঃ

আগ্রা থেকে জয়পুর যাওয়ারও অনেক ট্রেন আছে, এছাড়া গাড়িতেও যাওয়া যায় । আমরা ১০ই অক্টোবর, ২০১৪ শুক্রবার আগ্রা ফোর্ট থেকে 'আগ্রা ফোর্ট আজমেঢ় ইন্টারসিটি এক্সপ্রেস' ধরেছিলাম । এই ট্রেন আগ্রা ফোর্ট থেকে ছাড়ে ভোর ৫ : ০৫-এ এবং জয়পুর পৌঁছয় সকাল ৯ : ৩০-এ । আমাদের জয়পুরের মেয়াদ একদিন, তাই প্রথমদিনই আমাদের সবকিছু দেখে ফেলতে হবে । এজন্য সকাল সকাল পৌঁছনোটা বিশেষ দরকার ছিল ।

ট্রেন খুব সামান্যই লেট ছিল । জয়পুরে আমাদের বুকিং ছিল 'হোটেল অভিরাজ প্যালেস'-এ, স্টেশন থেকে খুবই কাছে (আগ্রার মতো হাঁটা দুরত্ব নয়, তবে গাড়িতে ৫ - ১০ মিনিটের বেশি লাগেনা) । আমরা সাইট সিয়িং এর জন্য হোটেল থেকেই গাড়ি বুক করে রেখেছিলাম, তাই আমাদের স্টেশন থেকে ফ্রি পিক-আপ ছিল । গাড়ি আমাদের নিয়ে হোটেলে পৌঁছল তখন সকাল দশটা ।

আমাদের চারতলায় তিনটে ঘর দেওয়া হল । ঘরগুলো খুবই ছোট । কোনওমতে একটা খাট ধরে আর তারপর হাঁটার জায়গা প্রায় থাকে না বললেই চলে । আমরা রেডি হয়ে নিয়ে সাইট সিয়িং-এর জন্য যখন বেরোলাম তখন দুপুর একটা ।

আমাদের ড্রাইভার ভদ্রলোক, খুবই ভালো । উনি আমাদের প্রথমেই বললেন আমরা যে সময়ে বেরিয়েছি, তাতে আমাদের সবক'টা জায়গা দেখা হবে না । তাই আমরা যদি ওনার ওপর সম্পূর্ণভাবে ছেড়ে দিই, তাহলে সবচেয়ে ভালো হবে । সেক্ষেত্রে উনি আমাদের প্রধান ভালো জায়গাগুলো দেখিয়ে দেবেন । ওনার ওপর ভরসা করা ছাড়া আমাদের আর কোনও উপায়ও নেই, তাই সেটাই করলাম । উনি আমাদের বললেন যে উনি আমাদের সবক'টা ভালো জায়গা দেখিয়ে দেবেন কিন্তু তার জন্য আমাদের যেটা করতে হবে সেটা হল সময় একেবারে নষ্ট না করা । যে জায়গা দেখতে যতটা সময় লাগার কথা (সেটা উনিই আমাদের বলে দেবেন), আমরা যেন তার থেকে বেশি সেখানে নষ্ট না করি । আমরা আমাদের প্রথম গন্তব্যে পৌঁছলাম তখন বেলা দেড়টা ।

অ্যালবার্ট হল
অ্যালবার্ট হল
টিকিট - মাথাপিছু ২০ টাকা (১২ বছরের উর্ধ্বে)
ফটো - তোলা যায়, চার্জ লাগে না
'অ্যালবার্ট হল' হল জয়পুরের মিউজিয়াম । আগ্রা যেমন মুসলিম নবাব, বাদশাদের জায়গা ঠিক সেরকমই জয়পুর হল হিন্দু রাজাদের জায়গা । তাই এখানকার মিউজিয়ামে হিন্দু রাজাদের ব্যবহৃত জিনিসপত্র ইত্যাদি রয়েছে । রান্নার বাসনপত্র, গানবাজনার সরঞ্জাম, সাজগোজের জিনিস থেকে শুরু করে যুদ্ধে ব্যবহৃত অস্ত্রসস্ত্র, পোষাকপরিচ্ছদ সবই রয়েছে এখানে । সবকিছুই বেশ সুন্দরভাবে সাজানো । এখানে বিশেষ উল্লেখযোগ্য হল একটা বিশাল আকারের রবাব (একধরনের বাদ্যযন্ত্র - খানিকটা শরদের মতো দেখতে) । এটা শোওয়ানো অবস্থায় রাখা আছে । এর দৈর্ঘ্য ৬ ফুটের মতো হবে । এছাড়া রয়েছে একটা মমি - তুতু নামক এক মহিলার ।

পিঙ্ক সিটির ভেতরে বাড়ি
অ্যালবার্ট হল থেকে বেরিয়ে আমরা গেলাম পিঙ্ক সিটির ভেতরে । প্রকৃতপক্ষে পিঙ্ক সিটি হল জয়পুরের ভেতরে একটা শহরের মতো । ১৮৭৬ খ্রীষ্টাব্দে প্রিন্স অ্যালবার্ট এবং রানী এলিজাবেথ যখন জয়পুরে আসেন, তখন সমস্ত শহরকে গোলাপি রঙে রঙিন করে তোলা হয়, কারণ গোলাপি রঙ হল আতিথেয়তার প্রতীক । সেইসময়ে জয়পুর শহর এই অংশটুকুর মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল যাকে বর্তমানে আলাদা করে পিঙ্ক সিটি বলা হয় । তারপর কালের নিয়ম মেনে শহর বেড়েছে, পিঙ্ক সিটির বাইরেও মানুষের বসতি গড়ে উঠেছে । কিন্তু এই অংশটা আজও পিঙ্ক সিটিই রয়ে গেছে । এখানকার সমস্ত বাড়ি, দোকানের রঙ গোলাপি এবং মালিক চাইলেও নিজের বাড়িতে অন্য কোনও রঙ করতে পারবেন না, এটাই এখানকার নিয়ম । আমাদের ড্রাইভার বলল পিঙ্ক সিটির ভেতরটা খুবই প্ল্যান করে তৈরি করা । এখানকার বাড়িগুলোর সবগুলোই প্রায় দু'তিনশ বছরের পুরোনো, কিন্তু সেইযুগের নির্মাণ বলে আজও খুব বেশি রক্ষণাবেক্ষণ করতে হয় না (সেটা সিমেন্টের যুগ ছিল না, আমার তো বেশ অবাক লাগে 'ঢালাইয়ের জান অম্বুজা সিমেন্ট' ছাড়া কি করে এত মজবুত নির্মাণ করা সম্ভব !) । জয়পুরের দেখার জায়গাগুলোর মধ্যে বেশিরভাগই এই পিঙ্ক সিটির মধ্যে ।

হাওয়া মহল
হাওয়া মহল
আমরা হাওয়া মহলের ভেতরে ঢুকিনি । আমাদের ড্রাইভার বলল হাওয়া মহল বাইরে থেকে দেখে নেওয়াই ভালো, কারণ বাইরে যা দেখতে পাচ্ছি, ভেতরে গেলে তার থেকে বেশি কিছু দেখা যাবে না । হাওয়া মহলের বৈশিষ্ট্য হল এটা এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে যে এর ভেতর থেকে রাজপরিবারের মহিলারা বাইরের সবকিছু দেখতে পাবেন কিন্তু বাইরে থেকে তাঁদের দেখা যাবে না । এর আরেকটা বৈশিষ্ট্য হল এর জানালাগুলো এমনভাবে তৈরি যে ভেতরে খুব সুন্দর হাওয়া চলাচল করে । ভেতরে ঢুকে সময় নষ্ট না করে আমরা কাছেই একজায়গা থেকে লাঞ্চ করে নিলাম (আগ্রার মিঃ অজয় ভার্গবের কথা ভুলিনি, বিল আসার আগে পর্যন্ত একটা মেনুকার্ড আমাদের কাছে রেখে দিয়েছিলাম !) । খাওয়ার জায়গাটা আমাদের বেশ পছন্দ হল । এখানে রান্না ভাল, দাম কম এবং সবচেয়ে বড় কথা খুব তাড়াতাড়ি সার্ভ করে । মাত্র ৪৭০ টাকায় আমাদের চিকেন, ডিম ইত্যাদি দিয়ে ভাত খাওয়া হয়ে গেল । আমরা এগিয়ে গেলাম পরবর্তী গন্তব্যের দিকে ।

যন্তর মন্তর
যন্তর মন্তর
টিকিট - মাথাপিছু ৪০ টাকা (১২ বছরের উর্ধ্বে)
ফটো - তোলা যায়, চার্জ লাগে না
'যন্তর মন্তর' হল আসলে মানমন্দির । সূর্য্যের অবস্থান থেকে ঋতু, দিনের সময়, রাশি ইত্যাদি নির্ভুলভাবে নির্ণয় করার জন্য বেশ কিছু যন্ত্র তৈরি করা আছে - এদেরই নাম যন্তর মন্তর । এই যন্তর মন্তর জয়পুর ছাড়াও দিল্লী, উজ্জয়িনী, মথুরা ও বেনারসে আছে । রাজা জয় সিং জ্যোতির্বিদ্যা চর্চার জন্য এগুলো তৈরি করান । যন্তর মন্তরে একজন গাইড নিলে সবকিছু ভালোভাবে বোঝা যায়, তবে তার থেকেও ভালো বোঝা যায় যদি নিজে কিছুটা পড়াশোনা করে যাওয়া যায় । আমাদের সবকিছু বিস্তারিতভাবে বোঝার মতো সময় ছিল না, তাই আমরা গাইড নিইনি । তার পরিবর্তে আমরা অন্য একটা দল, যারা গাইড নিয়েছিল, তাদের সঙ্গে সঙ্গে ঘুরতে লাগলাম । তাতেই আমাদের বেশ কয়েকটা জিনিস সম্পর্কে জানা হয়ে গেল । ভারতবর্ষের যে পাঁচটা জায়গায় এই যন্তর মন্তর আছে, তাদের মধ্যে দিল্লী আর জয়পুরেরটাই ভালো, বাকিগুলোর মধ্যে কেউ অসম্পূর্ণ আর কেউ ভগ্নপ্রায় ।

সিটি প্যালেস
সিটি প্যালেস
টিকিট - মাথাপিছু ১০০ টাকা (১২ বছরের উর্ধ্বে)
যন্তর মন্তরের ঠিক সামনেই সিটি প্যালেসে ঢোকার রাস্তা । এটা প্রকৃতপক্ষে রাজার বাড়ি এবং রাজপরিবারের জিনিসপত্রের সংগ্রহশালা । টিকিটের দামের দিক দিয়ে দেখতে গেলে এটা খুবই বেশি । এটা অ্যালবার্ট হলের থেকে খুব কিছু আলাদা হবে না, তাই আমরা এই জায়গাটা না দেখার সিদ্ধান্ত নিলাম ।

জলমহল
জলমহল
টিকিট - লাগে না
ফটো - তোলা যায়, চার্জ লাগে না
জলের মধ্যে মহল - জলমহল । মানসাগর নামে এক বিশালাকার হ্রদের মধ্যে এই মহল নির্মাণ করেছিলেন মহারাজা জয় সিং । এখন এই জলমহলে যাওয়া যায় না, হ্রদের পাড় থেকেই দেখতে হয় । আমাদের ড্রাইভার বলল - এই মানসাগর এখন খুব নোংরা হয়ে গেছে, বলতে গেলে জয়পুরের বেশিরভাগ আবর্জনা, ময়লা, নর্দ্দমার জল এই মানসাগরে এসে পড়ে । ফলস্বরূপ এই জল খুব নোংরা ও দুর্গন্ধপূর্ণ এবং সেইসঙ্গে এই মহলও ভীষণ দুর্গন্ধপূর্ণ । এখানকার পৌরসভা থেকে মাঝে মাঝে পরিষ্কার করতে যাওয়া হয়, এই পর্যন্ত । বর্তমানে রাজস্থান ট্যুরিজম এখানে ট্যুরিস্টদের দেখতে যাওয়ার ব্যবস্থা করার কথা ভাবছে, কিন্তু তার জন্য এই হ্রদকে পরিষ্কার করা দরকার । সেটা নিয়ে চিন্তাভাবনা চলছে । হ্রদের ধারে গাড়ি থামিয়ে আমরা জলমহল দেখলাম এবং ছবি তুললাম । পুরো ব্যাপারটার জন্য পাঁচমিনিট যথেষ্ট ।

আম্বের ফোর্ট
টিকিট - মাথাপিছু ৩০ টাকা (১২ বছরের উর্ধ্বে)
ফটো - তোলা যায়, চার্জ লাগে না
জয়পুর শহর থেকে জলমহল পেরিয়ে হঠাৎ করেই পাহাড়ে উঠে পড়তে হয় আম্বের ফোর্টে যাওয়ার জন্য । আসলে নিরাপত্তার জন্য কেল্লাগুলো বেশিরভাগ সময়ে পাহাড়ের ওপরে তৈরি করা হত আর জয়পুরের উত্তরদিকে যে পাহাড় রয়েছে, সেই পাহাড়েই রয়েছে এই কেল্লাগুলো । আম্বের ফোর্ট ছাড়াও এই পাহাড়গুলোর মধ্যে রয়েছে 'জয়গড় ফোর্ট' এবং 'নাহারগড় ফোর্ট' যেগুলো খুবই কাছাকাছি (মন্দার বোস ঠিকই বলেছিলেন "এরা তো দেখছি যেখানে ফাঁক পেয়েছে, সেখানেই একটা করে কেল্লা গুঁজে রেখেছে !") ।

শীষ মহল
আম্বের ফোর্ট রাজা মান সিং-এর সময়ে তৈরি । প্রকৃতপক্ষে কেল্লাগুলো একেকটা স্বয়ংসম্পূর্ণ শহর, এর মধ্যে সব ব্যবস্থাই থাকে । আমাদের গাড়ি আম্বের ফোর্টের একেবারে ওপর পর্যন্ত গেল, যতদূর পর্যন্ত গাড়ি যাওয়ার নিয়ম আছে । সেখান থেকে বাকি ফোর্ট হেঁটে দেখতে হয় । আমাদের ড্রাইভার বলল - এখানকার গাইড বলবে ভেতরে ২২ টা দেখার জায়গা আছে, কিন্তু আসলে দেখার জায়গা ৪ টে । সেগুলো হল - গণেশ পোল (পোল = দরজা) শীশ মহল, দেওয়ান-ই-আম, দেওয়ান-ই-খাস । আর এগুলো দেখার জন্য গাইড নেওয়ার কোনওই মানে হয় না । আমরা সেইমতো গাইড না নিয়েই দেখলাম । দেখতে অসুবিধে হওয়ার কথাও নয় কারণ সবজায়গাতেই বোর্ড লাগানো আছে যেগুলো চাইলে পড়ে নেওয়া যেতে পারে ।

মান সিং ছিলেন একজন হিন্দু রাজা এবং সম্রাট আকবরের একজন অত্যন্ত বিশ্বস্ত লোক । সেইসঙ্গে তিনি ছিলেন আকবরের নবরত্ন সভার একজন সদশ্য (মনে করা হয় মান সিং-এর বোন ছিলেন যোধাবাঈ, কিন্তু এটা সঠিক নয় । যোধাবাঈ ছিলেন মান সিং-এর পিসিস্থানীয়া কেউ) । আকবরকে খুশি করার জন্যই তিনি তাঁর কেল্লার মধ্যে মুঘলদের আদলে দেওয়ান-ই-আম, দেওয়ান-ই-খাস তৈরি করান ।

সূর্য্যাস্তের সময়ে আম্বের ফোর্ট
এছাড়া আছে শীশ মহল যেটা আসলে বিভিন্ন আকারের ছোট বড়ো আয়না দিয়ে তৈরি । পুরো কেল্লাটা ঘুরে দেখা সম্ভব নয়, তবে যতটা দেখা যায় সেটাও অনেকটা । ভীষণ সুন্দরভাবে সাজানো, পরিকল্পনা করে তৈরি করা এই আম্বের ফোর্ট । আম্বের ফোর্টের পাশেই আছে একটা জলাশয় - নাম মাওতা লেক । এই লেকের মাঝখানে আবার একটা বাগান আছে যেটা খুব সুন্দরভাবে সাজানো । এগুলো সবই আম্বের ফোর্টের ওপর থেকে দেখতে পাওয়া যায় । দূরে দেখা যায় পাহাড়, সেইসঙ্গে ফোর্টের পাঁচিল । বিকেল প্রায় শেষ হয়ে এসেছে - সূর্য্য ধীরে ধীরে অস্ত চলে যাচ্ছিল পাহাড়ের ওপর নাহারগড় কেল্লার পেছনে । কেল্লাগুলো সাধারণতঃ হলুদ-কমলা ধরনের পাথর দিয়ে তৈরি করা হয় আর বিকেলের পড়ন্ত আলোয় আম্বের ফোর্টকে আরও সুন্দর লাগছিল । ফোর্ট বন্ধ হওয়ার সময়সীমা বিকেল সাড়ে ছ'টা, আমরা যথাসময়ে ফেরার পথে পা বাড়ালাম ।

জয়পুরের বিখ্যাত ২০ গ্রামের জুতো
আম্বের ফোর্ট দেখা দিয়ে শেষ হল আমাদের প্রথম দিনের সাইট সিয়িং । এরপর আমাদের ড্রাইভার আমাদের নিয়ে গেল একটা জুতোর দোকানে । এখানে পাওয়া যায় রাজস্থানের বিখ্যাত ২০ গ্রাম ওজনের জুতো । সম্পূর্ণ কাপড় দিয়ে তৈরি এই জুতোর সুবিধে হল এগুলো এতই নরম এবং হাল্কা যে ভাঁজ করে পকেটে পুরে ফেলা যেতে পারে । এই জুতোর আরেকটা বৈশিষ্ট্য হল এগুলোর দু'টো পাটিই দু'পায়ে পরা যেতে পারে অর্থাৎ ডান পা-বাঁ পায়ের কোনও প্রভেদ নেই । জুতোর দাম ৪০০ টাকা আর আমাদের কেনার কোনও পরিকল্পনাও ছিল না তাই শুধুমাত্র দেখেই চলে এলাম ।

এরপর ড্রাইভার আমাদের নিয়ে গেল 'আর টি ডি সি'-র দোকানে । এখানে জানিয়ে রাখি 'আর টি ডি সি' মানে সাধারণভাবে 'রাজস্থান ট্যুরিজম ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন' হলেও এই দোকানের নাম 'রাজস্থান ট্রাডিশনাল ডিজাইনিং কর্পোরেশন' এবং এরা সবমিলিয়ে এমন একটা ভাব করে যে এদের 'সরকারি সংস্থা' বলে ভুল হতে পারে । যাই হোক, এখানে পাওয়া যায় রাজস্থানের বিখ্যাত ১০০ গ্রাম ওজনের 'রজাই' (লেপ বা কম্বল) । এই রজাই-এর একটা বৈশিষ্ট্য তো অবশ্যই এর ওজন, কিন্তু অন্যান্য আরও বৈশিষ্ট্যও আছে । ১০০ গ্রাম ওজনের রজাই একজনের জন্য আর দু'জনের জন্য যেটা সেটার ওজন ২০০ গ্রাম । এর দাম ১,৬৫০ টাকা । এর বৈশিষ্ট্য হল এর ভেতরে আছে ২০০ গ্রাম ভেড়ার লোম আর বাইরেটা প্যারাসুট কাপড় দিয়ে তৈরি । এটা শীতকালে কম্বল হিসেবে ব্যবহার করা যাবে আবার গরমকালে এর উল্টোদিকটা বিছানায় পেতে দিলে বেডকভারের কাজ করবে এবং সেইসঙ্গে ওপরদিকটা ঠান্ডা হবে । এছাড়া এটা বাড়িতে লোকজন এলে মেঝেতে পেতেও ব্যবহার করা যেতে পারে কারণ একে কেচে নেওয়া খুব সহজ - সাধারণ জামাকাপড় যেভাবে কাচা হয় সেভাবেই কাচা যেতে পারে এমনকি ওয়াশিং মেশিনেও কাচা যেতে পারে । আমরা একটা রজাই কিনলাম । এছাড়া কিছু শাড়ি ও শালওয়ারের পিসটিসও কেনা হল । এদের দোতলায় আবার নানারকম ঘরসাজানোর জিনিস পাওয়া যায় যদিও দাম বেশ বেশি ।

এরপর আমরা হোটেলে ফিরে এলাম । সারাদিনের পর সবারই বেশ ক্লান্ত লাগছিল, তাই ভাত-রুটি-চিকেন দিয়ে তাড়াতাড়ি ডিনার করে (খরচ পড়ল ৭৫৯ টাকা) শুয়ে পড়লাম ।

১১ই অক্টোবর, ২০১৪ শনিবার আমাদের ফেরার দিন । ফেরার ট্রেন দুপুরে জয়পুর স্টেশন থেকে তাই আমাদের ঠিকই করা ছিল সকালটা আমরা আরেকটা সাইট সিয়িং নেব । গন্তব্য নাহারগড় ফোর্ট এবং জয়গড় ফোর্ট ।

আগেই বলেছি জয়গড়, নাহারগড় আর আম্বের ফোর্ট যাওয়ার রাস্তা অনেকটা একই । পাহাড়ের মধ্যে একটা জায়গা থেকে নাহারগড় আর জয়গড় যাওয়ার রাস্তাটা আম্বের যাওয়ার রাস্তা থেকে আলাদা হয়ে যায় । আবার আরও কিছুদূর গেলে নাহারগড় আর জয়গড় যাওয়ার রাস্তা আলাদা হয়ে যায় । আমরা আগে নাহারগড় যেতে চাইলাম ।

নাহারগড় গিয়ে একটা অসুবিধেয় পড়তে হল । আমরা নাহারগড়ে পৌঁছেছি সকাল ৯ টার একটু পরে আর কেল্লার সময় সকাল ৯ : ৩০ থেকে বিকেল ৪ : ৩০ । আমাদের ড্রাইভার এই সময়সীমাটা জানত না (এই ড্রাইভার আগেরদিনের ড্রাইভার নয়, এ কিছুই জানে না) । তাই আমরা ঠিক করলাম শুধু শুধু দাঁড়িয়ে সময় নষ্ট না করে আগে জয়গড়টা দেখে আসি । এটা আমাদের ড্রাইভারের ইচ্ছের বিরুদ্ধে হলেও শেষ পর্যন্ত সম্ভব হল ।

জয়বাণ কামান
জয়গড় ফোর্ট
টিকিট - মাথাপিছু ৩৫ টাকা (১২ বছরের উর্ধ্বে)
ফটো - তোলা যায়, চার্জ ক্যামেরাপিছু ৫০ টাকা (ভেতরে সিকিউরিটি গার্ড ক্যামেরার টিকিটের সঙ্গে ক্যামেরার সংখ্যা মিলিয়ে দেখে । তাই কম টিকিট কেটে বেশি ক্যামেরা দিয়ে ছবি তোলার ধান্দা একদম নয় !)
গাড়ি ঢোকার চার্জ - ৫০ টাকা
জয়গড় কেল্লা রাজা জয় সিং-এর তৈরি (হ্যাঁ, ইনিই সেই জয় সিং যিনি যন্তর মন্তর নির্মাণ করান) । আম্বের কেল্লা ছিল রাজধানী । জয়গড় কেল্লা তৈরি করা হয় যাতে যুদ্ধের সময়ে সম্পূর্ণ রাজধানী নিয়ে আম্বের থেকে পাহাড়ের ওপরে এই নিরাপদ জায়গায় আশ্রয় নেওয়া যায় । তাই যুদ্ধ যখন থাকত না, তখন এখানে শুধুমাত্র সৈন্যরাই বসবাস করত । জয়গড় কেল্লার সবচেয়ে উঁচু জায়গায় একটা বিশালাকার কামান রাখা আছে - এর নাম 'জয়বাণ' । এর ওজন ৫০ টনের মতো এবং দৈর্ঘ্য ৬ মিটারের কিছু বেশি । তবে প্রচন্ড শক্তিশালী এই কামান কখনও কোনও যুদ্ধে ব্যবহার হয়নি ।

এছাড়া জয়গড় কেল্লার ভেতরে আছে অস্ত্রশস্ত্রের সংগ্রহশালা আর সেইসঙ্গে কবে কোথায় কার সঙ্গে কোন রাজপুত রাজার যুদ্ধ হয়েছিল এবং সেই যুদ্ধের ফল কি হয়েছিল, তার একটা সারণী দেওয়া আছে ।

জয়গড় ফোর্ট
আগেই বলেছি আম্বের কেল্লা আর জয়গড় কেল্লা একই রাজপরিবারের সম্পত্তি ছিল । বর্তমানে জয়গড় কেল্লা রাজার ব্যক্তিগত সম্পত্তি এবং সেখানে তিনি টিকিট কেটে দেখার ব্যবস্থা করে রেখেছেন । আর আম্বের কেল্লা সরকারি সম্পত্তি এবং সেখানে সরকারও টিকিট কেটে দেখার ব্যবস্থা করে রেখেছে । জয়গড় কেল্লায় কিছু লোক থাকে, এরা কেল্লার রক্ষণাবেক্ষণও করে আবার ট্যুরিস্টদের জন্য গাইডের কাজও করে । এরা রাজার কর্মচারী এবং এটা এদের কাজ । তাই এদের আলাদা করে কোনও টাকা দিতে হয় না (তবে কেউ চাইলে দিতেই পারে, অতিরিক্ত আয় কে না চায় ? আমাকে দিলে আমিও নেব !) । এরকমই দু'জন আমাদের কেল্লাটা ঘুরিয়ে দেখাল । যুদ্ধকালীন আশ্রয় হলে কি হবে, রাজাদের ব্যাপারই আলাদা ! নাচগান, সপারিষদে রান্নাখাওয়ার জায়গা সব তৈরি করা আছে এই কেল্লার মধ্যে । গরমের সময়ে ব্যবহারের জন্য এয়ারকুলার আছে, সেটাও দেখলাম । আমাদের গাইড গ্রিলের গেট দেওয়া একটা বন্ধ দরজা দেখাল, এই দরজার ওদিকে একটা সুড়ঙ্গ আছে । সেই সুড়ঙ্গ দিয়ে আম্বের যাওয়া যেত । আম্বেরেও এরকম একটা বন্ধ গেট আছে যেটা আমরা আগেরদিন দেখেছিলাম । এই সুড়ঙ্গ ১.৫ কিলোমিটার দীর্ঘ । যুদ্ধের সময়ে যখন রাজারা আম্বের থেকে জয়গড়ে আসতেন, তখন এখান দিয়েই আসতেন । বর্তমানে যেহেতু আম্বের আর জয়গড়ের মালিক আলাদা, তাই এই সুড়ঙ্গটাকে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে (ভেতর দিয়ে গিয়ে একবারে আম্বেরে যাওয়ার ইচ্ছে যে একেবারে হচ্ছিল না, তা নয়) ।

নাহারগড় ফোর্ট
টিকিট - মাথাপিছু ২০ টাকা (১২ বছরের উর্ধ্বে)
ফটো - তোলা যায়, চার্জ লাগে না
গাড়ি ঢোকার চার্জ - ১০ টাকা
আমরা জয়গড় থেকে বেরোলাম তখন সকাল সাড়ে দশটা আর নাহারগড়ে পৌঁছলাম মিনিট দশেক পরে । নাহারগড়ে
ঢালু পথটা পুরোটাই গাড়ি ওঠে, শেষের সমতলটা হেঁটে ঘুরতে হয় । মুকুলের "এটা সোনার কেল্লা নয়, এটা অন্য কেল্লা" বলতে বলতে কেল্লা থেকে বেরিয়ে আসা, মন্দার বোসের "আরেকটা জিনিস লক্ষ্য করেছেন ? আরেকটা কেল্লা !" বলার পরে ডঃ হাজরাকে ধাক্কা আর তারপরে "ভ্যানিশ !" মনে পড়ছে ? সেসবই ঘটেছিল নাহারগড় কেল্লায় ।

নাহারগড় ফোর্ট
নাহারগড়ে সেরকম আকর্ষণীয় বিশেষ কিছু নেই, এবং কেল্লাটাও বাকিদু'টোর তুলনায় ছোট । এটাও জয় সিং-এর সময়েই তৈরি যদিও তারপরেও বিভিন্ন রাজারা এর ভেতরে কিছু কিছু নির্মাণ করান । সোয়াই মাধো সিং তাঁর নয়জন রাণীর জন্য ভেতরে ন'টি মহল তৈরি করান যেগুলো দেখতে একই রকমের । একটা কমন্‌ বারান্দা দিয়ে এই ন'টি মহলের প্রত্যেকটায় যাওয়া যায় আর সেই বারান্দার একপ্রান্তে রাজার মহল । রাজা যখন রাণীদের ঘরে যেতেন তখন সব রাণীর ঘরের দরজা বন্ধ হয়ে থাকত । রাজা যে রাণীর ঘরে যেতে চান, সেই রাণীর ঘরের দরজা ঠেলে ঢুকে যেতেন । এইভাবে বাকি রাণীরা জানতে পারতেন না রাজা কোন রাণীর ঘরে গেলেন (বেশ অভিনব আইডিয়া, তাই না ? কেউই জানল না কাকে হিংসে করতে হবে ! ইসস্‌ এখনকার দিনেও যদি ...) । নাহারগড়েও গাইড আছে এবং এদের কোনও টাকা দিতে হয় না । এই গাইডই আমাদের বলল আমরা চাইলে ন'টা মহল আলাদা আলাদা করে দেখতে পারি, কিন্তু আসলে এগুলো একইরকম । আমরা দু'তিনটে মহল ঘুরে ঘুরে দেখে বেরিয়ে এলাম ।

আমাদের নাহারগড় দেখা শেষ - সেইসঙ্গে শেষ জয়পুর ভ্রমণ । এবার আমাদের ঘরে ফেরা ।

হোটেলে ফিরলাম তখন সাড়ে বারোটা । আমাদের ট্রেনের সময় দুপুর ৩ টে । আমরা চানটান করে লাঞ্চ করে রেডি হয়ে নিলাম এবং হোটেলে থেকে বেরোলাম তখন দুপুর আড়াইটে বেজে গেছে । বেরোনোর সময়ে হোটেলের রিসেপশনের সঙ্গে টাকাপয়সা নিয়ে একটা তিক্ত অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হলাম । কোনও কারণ ছাড়াই এরা আমাদের থেকে বেশি টাকা দাবী করতে থাকল । এরজন্য আমাদের বেশ কিছুটা দেরি হয়ে গেল । যখন দেখলাম টাকা না দিলে এরা আমাদের গাড়ি করে স্টেশনে পৌঁছে দেবে না, তখন দিতে বাধ্য হলাম । আমরা এই হোটেল বুকিং করেছিলাম ট্রিপ-অ্যাডভাইজার থেকে, তাই এদের পেজে আমি আমাদের অভিজ্ঞতার কথা বিস্তারিত লিখেছি । জানতে চাইলে এখানে ক্লিক করতে হবে ।

স্টেশনে পৌঁছলাম তখন দুপুর ২ : ৪৫ । দেখলাম আমাদের ট্রেন এসে গেছে । মালপত্র নিয়ে ওভারব্রীজ পেরিয়ে ট্রেনের দৈর্ঘ্য বরাবর অনেকটা হেঁটে/দৌড়ে যখন আমাদের এ সি থ্রি টিয়ার কামরায় উঠলাম, তার মিনিট দু'য়েকের মধ্যেই ট্রেন ছেড়ে দিল ।

ফেরার পথে ট্রেন 'আগ্রা ফোর্ট' স্টেশন হয়ে যায় । আগ্রা ফোর্ট পেরোনোর পরেই ট্রেন যমুনা পেরোয় আর ব্রীজের ওপরে একটা নির্দিষ্ট জায়গা থেকে তাজমহলকে কয়েকমূহুর্ত দেখা যায় । আকাশের চাঁদের আলো মোটামুটি ছিল, আবার একবার চাঁদের আলোয় তাজমহল দেখা হয়ে গেল । তবে এবার ফ্রি-তে !

কোনও স্টেশনের কামসামের সঙ্গে যোগাযোগ করা গেল না, তাই আমরা রেলের ক্যান্টিন থেকেই রাতের এবং পরেরদিন দুপুরের খাবার নিয়ে নিলাম । ট্রেন শিয়ালদায় পৌঁছনোর কথা দুপুর ৩  :  ৫৫-য়, পৌঁছলো সাড়ে পাঁচটারও পরে । আমাদের ৭ দিন ব্যাপী দিল্লী-আগ্রা-জয়পুর ভ্রমণ শেষ হল ।

সারসংক্ষেপঃ

১. আগ্রা থেকে জয়পুর যাওয়ার অনেক ট্রেন আছে যার মধ্যে ইন্টারসিটিতে গেলে সবচেয়ে সকাল সকাল পৌঁছনো যায় । শিয়ালদহ থেকে জয়পুর সরাসরি যাওয়ার দু'টো ট্রেন আছে - দু'টোই অনেক রাতে জয়পুর পৌঁছয় ।
২. জয়পুরে আমরা ছিলাম হোটেল অভিরাজ প্যালেসে । এটা বেশ খারাপ হোটেল, তাই আমি এখানে না থাকার জন্যই বলব ।
৩. জয়পুরে দেখার জায়গা অ্যালবার্ট হল, হাওয়া মহল, যন্তর মন্তর, সিটি প্যালেস, জলমহল, আম্বের ফোর্ট, জয়গড় ফোর্ট, নাহারগড় ফোর্ট, বিড়লা মন্দির ইত্যাদি । এগুলো নিজেরা গাড়ি ভাড়া করেও ঘোরা যেতে পারে অথবা আর টি ডি সি-র থেকে অর্ধ্বদিন বা সারাদিনের ট্যুর নিয়েও ঘোরা যেতে পারে । হাফ ডে ট্যুর বা ফুল ডে ট্যুরের জন্য আর টি ডি সি-র ওয়েবসাইট http://rtdc.rajasthan.gov.in/CityTours.aspx থেকে বুকিং করা যেতে পারে । এদের টোল-ফ্রি ফোননম্বর - 1800-103-3500.
৪. জয়পুরের সবকিছু দেখার জন্য একদিন থাকলেই চলে । জয়পুরের প্রধান আকর্ষণ অবশ্যই কেল্লা, তাই সেগুলো দেখার জন্য বেশি সময় হাতে রাখার দরকার ।
৫. পিঙ্ক সিটি জয়পুরের ভেতরে একটা বিশেষ জায়গাকে বলা হয় । এখানকার সমস্ত বাড়ি ঘর দোকান সবকিছুই গোলাপি । এই জায়গাটা আলাদা করে পাঁচিল দিয়ে ঘেরা ।
৬. জয়পুরের বেশিরভাগ জায়গাই রাজা জয় সিং-এর আমলে তৈরি । তাঁর নাম থেকেই এই জায়গার নাম জয়পুর ।
৭. জয়পুরে খাবারের দাম ঠিকঠাক । দিনে মাথাপিছু ৩০০ - ৩৫০ টাকার মধ্যে ভালোভাবে খেয়ে নেওয়া যায় ।

উপসংহারঃ

আমরা যখন এই ভ্রমণটার পরিকল্পনা করেছিলাম, তখন শুধুমাত্র দিল্লী আর আগ্রার কথা ভেবেছিলাম, জয়পুরটা তখনও যুক্ত হয়নি । তারপর দেখা গেল আমাদের যাত্রাসূচীতে একদিন যোগ করলে জয়পুরটা হয়ে যাচ্ছে, আর দিল্লী বা আগ্রা থেকে জয়পুর বেশ কাছেই, তাই জয়পুর যোগ করা হল । প্রকৃতপক্ষে জয়পুর রাজস্থানে পড়লেও রাজস্থান ভ্রমণের সময়ে জয়পুর থাকলে ব্যাপারটা একটু কঠিন হয়ে পড়তে পারে । তাই জয়পুর আলাদাভাবে ঘুরে আসতে পারলে ভালো । দিল্লী-আগ্রা-জয়পুর এগুলো সবই ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ স্থান । ছোটবেলার ইতিহাস বইতে পড়া এইসব জায়গা আর এখানে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো যেন চোখের সামনে ভাসতে থাকে । তাজমহল চত্বরে ঘোরার সময়ে মনে হয় 'আমি যেখান দিয়ে হাঁটছি, সেখান দিয়ে একসময়ে হেঁটেছিলেন সম্রাট শাহজাহান', ফতেপুর সিক্রিতে গিয়ে মনে হয়, 'আমি যেখানে দাঁড়িয়ে আছি, একসময়ে সেখানে দাঁড়িয়ে থাকতেন সম্রাট আকবর', জয়গড় ফোর্টে গিয়ে মনে হয় 'যেখানে বসে মহারাজা জয় সিং নৃত্যগীতবাদন শুনতেন, সেখানে আমি চুপচাপ বসে আছি' । এই অনুভূতিটাই ঐতিহাসিক জায়গা ভ্রমণের সবচেয়ে বড় পাওনা বলে আমার মনে হয় । রাষ্ট্রপতিভবনের সামনে দাঁড়ালে মনে হয় 'এখানে যিনি থাকেন, তিনি আমাদের দেশের সর্বোচ্চ নাগরিক - তাঁর গাড়িতে কোনও নম্বর প্লেট থাকে না' । এগুলো শুধু ওই জায়গায় দাঁড়িয়ে উপলব্ধি করা যায় । দিল্লী, আগ্রা, জয়পুর এই তিনটে জায়গাই এদের নিজেদের মহিমায় ইতিহাসের পাতায় স্থায়ী জায়গা করে নিয়েছে । দ্বিমাত্রিক ইতিহাসের পাতা থেকে চতুর্মাত্রিক সময়ের এই প্রবাহকে অনুধাবন করার একমাত্র উপায় - এই ত্রিমাত্রিক নির্মাণ ও ইতিহাসকে নিজের চোখে দেখে আসা !

দিল্লী-আগ্রা-জয়পুর ভ্রমণের আরও ছবি দেখতে হলে click here.

Monday, June 2, 2014

মহারাষ্ট্র ভ্রমণ

মি আমার বেড়ানোর ব্লগ যেদিন থেকে লেখা শুরু করেছি, তারপরে মহারাষ্ট্র ভ্রমণই সবচেয়ে দীর্ঘ । শনিবার ২৪শে মে, ২০১৪ রাতে বেরিয়ে আমরা ফিরেছি সোমবার ২রা জুন, ২০১৪ । এটা ঠিক যে সময়ের এই পরিসরে গোটা মহারাষ্ট্র রাজ্যটা দেখা সম্ভব নয়, আমরা দেখিও নি । আমরা মহারাষ্ট্রের কয়েকটা বিশেষ জায়গায় ভ্রমণ করেছি, তাই এই লেখার নাম মহারাষ্ট্র ভ্রমণ । এই ৯ - ১০ দিনে আমরা যা ঘুরেছি, তা একসঙ্গে লিখে পোস্ট করতে অনেকদিন সময় লাগবে শুধু তাইই নয়, লেখার পরিমানও দীর্ঘ হবে যা একসঙ্গে পড়ে ওঠা ক্লান্তিকর লাগতে পারে । তাই এবারে একটু অন্যভাবে লিখব । আমাদের ভ্রমণের একেকটা জায়গা লিখে পোস্ট করে দেব । তারপরে আবার পরের ভ্রমণের জায়গাটা যোগ করব । এই পরিকল্পনা মাথায় রেখে আমাদের ভ্রমণের প্রথম জায়গা থেকে শুরু করছি - মুম্বই ।

মুম্বই ভ্রমণঃ

২৪শে মে, ২০১৪ হাওড়া থেকে মুম্বই মেলের এসি থ্রি-টীয়ারে আমাদের যাত্রা শুরু । এবারে দলে একজন শিশুসহ মোট ১৪ জন - আমি, আমার স্ত্রী, বাবা, মা, আমার অফিসের কলিগ্‌ সমীরণদা, বৌদি, ঋজু, আমার আরেক কলিগ্‌ কঙ্কনাদি, অমিতদা, মিনকা (শিশুশিল্পী), কাকু, কাকিমা (কঙ্কনাদির বাবা-মা), আমার আরেক কলিগ্‌ বৈশাখী ও কাকিমা । মুম্বই মেল ছাড়ে রাত ৮ : ১৫ য় । ট্রেনে রাতের খাবার আমরা নিয়েই উঠেছিলাম রুটি আর বৈশাখীর রান্না করা চিকেন । খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়লাম ।

নাগপুরে রেললাইনের ক্রসিং
দ্বিতীয় দিন অর্থাৎ ২৫শে মে, আমরা সারাদিনই ট্রেনে । আমাদের সবার সীট্‌ একসঙ্গে পড়েনি, জায়গা আর মানুষজন পারমুটেশন করে সবার সঙ্গে সবাই আড্ডা দিচ্ছিলাম । দূরে কোথাও গেলে বড় দলে যাওয়ার এই হচ্ছে সুবিধে - না হলে একটু বোরই লাগে । যাই হোক, ট্রেনের পথে একটা উল্লেখযোগ্য জায়গা হল নাগপুর । নাগপুর স্টেশনে ঢোকার ঠিক আগে একটা রেল লাইনের ক্রসিং আছে যেখানে আমাদের দু'জোড়া লাইন অন্য দু'জোড়া লাইনকে প্রায় ৯০ ডিগ্রিতে ক্রস করে । এই জিনিস সারা ভারতের মধ্যে শুধু এখানেই আছে । এখানে ট্রেন খুব ধীরে চলে, তাই বেশ ভালোভাবেই জিনিসটা দেখতে পেলাম ।

দুপুরে রেলের ক্যান্টিন থেকে চিকেন ভাত নেওয়া হল । রান্না বেশ বাজে । বিকেলে আকোলা-য় ট্রেন থামার পর আমরা এখানকার 'কাম সাম' এ খাবারের খোঁজ করলাম । মুস্কিল হল এখানে আবার নিরামিষ ছাড়া কিছু পাওয়া যায় না । কিন্তু এরা আমাদের একটা ভালো উপদেশ দিল । বলল - আমরা চাইলে ওদের কাছ থেকে নম্বর নিয়ে জলগাঁও এর 'কাম সাম' এ খাবারের অর্ডার দিয়ে রাখতে পারি । আমাদের কোচ আর সীট্‌ নম্বর বলে দিলে ওরা নিজেরা আমাদের খাবার পৌঁছে দিয়ে যাবে । সেইমতো জলগাঁও এর কাম সামে ফোন করে মিক্সড্‌ চাউমিন অর্ডার দেওয়া হল । ট্রেন জলগাঁও পৌঁছয় রাত পৌনে দশটায় - দাঁড়ায় এক মিনিট । এরই মধ্যে কাম সামের লোক এসে আমাদের খাবার দিয়ে গেল (আর অবশ্যই টাকা নিয়ে গেল) । দুপুরের ওই বাজে রান্না খাওয়ার পর এই খাবার সত্যিই অমৃত মনে হচ্ছিল । গপ্‌গপ্‌ করে খেয়ে ফেললাম ।

সি এস টি স্টেশনে আমাদের দল
২৬শে মে, ২০১৪ সোমবার । মুম্বই মেল মুম্বই পৌঁছয় ভোর ৫ : ২৫ এ আর আমাদের ট্রেন একটুও লেট না করে আমাদের পৌঁছে দিল । মুম্বই ! মানুষের স্বপ্নের শহর মুম্বই ! ছত্রপতি শিবাজী টার্মিনাস, গেটওয়ে অফ্‌ ইন্ডিয়া, মেরিন ড্রাইভ, তাজ হোটেল, বান্দ্রা, জুহু, সি-লীঙ্ক সম্বলিত মুম্বই ! শচীন গাভাসকার অমিতাভ আমীর খান শাহরুখের মুম্বই ! যে শহর সারারাত জেগে থাকে, সেই মুম্বই ! যে শহরের মানুষের প্রধান প্রিয় খাবার বড়াপাও, সেই মুম্বই ! তাজ হোটেলে জঙ্গী হামলার মুম্বই ! রেল বিস্ফোরণের মুম্বই ! আবার সেই বিস্ফোরণ থেকে দ্রুত স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় ফিরতে পারে যে শহর - সেই মুম্বই !

আমাদের 'হোটেল নিউ বেঙ্গল' ক্রওফর্ড মার্কেটে - স্টেশন থেকে হেঁটে মিনিটদশেক । তবে সঙ্গে মালপত্র থাকায় আর রাস্তায় লোকজনকে জিজ্ঞেস করতে হওয়ায় এই পথটা যেতে আমাদের আধঘন্টার বেশি লেগে গেল । হোটেলটা সবমিলিয়ে বেশ ভালো । ভেতরটা একটু গোলকধাঁধার মতো - হারিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা না থাকলেও হোটেলের ঘরের বিন্যাস বেশ জটিল । সেসব বাদ দিলে এমনিতে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ।

আমরা চানটান করে রেডী হয়ে নিলাম । আমাদের এখানে বিশ্রাম নেওয়ার সময় নেই - প্রথমদিনই আমাদের গন্তব্য 'আলিবাগ' । তার আগে হোটেলের লাগোয়া রেস্ট্যুরেন্টে কম্‌প্লিমেন্টারি ব্রেকফাস্ট সেরে নেওয়া হল ।

গেটওয়ে অফ ইন্ডিয়া
আলিবাগ মুম্বই থেকে দু'ভাবে যাওয়া যায় । এক, মুম্বই থেকে মান্ডোয়া (হ্যাঁ, সেই মান্ডোয়া - ভিজয় দীননাথ চৌহান !) পর্যন্ত লঞ্চে গিয়ে মান্ডোয়া থেকে বাসে আলিবাগ । আর দুই, পুরোটাই গাড়িতে । সেক্ষেত্রে সময় এবং খরচ অনেক বেশি । যাদের জলপথ পরিবহনে সমস্যা আছে, তাদের জন্য দ্বিতীয়টাই শ্রেয় ।



ক্যাটামেরনে যাওয়ার সময়ে ফেলে আসা মুম্বই শহর
আমরা হোটেল থেকে বেরিয়ে কয়েকটা ট্যাক্সি নিয়ে পৌঁছে গেলাম গেটওয়ে অফ ইন্ডিয়ায় - এখান থেকেই আলিবাগের লঞ্চ ছাড়ে । পি এন পি, অজন্তা আর মালদার - এই তিনটে বেসরকারি সংস্থার লঞ্চ চলে । লঞ্চের পরিষেবা খুবই ঘনঘন, কাজেই তাড়াহুড়ো না করলেও চলবে । আমরা পি এন পি র ক্যাটামেরন এ চড়লাম । এর নিচের ডেকটা এসি এবং নীল কাচে ঢাকা । চাইলে ওপরের ডেকে গিয়েও দাঁড়ানো যায় । ক্যাটামেরন ছাড়ামাত্রই আমরা ওপরে গিয়ে হাজির হলাম । শুধু আমরাই নয়, আরও বহু যাত্রীই এটা করল । ওপরের ডেকে দাঁড়িয়ে আরব সাগরের ওপর দিয়ে যেতে যেতে মুম্বই শহরের ক্রমশঃ দূরে সরে যাওয়া দেখতে অসাধারণ লাগে ! ক্যাটামেরনের টিকিট আগে থেকে কাটা না থাকলে কোনও ক্ষতি নেই, এরা যাওয়ার পথেই টিকিট কেটে নেয় । ভাড়া মাথাপিছু ১৫০ টাকা । এটা একটা ফেরি-কাম-বাস সার্ভিস, অর্থাৎ টিকিটের ভাড়াটা মুম্বই থেকে মান্ডোয়া পর্যন্ত ক্যাটামেরন আর মান্ডোয়া থেকে আলিবাগ পর্যন্ত বাস যোগ করে (না, ফেরারটা একসঙ্গে নয়, অত আবদার করে না !) ।

মান্ডোয়া জেটী
মান্ডোয়া পোঁছলাম দুপুর একটার একটু পরে । জেটীর কাছ থেকেই বাস ছাড়ে - আমরা বাসে উঠে পড়লাম । মান্ডোয়া থেকে আলিবাগ যাওয়ার রাস্তাটাও খুব সুন্দর । রাস্তার দু'ধারে পাহাড়ের সারি, আর গাছপালা ।






আমরা আলিবাগ পোঁছলাম তখন দুপুর পৌনে দু'টো । আলিবাগের প্রধান আকর্ষণ হল সমুদ্রের বীচ আর আলিবাগ কেল্লা । বাস কিন্তু বীচ্‌ পর্যন্ত নিয়ে যায় না । বাস থেকে নেমে আমরা ঠিক করলাম আগে লাঞ্চ করে তারপর সমুদ্রের ধারে যাব । এখানে একটা মুস্কিল হল । আলিবাগ শহরে আমিষ রেস্ট্যুরেন্ট প্রায় নেই বললেই চলে । অনেক খুঁজে বেশ অনেকটা হেঁটে তবে একটা পাওয়া গেল (নিরামিষই খেয়ে নিতে পারতাম ? কেন ??? আমি কি উন্মাদ ???) । সেখানে আমরা ফ্রায়েড রাইস, চিলি চিকেন ইত্যাদি খেয়ে আলিবাগ বীচের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম দু'টো বড়ো অটো নিয়ে । অটোপিছু ১০০ টাকা করে পড়ল ।

আলিবাগ বীচ থেকে কেল্লা
আলিবাগ বীচে কিন্তু সমুদ্র বিশেষ ঘ্যাম কিছু না । ঢেউ ফেউ কিস্যু নেই । এখানকার প্রধান দেখার জায়গা হল শিবাজীর কেল্লা । এই কেল্লা সমুদ্রের জলের মধ্যে - ভাঁটার সময়ে হেঁটে যাওয়া গেলেও জোয়ারের সময়ে যাওয়া যায় না । সমুদ্রের পাড় থেকে এই কেল্লা প্রায় এক কিলোমিটারের মতো । আমরা দু'টো ঘোড়ার গাড়ি নিলাম যাওয়ার জন্য । যাতায়াত মিলিয়ে পড়ল মাথাপিছু ১০০ টাকা করে ।

আলিবাগ কেল্লার মাথা থেকে ভেতরের দৃশ্য
আলিবাগে ঢুকতে মাথাপিছু ৫ টাকা করে টিকিট লাগে । কেল্লার ভেতরটা বেশ বড়, যদিও অনেক জায়গাই ভেঙ্গে গেছে । তবে কেল্লাটা দেখে বোঝা যায় যে এখানে সুরক্ষা ব্যবস্থা বেশ ভালো ছিল । সাধারণতঃ বাইরের শত্রুর আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য এবং দূর থেকে শত্রুকে দেখতে পেয়ে যুদ্ধ করার জন্য এই জাতীয় কেল্লা তৈরি করা হয়, আলিবাগ কেল্লা দেখে মনে হয় এটা সে'ব্যাপারে বেশ উপযুক্তই ছিল । কেল্লার ভেতরে একটা মন্দির আছে যেটা রক্ষণাবেক্ষণ করা হয় । কেল্লার সামনের দিকে একটা দরজা আছে যেটা দিয়ে বেরিয়ে পাথরে পাথরে পা দিয়ে সমুদ্রের ধারে যাওয়া যায় । জায়গাটায় ঘুরতে বেশ লাগে ।

ফেরার সময়ে আলিবাগ জেটী থেকে
আলিবাগ কেল্লায় বেশ অনেকক্ষণ ঘোরাঘুরি করে আমরা আবার সমুদ্রের পাড়ে ফিরে এলাম । সেখানে প্রথমে গোলা খাওয়া হল । তারপর আরও কিছুক্ষণ পরে আবার অটো ধরে বাসস্ট্যান্ডে এলাম । এখানে এসে আবার আখের রস খাওয়া হল । তখন বাজে বিকেল পৌনে ছটা । ফেরার পথেও আমরা পি এন পি র বাস ধরলাম । ৬ : ৩০ টায় পি এন পি র শেষ বাস আর সাড়ে সাতটায় শেষ ফেরি । মান্ডোয়া জেটি থেকে যখন আমাদের ক্যাটামেরন ছাড়ল, তখন আকাশের আলো দেখে বিকেল বলা না গেলেও রাত বলা যায় না কখনওই, বরং সন্ধ্যে বলা যেতে পারে ।

রাতের আলোয় গেটওয়ে অফ ইন্ডিয়া
গেটওয়ে অফ্‌ ইন্ডিয়া ফিরতে ফিরতে রাত ৮ : ৩০ বাজল । আমাদের অফিসের কয়েকজন প্রাক্তন সহকর্মী তাদের বর্তমান কর্মসূত্রে মুম্বইতে থাকে, আমরা আগে থেকেই তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে ঠিক করেছিলাম আজ সন্ধ্যেয় দেখা করব । সেইমতো সবার সঙ্গে দেখা করে আমরা ডিনার করতে গেলাম মুম্বইয়ের বিখ্যাত রেস্ট্যুরেন্ট 'বড়েমিঞা'য় । এটা গেটওয়ে অফ্‌ ইন্ডিয়া থেকে হেঁটে বড়জোর মিনিট দশেক । এখানে অত্যন্ত সুস্বাদু বিরিয়ানি, ব্রেন ফ্রাই, ভুনা ইত্যাদি ইত্যাদি খাওয়া হল ।

বান্দ্রা বীচ্‌
রাত সাড়ে দশটা বাজে, কিন্তু মুম্বইতে এটা কিছুই না । আমাদের দলের কয়েকজন হোটেলে ফিরে গেল আর বাকিরা ট্যাক্সি নিয়ে গেলাম বান্দ্রা । জায়গাটা বিশেষ কিছু না, সমুদ্রের ধারে পাথরের ওপর বসার জায়গা । কিন্তু যাওয়ার পথটা সুন্দর - বিশেষ করে বান্দ্রা-ওর্লি সী-লিঙ্ক । এই সী-লিঙ্ক সম্পর্কে বিস্তারিত বলছি না, গুগল্‌ সার্চ করলে অনেক বেশি তথ্য জানা যাবে । যেটা গুগল্‌ থেকে জানা যাবে না সেটা হল এর ওপর দিয়ে যাওয়ার অসাধারণ অভিজ্ঞতা, যা আমাদের হল । গাড়ির স্পীড প্রায় একশ' র কাছাকাছি রেখে আলোকোদ্ভাসিত ৫.৬ কিলোমিটার লম্বা এই ব্রীজে চড়ে সমুদ্রের ওপর দিয়ে যাওয়া আর সেইসঙ্গে ডানদিকে চোখ রেখে মুম্বই শহরের স্কাইস্ক্যাপার এর দৃশ্য দেখা - এ জিনিস নিজের চোখে না দেখলে ভালোলাগাটা অনুভব করা শক্ত । বান্দ্রায় শাহরুখের বাড়ি মান্নাত-এর সামনে আমরা ট্যাক্সি ছেড়ে দিয়ে সমুদ্রের ধারে গিয়ে বসলাম (বাড়ির ভেতরে আর গেলাম না কারণ গেলে আমাদের ডিনার করার জন্য জোর করত আর আমাদের পেটে তখন একেবারেই জায়গা ছিল না) । সমুদ্রের ধারে বসে থাকতেও খুব ভালো লাগছিল । ফেরার সময়েও একই পথ । হোটেলে ফিরলাম তখন রাত প্রায় একটা ।

২৭শে মে, ২০১৪ মঙ্গলবার । আমাদের 'এলিফ্যান্টা কেভ' যাওয়ার দিন । সকালটা মোটামুটি আগেরদিনের মতোই, ব্রেকফাস্ট করে ট্যাক্সি নিয়ে গেটওয়ে অফ্‌ ইন্ডিয়া যাওয়া আর সেখান থেকে 'এলিফ্যান্টা' র লঞ্চ ধরা । এটা আগেরদিনের মতো ক্যাটামেরন নয়, পাতি লঞ্চ । লঞ্চের ভাড়া মাথাপিছু ১৫০ টাকা, তবে এটা যাতায়াত মিলিয়ে । জলপথের বিবরণ প্রায় আগেরদিনের মতোই, পার্থক্য হল মান্ডোয়া বা আলিবাগ মূল ভূখন্ডের মধ্যেই আর এলিফ্যান্টা একটা বিচ্ছিন্ন দ্বীপ ।

এলিফ্যান্টা যাওয়ার টয়ট্রেন
এলিফ্যান্টা দ্বীপে লঞ্চ জেটী থেকে একটা টয়ট্রেন চলে যেটা পাহাড়ের নিচ পর্যন্ত নিয়ে যায় । পথটা হেঁটে যাওয়ার পক্ষেও বেশি নয়, তবে ট্রেনে যাতায়াতের জন্য ১০ টাকাটা একেবারেই কম, তাই সবাই ট্রেনেই যায় । ট্রেন থেকে নেমে আমরা সিঁড়ি দিয়ে পাহাড়ের ওপরে উঠলাম ।




এলিফ্যান্টার ১ নং গুহা
এলিফ্যান্টা 'ভারতীয় পুরাতত্ত্ব বিভাগ' রক্ষণাবেক্ষণ করে । ঢোকার টিকিট মাথাপিছু ১০ টাকা আর ১৫ বছরের নিচে কোনও টিকিট লাগে না । এলিফ্যান্টা পাহাড় খোদাই করে তৈরি করা গুহামন্দির । এখানে সবমিলিয়ে মোট পাঁচটা গুহা আছে যার মধ্যে প্রথমটাই সবচেয়ে বড় আর সবচেয়ে সুন্দর । সম্পূর্ণভাবে পাহাড় কেটে তৈরি এই গুহামন্দিরের ভেতরে পাথরে খোদাই করে প্রচুর মূর্তি আর ছবি । জিনিসগুলো দেখে আশ্চর্য হয়ে যেতে হয় ! কোনও বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতির সাহায্য ছাড়াই শুধুমাত্রা ছেনি আর হাতুড়ির সাহায্যের এই অসাধারণ ভাস্কর্য সৃষ্টি করেছিলেন সে'যুগের শিল্পীরা । এই গুহা তৈরির সময়কাল আনুমানিক পঞ্চম থেকে অষ্টম শতাব্দী যদিও কে বা কারা তৈরি করেছিলেন সেটা সঠিকভাবে জানা যায় না । বাইরে প্রবল গরম হলেও গুহার ভেতরটা বেশ ঠান্ডা । এখানে আমরা বেশ অনেকক্ষণ ধরে এই সৌন্দর্য্য উপভোগ করলাম ।

এরপর আমরা একে একে ২, ৩, ৪ ও ৫ নম্বর কেভে গেলাম । এগুলো তুলনামূলকভাবে ছোট আর শেষেরটা অসম্পূর্ণ । সবকিছু দেখা শেষ হলে আমরা এলিফ্যান্টা গুহা থেকে বেরিয়ে আবার পাহাড়ের নিচে নেমে এলাম ।

গেটওয়ে অফ ইন্ডিয়ার সামনে আমাদের দল
দুপুর দু'টো বাজে, এখন মুম্বই গিয়ে লাঞ্চ করতে গেলে অনেক দেরি হয়ে যাবে তাই ঠিক হল এখানেই খেয়ে নেওয়া হবে । সেইমতো একটা ভাতের হোটেলে ঢুকে খেয়েদেয়ে নেওয়া হল । তারপর এলিফ্যান্টা থেকে ফেরা । প্রথমে টয়ট্রেন আর তারপর লঞ্চ । ফেরার সময়ে বোধহয় জোয়ার ছিল, আমাদের লঞ্চটা বেশ দুলছিল আর মাঝে মাঝেই সমুদ্রের জলের ঝাপ্টা লঞ্চের মধ্যে ঢুকে আমাদের ভিজিয়ে দিচ্ছিল । সে এক মজার অভিজ্ঞতা । যাই হোক, মুম্বই পৌঁছলাম তখন বিকেল সাড়ে চারটে । এখান থেকে আমাদের হ্যাঙ্গিং গার্ডেন বা ঝুলন্ত উদ্যানে (না না, ব্যাবিলনের নয়, মুম্বইতেও একট আছে) যাওয়ার কথা ছিল, কিন্তু সেটা পাঁচটায় বন্ধ তাই আর গিয়ে লাভ নেই । সবাই হোটেলে ফেরার সিদ্ধান্ত নেওয়া হল । বাকিরা ট্যাক্সিতে চলে গেল আর আমি হেঁটে ফেরার সিদ্ধান্ত নিলাম । গেটওয়ে অফ্‌ ইন্ডিয়া থেকে আমাদের হোটেল হেঁটে আধঘন্টার বেশি লাগবে না, তাই শহরটাকে একটু পরিক্রমা করার জন্য হাঁটা শুরু করলাম ।

ফ্লোরা ফাউন্টেন
রাস্তায় যে উল্লেখযোগ্য জিনিসগুলো দেখলাম সেগুলো আগে লিখে নিই । মুম্বই মিউজিয়াম, বি এস ই বা বোম্বে স্টক এক্সচেঞ্জ এর বিশাল ঢ্যাঙা বাড়িটা, মুম্বই ইউনিভার্সিটি, ফ্লোরা ফাউন্টেন, ওরিয়েন্টাল বিল্ডিং এবং অবশ্যই সি এস টি । একটা কথা স্বীকার না কর উপায় নেই যে মুম্বইয়ের রাস্তাঘাট বেশ পরিষ্কার এবং লোকজনও রাস্তায় নিয়ম মেনে চলে বা গাড়ি চালায় । রাস্তায় হাঁটতে বেশ ভালোই লাগছিল ।

হোটেলে ফিরে এসে আবার তৈরি হলাম বেরোনোর জন্য । আমাদের মুম্বই ভ্রমণ প্রায় শেষের দিকে, এবার আমরা গেলাম মুম্বইয়ের বিখ্যাত মেরিন ড্রাইভের দিকে । হোটেল থেকে ট্যাক্সি নিয়ে মেরিন ড্রাইভের ওপর দিয়ে আমরা পৌঁছলাম চৌপাট্টি-তে । রাস্তাটা অনবদ্য । বহু হিন্দী ছবিতে মেরিন ড্রাইভ দেখানো হয় তাই মেরিন ড্রাইভ কেমন দেখতে সেটা আর কাউকে বলে দিতে হয় না । তবে জায়গাটা দিয়ে যেতে বা দাঁড়িয়ে থাকতে অসাধারণ লাগে সেটা বলতেই হবে ।

চৌপাট্টি
চৌপাট্টিতে আমরা সমুদ্রের ধারে কিছুক্ষণ সময় কাটালাম । সূর্য্যাস্ত হয়ে গেছে, আকাশের আলোটা দেখবার মতো হয়েছে । দেখতে পেলাম মেরিন ড্রাইভের আলোগুলো জ্বলে উঠল । এই জিনিসটাকে 'কুইন্স নেকলেস' বলে । চৌপাট্টিতে প্রচুর খাবারের দোকান আছে । আমরা সেখান থেকে বড়াপাও খেলাম । যারা খেতে ভালোবাসে তাদের উদ্দেশ্যে জানাই, মুম্বই বা মহারাষ্ট্রের লোকজন বড়াপাওকে একটা প্রচন্ড ঘ্যাম খাবার মনে করলেও জিনিসটা আদপেও তা নয় । দু'টো বান-পাঁউরুটি র মধ্যে একটা বড় সাইজের ডালবড়া - ব্যাস । এবং খেতে সেরকম ভালো কিছু নয় । যাই হোক, এরপর আমরা ফুচকা, কুলফি ইত্যাদি খেয়ে আবার ফেরার পথ ধরলাম ।

হোটেলে ফিরে জিনিসপত্র গুছিয়ে হোটেল থেকে বেরোলাম তখন সাড়ে ন'টা । আমাদের পরবর্তী গন্তব্য 'গণপতিপুলে' । সেখানে যাওয়ার জন্য আমরা সি এস টি থেকে ট্রেন ধরে নামব রত্নগিরি । রত্নগিরি থেকে গণপতিপুলে গাড়িতে প্রায় একঘন্টা ।

আমাদের মুম্বই ভ্রমণ শেষ । এটা ঠিক যে আমরা আমাদের এই দু'দিনের সফরে মুম্বই শহরের প্রায় কিছুই দেখিনি । তবে যা দেখেছি সেই আলিবাগ বা এলিফ্যান্টা আমাদের খুবই ভালো লেগেছে । সেই ভালোলাগার অনুভূতি সঙ্গে নিয়েই শেষ করছি ব্লগের 'মুম্বই ভ্রমণ' ।

সারসংক্ষেপঃ

১. হাওড়া থেকে মুম্বই যাওয়ার সবচেয়ে জনপ্রিয় ট্রেন হল মুম্বই মেল । এছাড়া হাওড়া-মুম্বই দুরন্ত আছে কিন্তু এটা সপ্তাহে প্রতিদিন চলে না ।
২. যদি ট্রেনের ক্যান্টিনের খাবার ভালো না লাগে, তাহলে কাম-সাম থেকে নেওয়া যেতে পারে । এদের সুবিধে হল যেকোনও বড় স্টেশনেই এদের কাউন্টার আছে, আর ফোন করে অর্ডার দিলে আর সেইসঙ্গে কোচ নম্বর আর বার্থ নম্বর বলে দিলে এরা ট্রেনে এসে খাবার দিয়ে যায় ।
৩. মুম্বইতে অসংখ্য হোটেল আছে, তবে কম দামে হোটেল পাওয়া প্রায় অসম্ভব । আমরা ছিলাম ক্রওফর্ড মার্কেটের 'নিউ বেঙ্গল হোটেল'-এ । হোটেলের মান দারুণ কিছু না হলেও মোটামুটি দামের মধ্যে চলনসই । এদের ওয়েবসাইট http://www.hotelnewbengal.net/ থেকে সরাসরি বুকিং করা যেতে পারে বা এদের কলকাতার অফিস থেকেও বুকিং করা যেতে পারে । যোগাযোগ 033-22486664.
৪. মুম্বইতে বেশ কিছু ঘোরার জায়গা আছে তাদের মধ্যে গেটওয়ে অফ্‌ ইন্ডিয়া, মেরিন ড্রাইভ, হ্যাঙ্গিং গার্ডেন, চৌপাট্টি, জুহু, মিউজিয়াম ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য । যদিও আমাদের সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য আমরা এর মধ্যে শুধুমাত্র মেরিন ড্রাইভ আর চৌপাট্টিই দেখতে পেরেছি ।
৫. মুম্বই থেকে জলপথে আলিবাগে যাওয়া যেতে পারে । এখানকার শিবাজীর কেল্লা বিশেষ উল্লেখযোগ্য ।
৬. মুম্বই থেকে জলপথে এলিফ্যান্টা দ্বীপে গিয়ে এলিফ্যান্টা গুহা অবশ্যই দেখা উচিৎ । পাহাড় কেটে তৈরি প্রায় ছ'শ - ন'শ বছরের পুরনো এই গুহার ভেতরের ভাস্কর্য ভীষণরকমই চিত্তাকর্ষক ।
৭. মুম্বই গেলে একবার অন্তত মেরিন ড্রাইভে যাওয়াই উচিৎ । দিন বা রাত যেকোনও সময়েই এর দৃশ্য অনবদ্য ।

মুম্বই ভ্রমণের আরও ছবি দেখতে হলে click here.

গণপতিপুলে ভ্রমণঃ

মুম্বই থেকে রত্নগিরি যাওয়ার জন্য রাত ১১ : ০৫ এ ছাড়ে কোঙ্কন কন্যা এক্সপ্রেস । এবারে আমরা স্লীপার ক্লাসের টিকিট কেটেছিলাম । রত্নগিরি পৌঁছনোর সময় হল পরেরদিন সকাল ৫ : ৩০ । আমরা হোটেল থেকে ডিনার প্যাক করে নিয়েছিলাম, ট্রেনে বসে সেগুলো খেয়ে ফেললাম । মেনু ছিল রুটি আর চিকেন বাটার মশালা ।

রত্নগিরি যাওয়ার এই রেলপথের নাম হল ‘কোঙ্কন রেলওয়ে’ । আমি আগেই শুনেছিলাম কোঙ্কন রেলওয়ের পথটা খুব সুন্দর, অনেকটা অংশই পাহাড় ও নদীর মধ্যে দিয়ে । যেহেতু আমরা পুরো পথটাই রাতে যাচ্ছি, কাজেই সেসব দেখার সুযোগ আপাতত নেই । শুয়ে পড়লাম ।

আমার ট্রেনে সাধারণতঃ ঘুম হয় না, আলো ফোটার পর দরজার ধারে গিয়ে দাঁড়ালাম । বাইরের দৃশ্য সত্যিই খুব সুন্দর । রেলপথটা পুরোটাই পাহাড়ের ভেতর দিয়ে, মাঝে মাঝে পাশে নদী চলেছে । পথটা অনেকটা উঁচু । মাঝে মাঝে ট্রেন টানেলের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে । একেকটা টানেল বেশ লম্বা । রত্নগিরি পৌঁছনোর কিছুক্ষণ আগে একটা টানেল পড়ল সেটা যেন শেষই হতে চাইছিল না । আমার ধারণা সেটা প্রায় ৫ কিলোমিটার দীর্ঘ । আমরা যারা সমতলে থাকি, পাহাড়ের টানেলের মধ্যে দিয়ে ট্রেনে যাওয়ার সুযোগ যাদের কদাচিৎ হয়, তারা এই জিনিস দেখে যে অভিভূত হয়ে পড়বে তাতে আর সন্দেহ কি ?

এই সুন্দর পথে চলতে চলতেই সুন্দর স্টেশন রত্নগিরি এসে গেল । আমাদের ট্রেন আধঘন্টা মতো লেট ছিল । রত্নগিরি স্টেশনটা বলতে গেলে একটা পাহাড়ের মাথায়, স্টেশন থেকে বেরোতে গেলে আরও কিছুটা ওপরে উঠতে হয় । এবার আমাদের কাজ গণপতিপুলে যাওয়ার গাড়ি জোগাড় করা ।

রত্নগিরির পথ ধরে
রত্নগিরি থেকে গাড়ি পাওয়াটা খুব একটা সহজ নয় । প্রথমতঃ স্টেশনটা খুব বড় কিছু নয়, তাই স্টেশনে কোনও গাড়ির স্ট্যান্ড নেই । যেটা আছে সেটা অটোর স্ট্যান্ড । এখান থেকে অটো গণপতিপুলে যায় কিন্তু আমাদের মালপত্র নিয়ে সেভাবে যাওয়া সম্ভব নয় । অনেক খোঁজাখুঁজি করে শেষপর্যন্ত্য দু’টো গাড়ি পাওয়া গেল । দু’টো গাড়ি মিলিয়ে পড়ল ২,৮০০ টাকা ।

গণপতিপুলের পথে সমুদ্রের দৃশ্য

রত্নগিরি জায়গাটা বেশ সুন্দর । বেশ ফাঁকা ফাঁকা মালভূমি ধরনের জায়গা । রাস্তাগুলো মাঝে মাঝে অনেকটা ওপরে উঠে গেছে আবার কখনও কখনও নেমে গেছে । এইভাবে প্রায় মিনিট চল্লিশেক চলার পরে হঠাৎ আমাদের পাশে চলে এল সমুদ্র । পাহাড়ের ওপর থেকে এভাবে আমি কখনও সমুদ্র দেখিনি । জলে প্রচন্ড ঢেউ না থাকলেও পরিষ্কার জলটা দেখতে দারুণ লাগছিল । এই দৃশ্যই রত্নগিরি থেকে গণপতিপুলে যাওয়ার পথে সবথেকে বড় পাওনা ।

গণপতিপুলে পোঁছলাম তখন সকাল ৭ : ৪৫ । এখানে আমাদের বুকিং ছিল এম টি ডি সি-র (মহারাষ্ট্র ট্যুরিজম্‌ ডেভেলপ্‌মেন্ট কর্পোরেশন) রিসর্টে । আমাদের বুকিং সকাল ১০ টা থেকে । এরা বলল তার আগে কোনও ঘরই ফাঁকা হবে না, তাই আমাদের ১০ টা পর্যন্ত বসে থাকতে হবে । তবে ঘর না পেলেও একটা কমন্‌ রেস্ট রুম আছে সেখানে ফ্রেশ হয়ে নেওয়া যেতে পারে ।

গণপতিপুলে রিসর্টের ভেতর
রিসর্টের ভেতরটা খুব সুন্দর – গাছপালা বা বাগানের নিয়মিত পরিচর্যা করা হয় । একেকটা দোতলা বিল্ডিং-এ মোট বারোটা করে ঘর । জায়গাটা সবমিলিয়ে বেশ বড় । প্রত্যেকটা বিল্ডিং-এর সামনে একটা ছোট পার্কের মতো জায়গা, সেখানে স্লীপ, দোলনা, ঢেঁকি, বসার জায়গা ইত্যাদি আছে ।

রিসর্টে আমাদের কটেজ
এরকমই একটা বিল্ডিং-এর দোতলায় আমাদের চারটে ঘর দেওয়া হল । একটায় আমরা চারজন, একটায় কঙ্কনাদিরা চারজন, আর বাকি দু’টোয় বৈশাখী ও সমীরণদারা । ঘরগুলো খুবই সুন্দর এবং বেশ বড় । চারজন থাকার জন্য একটা করে ডাবল্‌ বেড আর দু’টো করে গদি দেয় । প্রত্যেকটা ঘরের লাগোয়া একটা ব্যালকনি আছে সেখান থেকে সমুদ্র দেখা যায় । সামনের নারকোল গাছের মধ্যে দিয়ে এই দৃশ্য অসাধারণ !

গণপতিপুলে বীচ্‌
আমরা কিছুক্ষণের মধ্যে সমুদ্রের গেলাম চান করতে । আমি এর যতবার সমুদ্রে গেছি, বঙ্গোপসাগরেই গেছি - কখনও আরব সাগরে চান করিনি, এবারেই প্রথম করলাম (না, আলাদা কিছু লাগল না !) । আরব সাগরে এমনিতে ঢেউ কম, তবে গণপতিপুলে অঞ্চলে সমুদ্রের ঢাল বেশ বেশি, তাই এখানে ঢেউ বেশি আর সেই সঙ্গে সঙ্গে আন্ডার কারেন্টও বেশি । আর এখানকার জলের আরেকটা বৈশিষ্ট্য হল জলটা বেশ নীল, বিশেষ ঘোলা নয় । জলে চালানোর জন্য আবার ওয়াটারক্র্যাফটও ভাড়া পাওয়া যায় ।

প্রায় ঘন্টাখানেক চানটান করে জল থেকে উঠে এলাম । সমুদ্রে চান করলেই প্রচন্ড খিদে পায় আর ঠিক পাড়েই যখন শাঁসালো ডাব বিক্রি করে, তখন খিদেটা আরও বেড়ে যায় । যাই হোক, ডাব টাব (টাব মানে ডাবের শাঁস) খেয়ে ঘরে এসে আবার চান করে নিলাম ।

এখানে একটা বেশ বড় ডাইনিং এরিয়া আছে । দুপুরে ভাত, ডাল, তরকারি, মাংস, ফ্রাইড রাইস, চিলি চিকেন ইত্যাদি খাওয়া হল । খাবারের মান ভালো, কিন্তু এদের একটা সমস্যা হল এরা খাবার সার্ভ করতে ভীষণ দেরি করে । খাওয়ার পরে যে যার ঘরে এসে বিশ্রাম নিলাম ।

সমুদ্রের ওপর মেঘের আড়ালে সূর্য্যাস্ত
বিকেলে আরেকবার সমুদ্রের ধারে যাওয়া হল । গণপতিপুলেতে সমুদ্র ছাড়া আর কিছুই নেই, তবে এখানকার বীচটা খুব সুন্দর, বসে থাকতে ভালোই লাগে । বীচে তিনচাকার মোটরবাইক, টয়ট্রেন ইত্যাদি চলে । বসে বসে সূর্য্যাস্ত দেখলাম । এটা আমার দেখা আরেকটা বিশেষ জিনিস – সমুদ্রের ওপর সূর্য্যাস্ত । সাধারণতঃ বঙ্গোপসাগরে বীচগুলোয় অর্থাৎ দীঘা, পুরী, তাজপুর, মন্দারমণি, শঙ্করপুরে আমরা সূর্য্যোদয়ই দেখি, সূর্য্যাস্ত দেখা যায় না কারণ এইসব জায়গায় সমুদ্রের ওপর সূর্য্যাস্ত হয় না । গণপতিপুলেতে ঠিক এটাই দেখা গেল কারণ আরব সাগর ভারতের পশ্চিমে । অবশ্য পুরোটা দেখা গেল না, কারণ শেষটা সূর্য্য মেঘে ঢেকে গেছিল ।  তবে দিনের শেষ আলোয় যে বর্ণচ্ছটা, সেই পাওনাটাই বা কম কি ?

এরপরে আর কিছু করার নেই – কিছু দেখারও নেই । সন্ধ্যেবেলা চা-টা খেয়ে আড্ডা মেরে সময় কাটল । রাতে খাওয়ার সময়ে মোটামুটি দুপুরের মেনুই নেওয়া হল আর এরা দুপুরের মতোই দিতে দেরিও করল । আমরা পরেরদিন সকালে এখান থেকে বেরিয়ে যাব – আমাদের পরবর্তী গন্তব্য ‘সির্ডি’ । সেইমতো রাতেই ব্যাগট্যাগ গুছিয়ে রেখে শুয়ে পড়লাম । আমাদের চারজনের মধ্যে আমি ব্যালকনিতে শুলাম । এখানে নিরাপত্তার কোনও সমস্যা নেই, তাই ব্যালকনির দিকের দরজা খুলেই রাখলাম । মজার ব্যাপার, সমুদ্রের একেবারে ধারে হওয়া সত্ত্বেও বারান্দার হাওয়া একেবারেই দিচ্ছিল না । তবে বাইরেটা খুব গরম না হওয়ায় শুয়ে থাকতে ভালোই লাগছিল ।

আমাদের ব্যালকনি থেকে সমুদ্র
পরেরদিন সকালে আমাদের গাড়ি এল তখন ছ’টা । এটা একটা ১৮ সীটের টেম্পো-ট্রাভেলর । সেই গাড়ি আমাদের আবার রত্নগিরি পৌঁছে দিল তখন সাতটা বাজে । রত্নগিরি থেকে আমরা নাসিকের ট্রেন ধরব । নাসিক থেকে আবার গাড়ি করে সির্ডি । সেখানে ভ্রমণটা আসবে আমার ‘মহারাষ্ট্র ভ্রমণ’-এর পরবর্তী অংশে । আপাতত ‘গণপতিপুলে ভ্রমণ’ এই পর্যন্তই ।

সারসংক্ষেপঃ

১. মহারাষ্ট্রের সমুদ্র সৈকতে গণপতিপুলে একটা সুন্দর ঘোরার জায়গা । কলকাতা থেকে শুধু গণপতিপুলে যাওয়ার কোনও মানে না হলেও মুম্বই গেলে এখানে একবার যাওয়া যেতেই পারে । বিশেষ করে যারা মুম্বইতে বা মহারাষ্ট্রের উপকূল এলাকায় থাকে, তারা একবার এখানে ঘুরে আসতেই পারে ।
২. গণপতিপুলের নিকটতম রেলওয়ে স্টেশন রত্নগিরি । এখান থেকে গণপতিপুলে যাওয়ার জন্য গাড়ি বা অটোরিক্সা পাওয়া যায় । রত্নগিরি থেকে গণপতিপুলে যেতে একঘন্টার মতো লাগে ।
৩. গণপতিপুলেতে কিছু হোটেল থাকলেও এম টি ডি সি র রিসর্টটাই সবচেয়ে সুন্দর এবং সবচেয়ে সুন্দর জায়গায় । ভাড়া একটু বেশি হলেও এখানেই থাকা শ্রেয় । এদের ওয়েবসাইট http://mtdcrrs.maharashtratourism.gov.in/Account/Login.aspx থেকে সরাসরি বুকিং করা যেতে পারে ।
৪. এম টি ডি সি-র রিসর্টটা সমুদ্রের একেবারে ধারেই । ঘর থেকেই সমুদ্র দেখতে পাওয়া যায় ।
৫. এখানকার সমুদ্রের রঙ বেশ নীল । এখানে সমুদ্রে ঢেউও বেশ ভালো, তাই চান করেও আনন্দ পাওয়া যায় ।
৬. এম টি ডি সি-র খাওয়াদাওয়া ভালোই, তবে দাম একটু বেশি ।

গণপতিপুলে ভ্রমণের আরও ছবি দেখতে হলে click here.

সির্ডি ভ্রমণঃ

রত্নগিরি থেকে নাসিক যাওয়ার জন্য মঙ্গলা – লাক্ষাদ্বীপ এক্সপ্রেস ছাড়ে সকাল ৭ :  ৪০ এ । আমাদের ট্রেন এল মিনিট দশেক দেরিতে । এই রেলপথও কোঙ্কন রেলওয়ে – আমরা আগেরদিন যে পথ দিয়ে এসেছি সেই পথেই পানভেল পর্যন্ত্য ফিরে যাব । পানভেল থেকে পথ আলাদা হবে । অর্থাৎ এখন যেতে যেতে আমরা দিনের আলোয় দেখতে পাব কোঙ্কন রেলওয়ের অসাধারণ সৌন্দর্য্য ।

কোঙ্কন রেলওয়ে
গেলাম – দেখলাম – এনজয় করলাম । সত্যিই অনবদ্য দৃশ্য । আগেরদিন সকালে যে দৃশ্য অল্পক্ষণের জন্য দেখতে পেয়েছিলাম সেই দৃশ্যই অনেকক্ষণ ধরে দেখলাম । একের পর এক পাহাড়, তার মাঝখান দিয়ে ছুটে চলেছে আমাদের ট্রেন । একটা পাহাড়ের টানেল থেকে বেরোচ্ছে তো আরেকটায় ঢুকে পড়ছে । পুরো রাস্তাটাই পাহাড়ের ওপর দিয়ে, নিচে – বহুনিচে মাঝে মাঝে মানুষজন বসতি দেখা যাচ্ছে । চাষের ক্ষেত, নদী, জলাশয় সবমিলিয়ে এত সুন্দর লাগছিল যে সেটা লিখে বোঝানো কঠিন । এটুকু বলতেই পারি সির্ডিতে গিয়ে সাঁইবাবার মন্দির দেখে কার কিরকম ভালো লাগবে জানি না তবে আমাদের সির্ডি ভ্রমণের ষোলো আনার মধ্যে বারো আনা উশুল এই যাত্রাপথেই ।

কোঙ্কন রেলওয়ের আরও দৃশ্য
ট্রেনটা পাহাড়ী পথে বেশ ঠিকঠাক সময়ে চললেও সমতলে নামবার পর বেশ লেট করা শুরু করল । এছাড়া আমরা আরেকটা সমস্যায় পড়লাম আর সেটা হল লাঞ্চ নিয়ে । ট্রেনের ক্যান্টিনের যা লাঞ্চ তা আমাদের কারুরই পছন্দ হল না । কিন্তু ট্রেন সেরকম কোনও বড় স্টেশন দিয়েও যায় না যেখান থেকে লাঞ্চ তুলে নেওয়া যেতে পারে । এই পরিস্থিতিতে আমরা ক্যান্টিন থেকে কিছু ব্রেকফাস্ট নিয়ে নিলাম – পাঁউরুটি টোস্ট, ধোসা, বঢ়া ইত্যাদি । সেগুলোই লাঞ্চে খেয়ে নেওয়া হল ।

ট্রেনের নাসিক রোড পৌঁছনোর সময় হল বিকেল ৪ :  ৩৫ আর লেট করে সে পৌঁছল তখন সাড়ে পাঁচটা । নাসিক থেকে সির্ডি আরও ১০০ কিলোমিটারের কাছাকাছি, গাড়িতে প্রায় তিনঘন্টা লাগে । আমরা দু’টো গাড়ি বুক করে এগিয়ে চললাম সাঁইবাবার ডাকে সাড়া দিতে !

নাসিক থেকে সির্ডি - পথের বিবরণ দেওয়ার কিছু নেই । এটা একটা হাইওয়ে – আর পাঁচটা হাইওয়ের মতোই । মাঝে একবার একজায়গায় থেমে কিছু খেয়েদেয়ে নেওয়া হল । শেষপর্যন্ত্য আমরা সির্ডিতে আমাদের হোটেলে যখন পৌঁছলাম তখন রাত ন’টা ।

হোটেল অশোকা এক্সিকিউটিভের ঘর
সির্ডিতে আমাদের হোটেলের নাম হোটেল ‘অশোকা এক্সিকিউটিভ’ । শুধু আমি নয়, আমাদের দলের সকলের মতেই এই হোটেলটা আমাদের মহারাষ্ট্র ভ্রমণের মধ্যে সবচেয়ে ভালো হোটেল । ঘরগুলো প্রসস্ত, সুন্দরভাবে পরিচর্যা করা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন । এবং সেই অনুপাতে ভাড়া সেরকম কিছু বেশি নয় । এখানেও আমরা একটা চারবিছানার ঘর নিয়েছিলাম । সির্ডিতে আমাদের থাকার মেয়াদ খুব অল্প সময়, পরেরদিন সকালেই আমরা রওনা হয়ে যাব ঔরঙ্গাবাদ তথা ইলোরার উদ্দেশ্যে । বারবারই মনে হচ্ছিল এরকম সুন্দর একটা হোটেলে আরও কিছুক্ষণ থাকতে পারলে মন্দ হত না !

অশোকা এক্সিকিউটিভের নিজস্ব কোনও খাওয়ার ব্যবস্থা নেই । এবং সির্ডিতে আরেকটা অসুবিধে হল এখানে আমিষ রেস্ট্যুরেন্ট খুব কম । যাই হোক, বেশ খুঁজে পেতে একটা পাওয়া গেল যেটা আমাদের হোটেল থেকে যেদিকে সাঁই মন্দির, তার উল্টোদিকে মিনিট সাতেক হাঁটা দূরত্বে । এখানেও যেটা ভালো লাগল যে খাবারের মান বেশ ভালো এবং সেই অনুপাতে দাম বেশ কম । আমরা নানারকম খাবার ভাগাভাগি করে নিয়েছিলাম এবং তাতে মাথাপিছু খরচ পড়ল ১৫০ টাকা ।

৩০শে মে, ২০১৪ শুক্রবার । আমাদের সাঁই মন্দির দেখে ঔরঙ্গাবাদ যাওয়ার দিন । সাঁই মন্দির খোলে সকাল ছ’টায় । আমরা সকালে বেরিয়ে কয়েকটা অটো করে মন্দিরে গেলাম । এখান থেকে মন্দিরের অটোভাড়া মাথাপিছু ১০ টাকা করে, তবে সেটা আগে থেকে জানা না থাকলে অটোওয়ালারা যা খুশি তাই বলে । আমাদের হোটেল থেকে এটা আমাদের আগেই জানা ছিল ।

সাঁই মন্দিরে কোনও বৈদ্যুতিন দ্রব্য নিয়ে ঢোকা নিষিদ্ধ । আমাদের সঙ্গে থাকা ক্যামেরা মোবাইল চটি (হ্যাঁ, আমি জানি চটি বৈদ্যুতিন দ্রব্য নয়) সবই মন্দিরের গেটের উল্টোদিকে একটা দোকানে রেখে দিলাম । এই দোকান থেকেই আমাদের পুজোর সামগ্রী কেনা হল । তারপর মন্দিরের গেটের ভেতরে ঢুকে লাইন দেওয়া । মন্দিরের লাইনের একটা বৈশিষ্ট্য হল এখানে পুরো জায়গাটাই লোহার বেড়া দিয়ে চ্যানেল মতো করা আছে, সেখান দিয়েই এগিয়ে যেতে হবে । এইভাবে এগিয়ে যেতে যেতে একজায়গায় দেখলাম একটা বিশাল হলঘরের মতো জায়গায় টাকা গোনা হচ্ছে । বুঝলাম সাইঁবাবার প্রণামী বাক্সে যা জমা পড়ে সেগুলোর হিসেব করা হচ্ছে । আরেকটু এগোতে একটা কাউন্টারের সামনে দিয়ে আমাদের লাইনটা গেল সেখানে একটা ছোটো প্যাকেটে দু’টো করে লাড্ডু বিতরণ করা হচ্ছে (একজনকে একটা প্যাকেটই দেয়, আমি দু’টো পাওয়ার জন্য হাত বাড়াতেই লোকটা আমার দিকে কট্‌মট্‌ করে তাকালো) । সবচেয়ে ভালো ব্যাপার হল পুজো দেব কি দেব না, তার ওপর এই লাড্ডু প্রাপ্তি নির্ভর করে না, এটা এরা সকল দর্শনার্থীদেরই দেয় । একটু এগোতেই দেখলাম একজায়গায় এই লাড্ডু পাকানো হচ্ছে (আহাঃ, দুর্দান্ত ঘিয়ের গন্ধের কথা মনে পড়ে আমার এখনও জিভে জল এসে যাচ্ছে) ।

যাই হোক, এইভাবে এগোতে এগোতে একসময়ে সাঁইবাবার মর্মরনির্মিত মূর্তির সামনে পৌঁছলাম এবং দেখে দর্শন করে বেরিয়েও এলাম । মন্দিরটা সবমিলিয়ে বেশ ভালো – সবচেয়ে বড় কথা হল পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন, মারামারি ঠেলাঠেলি নেই, পান্ডা/পূজারীদের হম্বিতম্বি নেই এবং অবশ্যই বিনামূল্যে দুর্দান্ত লাড্ডু আছে । সবমিলিয়ে দেখতে আমাদের লাগল ঘন্টা দেড়েক আর এখানকার লোকের মতে ফাঁকা থাকার জন্যই এত কম সময়ে হয়ে গেছে !

আমাদের গাড়ি আগেই ঠিক করা ছিল, অটোয় হোটেলে ফিরে এসে যতটা তাড়াতাড়ি সম্ভব রেডী হয়ে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম ঔরঙ্গাবাদের উদ্দেশ্যে । এবারেও দু’টো গাড়ি । কিছুদূর এগিয়ে একজায়গায় রাস্তার ধারে একটা হোটেলে আমরা আলুর পরোটা দিয়ে ব্রেকফাস্ট করে নিলাম । সবমিলিয়ে খরচ পড়ল ৭৫০ টাকা ।

‘সির্ডি ভ্রমণ’ এখানেই শেষ । এরপর আসবে আমাদের ভ্রমণের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ ‘ইলোরা ভ্রমণ’ ।

সারসংক্ষেপঃ

১. সির্ডি জায়গাটা সাঁইবাবার মন্দিরের জন্যই বিখ্যাত । মনে ভক্তি থাকুক বা না থাকুক, মন্দিরটা একবার দেখে আসা যেতেই পারে ।
২. সাঁইবাবার মন্দির ছাড়া সির্ডিতে দেখার আর কিছুই নেই । তাই এখানে কোনও কারণেই একদিনের বেশি থাকার মানে হয় না কারণ জায়গাটা বেশ ঘিঞ্জি, বিশ্রাম নেওয়ার জন্যও এখানে থাকার মানে হয় না ।
৩. সির্ডিতে আমিষ রেস্ট্যুরেন্টের একটু অভাব রয়েছে । খুঁজলে পাওয়া যায় না তা নয়, তবে না খুঁজে পাওয়া কঠিন ।
৪. নিজের জানাশোনা কোনও হোটেলে যদি না থাকে, তাহলে সির্ডিতে গিয়ে ‘অশোকা এক্সিকিউটিভ’এ থাকার জন্য বলব । এই ভাড়ায় এত ভালো হোটেলে পাওয়া সত্যিই সহজ নয় । এদের ওয়েবসাইট http://hotelashokaexecutive.com/ থেকে বুকিং করা যেতে পারে অথবা http://hotel.makemytrip.com/ থেকেও বুকিং করা যেতে পারে ।

(লেখার সঙ্গের ছবি ছাড়া সির্ডিতে আর কোনও ছবি তোলা হয়নি, তাই সির্ডি ভ্রমণের আরও ছবির কোনও লিঙ্ক দেওয়া হল না ।)

ইলোরা ভ্রমণঃ

সির্ডি থেকে ঔরঙ্গাবাদ যাওয়ার পথেই পড়ে ইলোরা । সে’জন্য সির্ডি থেকে যেতে হলে পথেই ইলোরা দেখে ঔরঙ্গাবাদ যাওয়া উচিত কারণ ঔরঙ্গাবাদ থেকে ইলোরা বেশ অনেকটাই দূরে । আমরা যে গাড়িগুলো ঠিক করেছিলাম, সেগুলোর সঙ্গে কথা ছিল তারা আমাদের সির্ডি থেকে ঔরঙ্গাবাদ পৌঁছে দেবে এবং পথে চারটে জায়গা দেখাবে । সেই জায়গাগুলো হল – গৃষ্মেশ্বর মন্দির, ইলোরা গুহা, ভদ্রমূর্তি মন্দির এবং বিবি কা মক্‌বারা । গাড়িওয়ালারা জোর করলেও এদের মধ্যে গৃষ্মেশ্বর মন্দির আর ভদ্রমূর্তি মন্দিরে গিয়ে সময় নষ্ট করার একেবারেই মানে হয় না ।

সির্ডি থেকে প্রায় ৯৫ কিলোমিটার দূরে আর ঔরঙ্গাবাদ থেকে ৩৫ কিলোমিটার দূরে আমাদের প্রথম দেখার জায়গা গৃষ্মেশ্বর মন্দির । এটা একটা অত্যন্ত সাধারণ মন্দির তবে লোকজনের লাইন পড়ে মোটামুটি । এখানে দর্শনের জন্য প্রায় ঘন্টাখানেক সময় লেগে যাবে বলে আমরা সেই উদ্দেশ্য ত্যাগ করলাম । এখানে আসার প্রধান লক্ষ্য হল ইলোরা গুহা দেখা – সেখানে যতটা সম্ভব বেশি সময় কাটানো ।

গৃষ্মেশ্বর মন্দির থেকে ইলোরা গুহা খুবই কাছে । ইলোরাও ভারতীয় পুরাতত্ত্ব বিভাগের তত্বাবধানে এবং ১০ টাকা করে টিকিট । গেটে ঢোকার পর আরও বেশ কিছুটা পাহাড়ের ওপর উঠে প্রথম দেখার জায়গায় পৌঁছনো যায় ।

ইলোরার গুহা
এখানে বলে রাখি ইলোরায় সবমিলিয়ে যা দেখার আছে, তার জন্য এখানে একদিন থাকলে ভালো হয় । ইলোরার গুহার কাছেই মহারাষ্ট্র ট্যুরিজম এর থাকার ব্যবস্থা আছে, চাইলে এখানে থাকা যেতে পারে । আর একটু ভালোভাবে দেখে বোঝার জন্য কিছুটা পড়াশোনা করে নিলে ভালো হয় । তবে বেশি আগ্রহ না পেলে শুধুমাত্র প্রধান প্রধান গুহাগুলো দেখে নেওয়া যেতে পারে । আমাদের ভালোভাবে দেখার ইচ্ছে থাকলেও সময় বেশি ছিল না, তাই প্রধান গুহাগুলো দেখেই ফিরে আসতে হল ।

গাড়ি যেখানে দাঁড় করায় সেখান থেকে কিছুটা পায়ে হেঁটে ওপরে উঠে ৩০ – ৩৪ নম্বর গুহা । আমি ঐতিহাসিক বিস্তারিত তথ্যে যাচ্ছি না, ইন্টারনেটে খুঁজলে এই সম্পর্কে অনেক জানা যায় । তার চেয়ে আমরা কি দেখলাম আর আমাদের কিরকম লাগল, সেগুলো লিখি ।

ইলোরার গুহায় ইন্দ্রের মূর্তি
ইলোরার প্রধান বৈশিষ্ট্য এই গুহাগুলো সম্পূর্ণভাবেই পাহাড় কেটে তৈরি করা । আজ থেকে প্রায় দেড় হাজার বছর আগে আমাদের দেশের শিল্পকীর্তি যে কোন পর্যায়ে পৌঁছেছিল, সেটা আমরা ছোটোবেলায় ইতিহাস বইতে অনেকবার পড়েছি । কিন্তু সেগুলো নিজের চোখে দেখার অভিজ্ঞতাই আলাদা । ডিনামাইট বা কোনওরকম বৈদ্যুতিক সরঞ্জামের সাহায্য ছাড়া শুধুমাত্র ছেনি আর হাতুড়ির সাহায্যে এত নিপুনভাবে পাহাড় কেটে তৈরি এই গুহা এবং সেইসঙ্গে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম মূর্তি এবং কারুকার্যের কথা ভাবতেই অবাক লাগে আর সেগুলো চোখের সামনে দেখলে বিস্ময় জাগে (অবাক হওয়া আর বিস্মিত হওয়ার মধ্যে আভিধানিক কোনও পার্থক্য নেই কিন্তু আমি এখানে বিস্ময় >> অবাক হিসেবে ব্যবহার করছি !) । দেবদেবী মানুষ পশুপাখি গাছপালা কি নেই সেই কারুকার্যের মধ্যে ! তখনকার দিনের মানুষের জীবনযাত্রা, ব্যবহারের সামগ্রী সবকিছুরই নিখুঁত প্রতিরূপ রয়েছে এই কারুকার্যের মধ্যে । এছাড়া রয়েছে গুহার দেওয়ালে আঁকা ছবি । ছবিতে রঙের ব্যবহার বিশেষ প্রশংসার দাবী রাখে । আমরা একজন গাইড নিয়েছিলাম । এরা যে অনেককিছু জানে বা দেখায় তা নয়, কিন্তু কিছু কিছু মূর্তি বা ছবি দেখিয়ে কিছু কিছু গল্প বলে যেগুলো শুনতে ভালো লাগে (মুর্শিদাবাদের মতিঝিলের গাইডের সেই কথাটা আমাকে বেশ নাড়া দিয়েছিল
গুহার দেওয়ালে জীবনযাত্রার ছবি
– “জানলে ইতিহাস আর না জানলে মাটির দেওয়াল”) । আমাদের গাইড আমাদের অনেককিছু দেখালো আর বলে গেল – সবগুলো মনে নেই । তবে দু’টো জিনিসের কথা এখানে উল্লেখ করছি ।







হলঘর
এক, একটা থাম দেখাল যেটায় হাত দিয়ে জোরে মারলে তবলার মতো আওয়াজ বেরোয় ! গাইড আমাদের সেটা বাজিয়ে শোনাল - তারপর আমরা নিজেরাও ব্যাপারটা করে দেখলাম এবং মুগ্ধ হলাম । একটা নিরেট পাথরের থামের মধ্যে থেকে কিকরে এরকম শব্দ বেরোনো সম্ভব সেটা বেশ অদ্ভুত । গাইডও জানে না কারণ এই পুরো জিনিসটা একটা পাহাড় কেটে তৈরি – থামটা না ভেঙ্গে এর ভেতরে কি আছে, কিভাবে তবলার মতো শব্দ তৈরি হচ্ছে জানা সম্ভব নয় ।

দুই, একটা হলঘরের মতো ঘর । গাইড বলল – এটা ছিল উপাসনাগৃহ । ঘরটা বেশ বড়, জায়গায় জায়গায় পাথর কেটে থাক বসানো আছে । এই ঘরের সাউন্ড সিস্টেম হল এখানকার বৈশিষ্ট্য । তখনকার দিনে মাইক বা লাউড স্পীকারের ব্যবস্থা ছিল না, তাই এই ঘরে এমন ব্যবস্থা করা আছে যে ঘরের কেন্দ্রস্থলে বসে না চেঁচিয়ে কথা বললেও ঘরের সবাই সেটা শুনতে পাবে । আমাদের গাইড সেই জায়গাটায় গিয়ে ব্যাপারটা আমাদের করে দেখাল । আমরা আবার মুগ্ধ হলাম ।

এই গুহাগুলো দেখে আমরা আবার গাড়ি করে পাহাড়ের ওপর থেকে নেমে এলাম । এবার আমাদের দ্রষ্টব্য হল ইলোরার অন্যতম প্রধান আকর্ষণ – কৈলাস মন্দির ।

কৈলাস মন্দির
অষ্টম শতকে রাষ্ট্রকূট বংশের রাজত্বকালে তৈরি হয় এই কৈলাস মন্দির । এর প্রধান বৈশিষ্ট্য হল এটা একটা পাথর কেটে তৈরি করা । মন্দিরটা দৈর্ঘ্যে ও প্রস্থে বেশ বড় । আমরা ভেতরে ঢুকে সব জায়গাটা ভালোভাবে ঘুরলাম । প্রধান মন্দিরটা দোতলা – দোতলাতেই মন্দিরের সামনে একটা চাতাল আর তারও সামনে একটা জায়গা যেখান থেকে অনেকটা জায়গা দেখা যায় । মন্দিরটা ঘিরে একটা বেশি বড় চাতাল আছে আর তাকে ঘিরে আবার আরেকদফা বারান্দার মতো । বড় চাতালটায় হাতির মূর্তি, ওবেলিস্ক-এর মতো বিশাল স্তম্ভ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য ।

আমাদের ইলোরার গুহা দেখা শেষ । আগেই বলেছি ইলোরার সবকিছু এত অল্প সময়ে দেখা অসম্ভব তবে এটাও ঠিক আমরা প্রধান জায়গাগুলোর সবই দেখেছি । ঘড়ি বলছে দুপুর সাড়ে তিনটে আর ইলোরা দেখার পরে মনের মধ্যে মুগ্ধতা ছাড়া আর যে অনুভূতিটা কাজ করছে তা হল খিদে – প্রচন্ড খিদে ।

ইলোরার অসুবিধে হল এখানে রেস্ট্যুরেন্ট খুব কম আর যাও বা আছে, সেগুলো আবার নিরামিষ । কিন্তু আর কোনও উপায় না থাকায় ঐ খেয়েই গর্ত বোজানো হল । তবে দু’একটা আইটেম খেতে বেশ ভালো হয়েছিল এটা না বললেই নয় । তবে – আফটার অল্‌ নিরামিষ, তাই কি কি খেলাম সেগুলো আর বিস্তারিত লিখছি না । সবমিলিয়ে খরচ পড়ল ২,১০০ টাকা ।

ভদ্রমূর্তি মন্দির
খাওয়ার পর আমাদের পরবর্তী দ্রষ্টব্য স্থান – ভদ্রমূর্তি মন্দির । ইলোরা থেকে এর দূরত্ব ৫ কিলোমিটারের মতো । এটাও একটা সাধারণ মন্দির – হনুমানের । এখানে হনুমানের একটা শোওয়ানো মূর্তি আছে । আগেই বলেছি এটাও না দেখলে চলবে ।





এরপর আমাদের দিনের শেষ গন্তব্য – বিবি কা মক্‌বারা । ঘড়িতে প্রায় সাড়ে পাঁচটা বাজে আর ড্রাইভার বলল বিবি কা মক্‌বারা ছ’টায় বন্ধ হয়ে যায় তাই এই জায়গাটা আমাদের লিস্ট থেকে বাদ দিতে হল ।

এবার আসি একটা বিশেষ দরকারি ঘটনার ব্যাপারে । ভদ্রমূর্তি মন্দির থেকে বেরিয়ে আমাদের ড্রাইভাররা আমাদের সঙ্গে হঠাৎ খারাপ ব্যবহার করা শুরু করে দিল । আমাদের গাড়ির জন্য মোট দেওয়ার কথা ৬,৮০০ টাকা যার মধ্যে ৫,৫০০ টাকা আমরা ইতিমধ্যেই দিয়ে দিয়েছি । ড্রাইভারদের বক্তব্য হল বাকি টাকাও তাদের তখনই দিতে হবে, নাহলে তারা গাড়ি নিয়ে যাবে না । সেইসঙ্গে এদের আরও দাবী এরা আমাদের হোটেল পর্যন্ত পৌঁছে দেবে না কারণ ঔরঙ্গাবাদ শহরে ঢুকলে এদের নাকি পুলিশকে টাকা দিতে হবে । এই পুলিশকে টাকা দেওয়ার ব্যাপারটা আমরা গাড়ি বুক করার সময়েই শুনেছিলাম এবং সেইজন্য গাড়িপিছু পুলিশভাড়া ২০০ টাকা করে মোট ৪০০ টাকা ধরেই আমাদের ৬,৮০০ টাকা । কিন্তু ড্রাইভাররা কিছুই শুনতে রাজী নয় । ব্যাপারটা এরকম জায়গায় পৌঁছে গেল যে এদের দাবী না মানলে এরা এখান থেকে গাড়ি নিয়ে এগোবেই না । শেষপর্যন্ত ফয়সালা হল কিছু স্থানীয় লোকের মধ্যস্থতায় (যদিও মধ্যস্থতা বলছি কিন্তু আসলে লোকগুলো আমাদের হয়েই কথা বলেছিল) । এরাও গাড়ির ড্রাইভার – অন্য ট্যুরিস্ট নিয়ে এসেছে । এরা আমাদের কথা শুনে বুঝল যে আমরা যা বলছি তার মধ্যে অন্যায় কিছু নেই, তাই এরা সবাইমিলে একরকম জোর করেই আমাদের ড্রাইভারকে আমাদের দাবী মেনে নিতে রাজী করালো । শেষমেশ গাড়ি চলল আর আমরা ঔরঙ্গাবাদের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম । পরে আমাদের ঔরঙ্গাবাদের হোটেলের ম্যানেজারের কাছ থেকে শুনেছিলাম সির্ডির প্রত্যেক গাড়িওয়ালারাই নাকি এরকম । এরা একরকম কথা বলে সির্ডি থেকে বেরোয় আর এখানে এসে আরেক ঝামেলা করে । এদের উদ্দেশ্য থাকে ঔরঙ্গাবাদ থেকে সির্ডি ফেরার পথে যাত্রী নিয়ে যাওয়া আর সেইজন্য বেশিরভাগ সময়েই এরা ইচ্ছে করে ঝামেলা করে যাতে লোকে সব জায়গাগুলো না দেখতে পারে । আমরা পরেরদিন যখন বিবি কা মক্‌বারা দেখতে গেলাম, তখন আমি কাউন্টার থেকে জিজ্ঞেস করে জেনেছিলাম বিবি কা মক্‌বারা আসলে রাত দশটা পর্যন্ত খোলা থাকে ।

ঔরঙ্গাবাদ যাওয়ার পথে রাস্তা থেকে আরেকটা জিনিস দেখতে পেলাম আর সেটা হল দৌলতাবাদ কেল্লা । এটা একটা পাহাড়ের মাথায় এবং এখানে কিছুদূর যাওয়ার পরে আর গাড়ি যায় না – বাকিটা হেঁটে উঠতে হয় । বলা বাহুল্য আমরা এখানে যাইনি, তবে যদি ঔরঙ্গাবাদ বা ইলোরায় একদিন থাকা যায়, তাহলে মহম্মদ-বিন-তুঘলকের আমলে তৈরি এই বিশেষ কেল্লাটা অবশ্যই দেখা উচিৎ (মহম্মদ-বিন-তুঘলক – পাগলা রাজা – দাক্ষিণাত্যে শাসনব্যবস্থা জোরদার করার জন্য রাজধানী দিল্লী থেকে দৌলতাবাদে স্থানান্তরণ – সেখানে দু’বছর থাকার পর ফের দিল্লীতে ফেরৎ আসা – মনে পড়ছে ?) ।

ঔরঙ্গাবাদের তোরণদ্বার
ঔরঙ্গাবাদ শহরের আরেকটা উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হল এর শহরে ঢোকার মুখের তোরণদ্বার । একসময়ে মোট ৫২ টা দ্বার থাকলেও বর্তমানে ছোটবড় মিলিয়ে মাত্র ১৩ টাই অবশিষ্ট আছে । এদের মধ্যে সবচেয়ে বড় আর সবচেয়ে পুরনো হল ‘ভাদকাল দ্বার’ । আসলে দাক্ষিণাত্যে শাসনব্যবস্থা জোরদার করার জন্য ঔরঙ্গজেব যখন এখানে থাকা শুরু করেন তখনই নিরাপত্তার কারণে পুরো ঔরঙ্গাবাদ শহরটাকে পাঁচিল দিয়ে ঘিরে ফেলা হয় । সেই পাঁচিলের মাঝেই এই গেটগুলো । এখন অবশ্য পাঁচিলের খুব সামান্যই অবশিষ্ট আছে ।

আমরা হোটেল প্রীতম-এ পৌঁছলাম তখন তখন সাড়ে ছ’টা । হোটেলটা অসাধারণ কিছু না হলেও মোটের ওপর মন্দ নয় । এখানেও আমাদের মেয়াদ পরেরদিন সকাল পর্যন্ত, তাই রাতটা কাটানো নিয়ে কথা ।

ঔরঙ্গাবাদ মহারাষ্ট্রে হলেও মুম্বই বা উপকূলবর্তী জায়গা থেকে অনেকটাই পুবদিকে, তাই এখানে মুম্বইয়ের মতো অত বেশিক্ষণ আলো থাকে না । মোটামুটি সাতটা থেকে সাড়ে সাতটার মধ্যে সন্ধ্যে হয়ে যায় ।

হোটেল প্রীতমের নিজস্ব খাওয়ার ব্যবস্থা নেই, তবে আশেপাশেই একাধিক খাবারের হোটেল আছে । সেরকমই একটা হোটেল থেকে রুটি, চিকেন, চাউমিন, ফ্রাইড রাইস ইত্যাদি নেওয়া হল । খরচ হল ১,১৮০ টাকা । অবশ্য আমাদের দলের দু’একজন অবশ্য দুপুরে দেরিতে খাওয়া হয়েছে বলে রাতে আর কিছু খেলো না । খাওয়া শেষ করে হোটেলে ফিরলাম তখন সাড়ে দশটা বেজে গেছে । সাড়ে দশটা ঔরঙ্গাবাদের পক্ষে বেশ ভালোই রাত । রাস্তায় লোক চলাচল কমে যায়, গাড়িও খুব বেশি দেখা যায় না, আর দোকানপাটও বন্ধ হয়ে যায় । আমাদের হোটেলের ম্যানেজার বলল – এখানে সকাল তাড়াতাড়ি হয় আর রাত দশটার বেজে গেলে আর বিশেষ কিছু পাওয়া যায় না ।

ঘরে এসে শুয়ে পড়লাম । পরেরদিন আমাদের গন্তব্য অজন্তা – আমাদের মুম্বই ভ্রমণের পঞ্চম তথা শেষ জায়গা । যাওয়ার পথে আমরা বিবি কা মক্‌বারা দেখে যাব ।

৩১শে মে, ২০১৪ শনিবার । সকাল আটটার সময়ে হোটেল থেকে মালপত্র নিয়ে দু’টো গাড়িতে করে আমরা বেরিয়ে পড়লাম । আমরা প্রথমে যাব বিবি কা মক্‌বারা আর তারপর সোজা অজন্তা ।

বিবি কা মক্‌বারা
ঔরঙ্গাবাদ শহর থেকে ৩ কিলোমিটার দূরে ‘বিবি কা মক্‌বারা’ বা মিনি তাজমহল । আগ্রায় মায়ের সমাধি আসল তাজমহল এর আদলে ঔরঙ্গজেব এটা তৈরি করান নিজের পত্নীর সমাধিস্থলে । বিবি কা মক্‌বারা দেখতে একেবারেই তাজমহলের মতো তবে আকারে কিছুটা ছোট । আর তাজমহলের সঙ্গে এর আরেকটা পার্থক্য হল এটা তাজমহলের মতো পুরোপুরি মার্বেল দিয়ে তৈরি নয়, নিচের দিকে কিছুটা মার্বেল দেওয়ার পর ওপরের দিকটা সারা রঙ করা । আর ঠিক সেইজন্যই তাজমহলের মতো এটা জলবায়ুর কারণে দ্রুত ক্ষয়প্রাপ্ত হয় না ।

আমি ব্যক্তিগতভাবে তাজমহলের থেকে বিবি কা মক্‌বারাকে বেশি নম্বর দেব আর সেটা ঐতিহাসিক কারণে । আকবরের তৈরি করা অর্থভান্ডার শাহজাহান প্রায় নিঃশেষ করেছিলেন নিজের বিলাসিতা এবং শিল্পনির্মাণে । আর এই বিপুল অর্থভান্ডারের একটা বড় অংশ ব্যয় হয় তাজমহল তৈরিতে । সেদিক দিয়ে দেখতে গেলে বিবি কা মকবারা যখন ঔরঙ্গজেব তৈরি করান, তখন মুঘল সাম্রাজ্যের অর্থভান্ডার তলানিতে । সেইজন্যই হয়তো বিবি কা মক্‌বারার শুধু নিচের দিকটাই মার্বেল দিয়ে তৈরি । মুঘল সাম্রাজ্যের সেই ভরাডুবির সময়ে তাজমহলের আদলে আরেকটা স্মৃতিসৌধ তৈরি করার চেষ্টা করাটা রীতিমতো দুঃসাহসের পরিচয় !

ঔরঙ্গজেবের পত্নীর সমাধি
বিবি কা মক্‌বারাও ভারতীয় পুরাতত্ত্ব বিভাগ দেখাশোনা করে । এখানে গেটে ৫ টাকার টিকিট কেটে ঢুকতে হয় । জায়গাটা বেশ ফাঁকাই থাকে আর সকালের আলোয় দেখতে খুব সুন্দর লাগে । আমরা চাতালে কিছুক্ষণ বসে ভেতরে ঢুকে ঔরঙ্গজেবের পত্নীর সমাধি দেখে বেরিয়ে এলাম । বিবি কা মক্‌বারা ভালো করে ঘুরে দেখতে আধঘন্টার বেশি লাগে না ।


এরপর আমরা এগিয়ে চললাম অজন্তার দিকে । পথে আমাদের গাড়ি খারাপ হওয়ার জন্য প্রায় দেড় ঘন্টা দেরি হয়ে গেল । তারপর রাস্তায় এক জায়গায় পুরি-সবজী দিয়ে ব্রেকফাস্ট করে নেওয়া হল । এরপর সোজা অজন্তা । সেখানে ঘোরাটা আসবে এই পোস্টের শেষ অংশে ‘অজন্তা ভ্রমণ’ ।

সারসংক্ষেপঃ

১. ঐতিহাসিক স্থাপত্যকীর্তির জন্য ভারতের যে কয়েকটা জায়গা পৃথিবীবিখ্যাত ইলোরা তাদের মধ্যে অন্যতম । ছেনি আর হাতুড়ির সাহায্যে একটা গোটা পাহাড়কে কেটে ফেলে শিল্পের এই নিদর্শন পর্যটকদের বিস্ময়ের বিষয় ।
২. ইলোরার কাছাকাছি বড় শহর ঔরঙ্গাবাদে থেকে ইলোরায় যাওয়া যায় । তাছাড়া ইলোরায় মহারাষ্ট্র ট্যুরিজমের নিজস্ব থাকার ব্যবস্থা রয়েছে ।
৩. ইলোরা ভালোভাবে এবং সম্পূর্ণভাবে দেখতে গেলে একদিন যথেষ্ট নয় । তবে মোটামুটিভাবে প্রধান গুহাগুলো এবং সেইসঙ্গে কৈলাস মন্দির দেখার জন্য হাতে ঘন্টা তিনেক থাকলেই চলবে ।
৪. ইলোরা খোলে সকাল ন’টায় আর বন্ধ হয় বিকেল সাড়ে পাঁচটায় । এছাড়া প্রতি মঙ্গলবার ইলোরা বন্ধ থাকে ।
৫. ইলোরা ছাড়া এখানে কাছাকাছির মধ্যে আরও দু’টো মন্দির রয়েছে । গাড়ির ড্রাইভার হাজার পীড়াপীড়ি করলেও এগুলোর কোনওটাতেই যাওয়ার একেবারেই মানে হয় না ।
৬. ইলোরার কাছে সেরকম কোনও ভালো খাওয়ার জায়গা নেই । দু’তিনটে চলনসই নিরামিষ হোটেল আছে ।
৭. ইলোরা ছাড়া ঔরঙ্গাবাদের অন্যতম দর্শনীয় স্থান বিবি কা মকবারা । আগ্রায় তাজমহলের আদলে তৈরি এই স্মৃতিসৌধটা দেখতে খুবই সুন্দর । ঔরঙ্গাবাদ গেলে এখানে অবশ্যই যাওয়া উচিৎ ।
৮. কাছাকাছির মধ্যে দৌলতাবাদ কেল্লা আছে । পায়ের আর মনের জোর থাকলে পাহাড়ের ওপরে এই কেল্লাটা একবার গিয়ে দেখে আসা যেতেই পারে ।
৯. আমাদের হোটেল প্রীতমের নিজস্ব ওয়েবসাইট http://www.hotelpreetamaurangabad.com/ থেকে এখানে সরাসরি বুকিং করা যায় । এছাড়া http://www.goibibo.com/ থেকেও এখানে বুকিং করা যায় ।
বিশেষ সতর্কীকরণ – সির্ডি থেকে গাড়ি নিয়ে ঔরঙ্গাবাদে এলে ড্রাইভার ঝামেলা করার সম্ভাবনা প্রবল । সেক্ষেত্রে সির্ডি থেকেই গাড়ির সঙ্গে ভালোভাবে কথা বলে নেওয়ার দরকার । আর গন্তব্যস্থানে না পৌঁছে কখনওই ড্রাইভারকে পুরো টাকা দেওয়া চলবে না, যা কথা হয়েছে কমপক্ষে তার ২০ - ২৫% বাকি রাখতেই হবে ।

ইলোরা ভ্রমণের আরও ছবি দেখতে হলে click here.

অজন্তা ভ্রমণঃ

অজন্তা যাওয়ার পথে
ছোটবেলা থেকে অজন্তা-ইলোরা একসঙ্গে শুনে মনে হয় এগুলো বুঝি পাশাপাশি, কিন্তু বাস্তবে তা একেবারেই নয় । ইলোরা বা ঔরঙ্গাবাদ থেকে অজন্তার দূরত্ব প্রায় ১১০ কিলোমিটার আর যেতে তিনঘন্টার মতো লাগে । আগেই বলেছি আমাদের গাড়ি খারাপ হয়ে যাওয়ায় আমরা ঘন্টা দেড়েক দেরিতে চলছিলাম । ফলে শেষ পর্যন্ত যখন অজন্তায় পৌঁছলাম তখন প্রায় দুপুর দু’টো । অজন্তায় আমাদের বুকিং ছিল হোটেল কে পি পার্কে । হোটেলটা বেশ নতুন এবং ছিমছাম আর বেশ ছোটখাটো । আমরা হোটেলে ঢুকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব রেডী হয়ে নিলাম কারণ আজই আমাদের অজন্তা গুহা দেখতে যেতে হবে । কে পি পার্ক একটা নিরামিষ হোটেল এবং এই অঞ্চলেও নাকি আমিষ হোটেল পাওয়া যায় না (ব্যাপার কি ? এরা এত নিরামিষভোজী কেন ?) । স্বাভাবিকভাবেই খাবারের দাম বেশ কম । আমরা নিরামিষ থালি নিলাম আর এর জন্য আমাদের সবমিলিয়ে ৯২০ টাকা খরচ হল ।

অজন্তার গুহা দেখার জন্য টি-জাংশন বলে একটা জায়গা আছে সেটা আমাদের হোটেল থেকে ২ কিলোমিটার মতো দূরে (টি-জাংশনের সঙ্গে চায়ের কোনও সম্পর্ক নেই, জায়গাটা T অক্ষরের মতো দেখতে বলে এই নাম) । বাইরের গাড়ি এই পর্যন্তই যেতে পারে আর এখান থেকে এম টি ডি সি-র বাস ধরতে হয় । আমাদের হোটেল থেকে টি-জাংশন পর্যন্ত ফ্রি ড্রপ আর পিক্‌আপ ছিল, সেই গাড়ি আমাদের যখন টি-জাংশনে নামালো তখন বেলা তিনটে বেজে গেছে ।

এম টি ডি সি-র বাসস্ট্যান্ড
টি-জাংশন থেকে এম টি ডি সি-র বাস প্রতি দশ মিনিট অন্তর ছাড়ে । এসি বাসের ভাড়া মাথাপিছু ২০ টাকা করে । এই বাস আমাদের পাহাড়ি রাস্তা ধরে দশ মিনিট চলার পর এক জায়গায় নামিয়ে দেয় যেখান থেকে পদব্রজে অজন্তা দেখা শুরু হয় । অজন্তাও ভারতীয় পুরাতত্ত্ব বিভাগ দেখাশোনা করে । অজন্তা বন্ধ হয়ে যায় বিকেল সাড়ে পাঁচটায় – তাই আমরা আর সময় নষ্ট না করে মাথাপিছু ১০ টাকার টিকিট কেটে উঠতে শুরু করে দিলাম ।

অজন্তায় ওঠার ঢালু পথ
অজন্তায় হেঁটে ঘোরা ছাড়াও ডুলি পাওয়া যায় যা একটা গুহা থেকে অন্য গুহায় পৌঁছে দেয় । তবে এখানে বলে রাখি অজন্তায় পাহাড়ে ওঠার জন্য প্রথমটাই যা একটু কষ্ট করতে হয়, বেশ অনেকগুলো সিঁড়ি ভাঙতে হয় (অবশ্য সিঁড়ি না ভেঙ্গে ঢালু পথেও ওঠার ব্যবস্থা করা আছে) । কিন্তু একবার এখানে উঠে পড়তে পারলে তারপর বাকিটা সমতল ।


অজন্তার গুহাচিত্র
আমরা একে একে গুহাগুলো দেখা শুরু করলাম । অজন্তাতেও ইলোরার মতোই – পাহাড় কেটে গুহা তৈরি করা । পার্থক্য হল এখানে গুহাগুলোর মধ্যে মূর্তির তুলনায় চিত্রের সংখ্যা বেশি । প্রাচীন বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা নিজেদের থাকার জন্য পাহাড় কেটে এই গুহাগুলো তৈরি করেছিলেন এবং ভেতরের দেওয়ালে নানারকম ছবি এঁকেছিলেন । আবার সেই অবাক আর বিস্ময় – সেযুগের মানুষের ধৈর্য্য, অধ্যাবসায়, নৈপুণ্য, ছেনি আর হাতুড়ি ক্ষমতা দেখে । সেইসঙ্গে রঙের ব্যবহার আরও প্রশংসনীয় । আমরা একের পর এক গুহা দেখে চললাম ।

গুহার ছাদে চিত্র
গুহার ভেতরগুলো দেখার জন্য বাইরে থেকে যা আলো ঢোকে, তাতেই দেখতে হয় । শুধুমাত্র দু’টো গুহার ভেতরে কৃত্রিম আলোর ব্যবস্থা করা আছে । গুহার ভেতরে, যেখানে ছবি আঁকা আছে সেখানে ক্যামেরার ফ্ল্যাশ ব্যবহার করে ছবি তোলা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ যদিও ফ্ল্যাশ ব্যবহার না করে ছবি তোলা যেতেই পারে । আসলে ফ্ল্যাশের জোরালো আলো ছবিকে নষ্ট করে দেয় । বেশ কিছু কিছু জায়গার ছবি ইতিমধ্যেই নষ্ট হয়ে গেছে, বাকিটাকে বাঁচিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করা হচ্ছে । এখানে অনেক সিকিউরিটি গার্ড আছে যারা সারাক্ষণ এটা বলতে থাকে যে ফ্ল্যাশ ব্যবহার না করতে । এবং সেটা যথেষ্ট ভালোভাবেই বলে । এবং আমার নিজেরও মনে হয় নিজেদের দেশের এই অত্যাশ্চর্য্য সম্পদকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য এটা না করা আমাদের সবারই দায়িত্বের মধ্যে পড়ে ।

অজন্তার গুহা
প্রায় সবক’টা গুহার ভেতরেই বুদ্ধদেবের মূর্তি আছে আর সেইসঙ্গে আরও নানারকম মূর্তি আছে যেগুলো সম্পর্কে বিস্তারিত লিখছি না । রাস্তাটা মোটামুটি সমতল হলেও মাঝে মাঝে কোনও কোনও গুহায় যেতে গেলে কিছু সিঁড়ি ভাঙতে হয় । এখানে কিছুদূর অন্তর অন্তর শীতল পানীয় জলের ব্যবস্থা আছে । আমরা যেসময়ে গেছি তখন মোটামুটি তাপমাত্রা চল্লিশ ডিগ্রির কাছাকাছি, তাই সেখানে এই জলটা একটা আশীর্ব্বাদের মতো মনে হচ্ছিল ।

অজন্তার মডেল
গুহাগুলোর মধ্য কোনও একটা গুহায় অজন্তার একটা ছোট মডেল রাখা রয়েছে । এটা অবশ্য এ’যুগের মানুষের সৃষ্টি । এটা ভালোভাবে দেখে নিলে আমরা নিজেরা কোথায় আছি, কোথায় কোথায় কিভাবে যাওয়া যেতে পারে এগুলো সম্পর্কে একটা ধারণা তৈরি করা যায় ।





মহাপরিনির্বাণ
বাকিগুহাগুলো দেখে আমরা শেষ গেলাম ২৬ নম্বর গুহায় । এটায় হল সর্বশেষ গুহা এবং এই গুহাটার সম্পর্কে একটু লেখা দরকার । এটা বাকিগুলোর থেকে একটু আলাদা এবং বৌদ্ধ স্থাপত্যকীর্তির মধ্যে বিশেষ ব্যতিক্রমী । সাধারণতঃ বৌদ্ধ গুহার মধ্যে স্তূপ অথবা মূর্তি দেখা যায় । এই গুহার ভেতরে একটা স্তূপ আছে যেটা আবার একটা বেশ বড় মূর্তিও । এরকম কীর্তি বৌদ্ধস্থাপত্যে বিরল । এছাড়া এই গুহার ভেতরে আছে বুদ্ধের মহাপরিনির্বাণ – যেটা এই গুহার মূল আকর্ষণ । দেওয়ালে একটা ১০ – ১২ ফুট দীর্ঘ শোওয়ানো বুদ্ধিমূর্তি খোদাই করা আছে । বুদ্ধদেবের মুখে একটা স্মিত হাসি । এত বড় শোওয়ানো বুদ্ধমূর্তি আর কোথাও নেই ।

এরপরে আর এগোনো যায় না । গুহা দেখা ছাড়াও অজন্তায় পাহাড়ের ওপর ওঠা যায় কিন্তু বর্তমানে বন্ধ আছে । তাছাড়া আমাদের হাতে আর সময়ও ছিল না । তবে সেই নিয়ে আমাদের কোনও আক্ষেপ নেই কারণ এখানকার মূল জিনিসগুলো আমাদের দেখা হয়ে গেছে ।

বাইরে বেরিয়ে এখানে একটা এম টি ডি সি-র রেস্ট্যুরেন্ট আছে, সেখান থেকে আমের জুস খাওয়া হল । এটা খেতে খুবই ভালো, সম্পূর্ণভাবে আম থেকে শাঁস বের করে তার সঙ্গে জল বরফ মিশিয়ে তৈরি করা – কোনও ভেজাল নেই । খেয়ে প্রাণ জুড়িয়ে গেল । তবে বেরোনো আগে যখন ১২৯০ টাকার একটা বিল মেটাতে হল তখন বুকে একটা ছোটোখাটো ধাক্কা লাগল । হ্যাঁ, আমের সরবতের একেকটা গ্লাসের দাম ৭০ টাকা করে !

অজন্তা
আবার ফেরার পথে বাস ধরলাম – সেই বাস আমাদের টি-জাংশনে নামিয়ে দিল । ফেরার সময়ে এসি বাস নয়, তাই ভাড়া ১৫ টাকা করে । টি-জাংশনে একটা বাজার আছে, সেখানে হার চুড়ি থেকে শুরু করে ঘর সাজানোর জিনিস সবই পাওয়া যায় । ঠিকমতো দরদাম করতে পারলে এখানে ঠিকঠাক দামে জিনিস পাওয়া যেতে পারে ।



টি-জাংশনে আমাদের জন্য গাড়ি অপেক্ষা করছিল । সেই গাড়ি ধরে আবার হোটেলে ফিরে এলাম তখন প্রায় সাতটা ।

অজন্তা ভ্রমণ বলত গেলে এখানেই শেষ – এবার মহারাষ্ট্র ভ্রমণের শেষ অংশ ।

সন্ধ্যেবেলা ঘরে বসে সবাই মিলে আড্ডা দিলাম । আজই শেষ দিন – আগামীকাল এই সময়ে আমরা থাকব ট্রেনে আর পরশু এই সময়ে যে যার বাড়িতে । গত সাতদিনের অভিজ্ঞতা, সুখ-দুঃখ, চাওয়া-পাওয়া, কিছু পাওয়া – কিছু না পাওয়া এইসব নিয়ে গল্প হচ্ছিল । হোটেল কে পি পার্ক এমনিতে নিরামিষ তবে আমরা অনেক লোক থাকায় বলল – চিকেনের ব্যবস্থা করে দেবে । রাতে রুটি দিয়ে সেই চিকেন খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়লাম ।

১লা জুন ২০১৪, রবিবার । আমাদের ফেরার ট্রেন ধরার দিন । আমাদের সকালবেলাই বেরিয়ে পড়তে হবে । অজন্তা থেকে আমাদের যেতে হবে জলগাঁও – সেখান থেকে আমাদের ফেরার ট্রেন গীতাঞ্জলি এক্সপ্রেস দুপুর ১২ টায় । সকালে লুচি সবজী দিয়ে ব্রেকফাস্ট করে একেবারে বেরোনোর জন্য রেডী হয়ে নিলাম । আমাদের গাড়ি বলা ছিল সকাল সাড়ে ন’টায় । এখানে একটা সমস্যা হয়েছিল, স্টেশন যাওয়ার জন্য হোটেল থেকে গাড়ি না নেওয়ায় হোটেলের লোকেরা কিছুটা অসন্তুষ্ট হয়েছিল । না নেওয়ার কারণ খুব স্পষ্ট – আমরা আরও কম টাকায় গাড়ি পেয়ে গেছিলাম । কিন্তু এখানে এদের লবির ব্যাপার থাকে – এরা চাইলে এমন কিছু করতে পারে যাতে আমাদের গাড়ি আমাদের স্টেশনে না নিয়ে যেতে পারে এবং নিজেদের গাড়ি নেওয়ার জন্য আমাদের বাধ্য করতে পারে । দশটার সময়েও যখন গাড়ি এসে পৌঁছল না, তখন একটু চিন্তাই হচ্ছিল । যদিও অজন্তা থেকে জলগাঁও যেতে একঘন্টা লাগে, কিন্তু এখানে ঝামেলা হলে আমরা মুস্কিলে পড়ব । যাই হোক, সোয়া দশটার একটু পরে দু’টো গাড়ি এসে পৌঁছল আর আমরা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব গাড়িতে উঠে এলাকা ত্যাগ করলাম ।

জলগাঁও স্টেশনে পৌঁছলাম তখন বেলা এগারোটা । দু’টো গাড়ি মিলিয়ে আমাদের পড়ল ৩,২০০ টাকা । এরপর স্টেশনে পৌঁছে আমরা কাম-সাম থেকে দুপুরের খাবার নিয়ে নিলাম । তারপর নির্ধারিত সময়ের আধঘন্টা পরে ট্রেন এলে উঠে পড়লাম ।

ফেরার পথের বিবরণ দেওয়ার আর কিছু নেই তবে যেটা বলার সেটা হল গীতাঞ্জলি এক্সপ্রেসে ফেরার জঘন্য অভিজ্ঞতার কথা । আমরা জলগাঁও থেকে সবক’টা এসি-র টিকিট পাইনি, অনেকগুলোই স্লীপারে নিতে হয়েছিল । গীতঞ্জলি এক্সপ্রেসে স্লীপারে পুরো কামরা জুড়ে প্রচুর লোক বসে থাকে যাদের টিকিট হয় কনফার্মড হয়নি অথবা তাদের কাছে জেনারেলের টিকিট আছে । এই ভীড়টা এতই বেশি যে কামরার ভেতরে চলাচল করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে । নাগপুরের টি.টি.ই.কে এটা বলা হলেও স্বাভাবিকভাবেই তিনি কোনও ব্যবস্থা নিলেন না । পরেরদিন টাটানগর পর্যন্ত্য আমাদের এই ভীড়ের অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছিল ।

রাতের খাবার আমরা নাগপুর স্টেশনের কাম-সাম থেকে নিলাম । সেগুলো খেয়েদেয়ে রাতে শুয়ে পড়লাম । কিছুক্ষণের মধ্যেই লোয়ার বাঙ্কদু’টোর মাঝের মেঝেটায় দু’জন লোক এসে শুয়ে পড়ল ।

গীতাঞ্জলি এক্সপ্রেস হাওড়ায় পৌঁছল তখন বেলা একটা । সবাই সবাইকে টাটা বলে যে যার বাড়ির পথ ধরলাম !

সারসংক্ষেপঃ

১. ভারতের শ্রেষ্ঠ স্থাপত্যকীর্তিগুলোর মধ্যে অজন্তা ইলোরার মতোই আরেকটা বিশেষ উল্লেখযোগ্য নাম । এখানকার গুহার বৈশিষ্ঠ হল এগুলোর ভেতরে মূর্তির থেকে ছবির প্রাধান্যই বেশি ।
২. অজন্তা দেখতেও ইলোরার মতোই সারাদিন লাগে, তবে এখানকার সুবিধেটা হল সবটাই প্রায় একই জায়গায় । খুব ভালোভাবে খুঁটিয়ে না দেখলে গুহাগুলো দেখার জন্য হাতে ঘন্টা তিনেক সময় থাকলেই চলবে ।
৩. যেসব গুহার ভেতরে ছবি আছে, সেখানে ফ্ল্যাশ ব্যবহার করে ছবি তোলা একেবারেই উচিৎ নয় । এতে ছবিগুলোর মারাত্মক ক্ষতি হয় ।
৪. অজন্তার গুহা খোলে সকাল ন'টা থেকে । প্রতি সোমবার অজন্তা বন্ধ থাকে ।
৫ অজন্তার গুহা পর্যন্ত্য গাড়ি নিয়ে যাওয়া যায় না, টি-জাংশন থেকে এম টি ডি সি-র বাস ধরতে হয় । এই টি-জাংশন অজন্তার গুহার সবথেকে কাছে এবং এখানেই এম টি ডি সি-র রিসর্টটা রয়েছে ।
৬. আমাদের হোটেল কে পি পার্কটা এই টি-জাংশন থেকে দু’তিন কিলোমিটার মতো দূরে । অজন্তায় খুব বেশি হোটেল নেই, সেই হিসেবে এই হোটেলটা মোটের ওপর মন্দ নয় । এদের ওয়েবসাইট http://www.newkppark.com/ থেকে সরাসরি বুকিংও করা যেতে পারে ।
৭. অজন্তার নিকটবর্তী রেলওয়ে স্টেশন জলগাঁও যেতে অজন্তা থেকে ঘন্টাখানেক লাগে । মুম্বই যাতায়াতের প্রায় সব ট্রেনই এখানে দাঁড়ায় ।

অজন্তা ভ্রমণের আরও ছবি দেখতে হলে click here.

উপসংহারঃ

আমাদের মহারাষ্ট্র ভ্রমণের সময়টা পুরোপুরিই গরমের সময়ে – সেইজন্য অনেকেই বলেছিল যে ভালোভাবে ঘুরতে পারব না । আমাদের গরম লেগেছে এটা অস্বীকার করব না তবে সেটা কখনওই ঘোরার অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়নি – এটা জোর দিয়ে বলতে পারি । মহারাষ্ট্রের বিভিন্ন জায়গায় কলকাতার মতই গরম, তবে শুকনো গরম হওয়ায় সেরকম ঘাম হয়না । আর সেই কারণেই গায়ে গরম লাগলেও শরীরে ক্লান্তি লাগে না । আমাদের এই সাতদিন ব্যাপী ভ্রমণে আমরা ঘুরেছি – মুম্বই, গণপতিপুলে, সির্ডি, ইলোরা ও অজন্তা । আমাদের এই ভ্রমণসূচীর মধ্যে আরেকটা জায়গা চাইলে ঢোকানো যেতে পারত – সেটা হল মহাবালেশ্বর । জায়গাটা সেরকম দারুণ কিছু নয়, এটা প্রকৃতপক্ষে মহারাষ্ট্রের একটা হিল স্টেশন । বলা বাহুল্য, এই জায়গাগুলো ছাড়া মহারাষ্ট্রে অনেক জায়গা আছে, তবে আমাদের ঘোরা এই জায়গাগুলো পারলে একবারেই ঘুরে আসা ভালো । পুরো ঘোরাঘুরিটা কিছুটা হলেও অস্থির, কিন্তু সবমিলিয়ে খুবই আনন্দদায়ক । সাতদিনের ঘোরাঘুরি নিয়ে আমাদের মাথাপিছু খরচ হয়েছে ১৩,০০০ টাকার মতো, যেটা এই ঘোরাঘুরিটার পক্ষে বেশ সস্তাই । কোনও বিশেষ জায়গা সম্পর্কে আলাদা করে এখানে লিখছি না – সেগুলো লেখার মধ্যেই আছে । প্রত্যেকটা জায়গা তাদের নিজের মাহাত্ম্যের জন্য সুন্দর – স্বতন্ত্র – বিশিষ্ট । যদি বেরিয়ে পড়ার জন্য এই পুঁজি আর সেইসঙ্গে ছুটি - দু’টো জিনিস একসঙ্গে হাতে থাকে তাহলে মহারাষ্ট্রের এই জায়গাগুলো ভ্রমণের জন্য বেরিয়ে পড়া যেতেই পারে ।