আমি ব্লগ লেখার খুব বেশি সমর্থক কোনওদিনও ছিলাম না, সত্যি কথা বলতে কি এখনও যে আছি তা নয় । তার একটা প্রধান কারণ আমার ধারণা ব্লগ লেখার থেকেও পড়া অনেক বেশি ক্লান্তিকর । অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, অনেক সময়ই পড়তে শুরু করে শেষ করা হয়ে ওঠে না । নিজের ধৈর্য এবং/অথবা আগ্রহের অভাবকে 'ঠিক আছে, বাকিটা পরে পড়ব' জাতীয় অজুহাত দিয়ে ঢেকে দিই - আর আমরা সবাই জানি সেই 'পরে' টা আর কখনওই আসে না । তো, এই কারণে আমি ঠিক করেছি আমার ব্লগকে কখনওই অন্যের ক্লান্তির কারণ ঘটাব না, আমার ব্লগের বিষয় হবে প্রধানতঃ ভ্রমণ । আমার মতো যেসব বাঙালিরা ঘুরতে ভালোবাসে, তাদের জন্য আমার ব্লগ হবে তথ্যের একটা উৎস । আমার নিজের একটা অভ্যেস আছে, কোনও জায়গায় বেড়াতে যাওয়ার আগে সেই জায়গাটা সম্পর্কে কিছুটা জেনে নেওয়ার চেষ্টা করি, আর ইন্টারনেট ঘাঁটতে গিয়ে আমার বরাবরই মনে হয়েছে যে ইন্টারনেটে লেখালেখি করার ব্যাপারে বাঙালিদের থেকে কুঁড়ে খুব কম শিক্ষিত জাতই আছে । আমার মতো যেসব বাঙালিরা আছে, যারা ইন্টারনেটে কোনো একটা ইংরিজীতে লেখা দেখলেই না পড়ার চেষ্টা করে, তাদের জন্য আমার ব্লগ সহায়ক হবে, এই বিশ্বাস নিয়ে শুরু করছি আমার ভ্রমণকাহিনী । আগেই বলে রাখি, আমি স্ট্যাটিসটিক্সের ছাত্র ছিলাম, তাই আমার ব্লগে তত্ত্বের থেকে তথ্যের দেখাই মিলবে বেশি ।

Sunday, February 16, 2014

কলকাতা ভ্রমণ : পর্ব - ১ (চিড়িয়াখানা)

লকাতা ভ্রমণ ! শুনেই পড়েই একটু অবাক লাগছে কি ? লাগারই কথা । আমি কলকাতার ছেলে - বলতে গেলে প্রায় সারা বছর কলকাতাতেই থাকি, সেখানে আবার ভ্রমণ কি ? আসলে আমার এই প্রিয় শহরটাতেও ভ্রমণের বা দেখার জায়গা অনেকগুলো আছে, কিন্তু এর অনেকগুলোই আমাদের দেখা হয়ে ওঠে নি / ওঠে না । ঘোরার জন্য - দেখার জন্য আমরা শহরের বাইরে, রাজ্যের বাইরে, দেশের বাইরে, মহাদেশের বাইরে এমনকি পৃথিবীর বাইরেও যাই কিন্তু "দেখা হয় নাই ... শিশিরবিন্দু !" সেইজন্য ঠিক করেছি এবার কলকাতা ভ্রমণ নিয়ে লেখা শুরু করব ।

কলকাতা ভ্রমণ একবারে লেখা সম্ভব নয় । তার প্রধানতঃ দু'টো কারণ - ১) কলকাতায় এত দেখা জায়গা আছে যার সব একবারে দেখে ফেলে লিখে ফেলা দীর্ঘ সময়সাপেক্ষ আর ২) যা দেখার জায়গা আছে সেগুলো একবারে দেখা সম্ভবও নয় । তাই যখন যেরকম দেখা হবে, সেইমতো কলকাতা ভ্রমণ সম্পর্কে লেখা চলতে থাকবে ।

কলকাতার চিড়িয়াখানা প্রায় সব্বাই ছোটবেলায় একবার করে যায় আর বহু লোকের ক্ষেত্রে দেখেছি বড় হয়ে আর কিছুতেই যাওয়া হয়ে ওঠে না । আমি নিজেও ছোটবেলায় বছর ৪ - ৫ বয়সে একবার গেছিলাম আর বড় হওয়ার পর বহুবার চেষ্টা করেও যাওয়া হয়ে ওঠেনি । অবশেষে একটা পুচকেকে নিয়ে যাওয়ার জন্যই আমার বড় বয়সে চিড়িয়াখানা যাওয়াটা হয়ে গেল - তিনি হলেন আমার বড় শ্যালিকার দু'বছরের ছেলে শ্রীমান আত্মদীপ চট্টোপাধ্যায় । দলে আমি আর সে ছাড়াও আমার স্ত্রী আর তার বাবা-মা ।

১৬ই ফ্রেব্রুয়ারী, ২০১৪ রবিবার । দিনটা কিছুটা দুর্যোগপূর্ণ হওয়ায় আমরা আলিপুর পৌঁছলাম তখন দুপুর পৌনে একটা । গাড়ি পার্কিং এর জায়গাটা চিড়িয়াখানা থেকে মিনিট পাঁচেকের হাঁটা পথ - এখানে সারাদিনের জন্য গাড়ি রাখতে ১৫০ টাকা নিল (মরশুমের সময়ে সেটা নাকি ২৫০ - ৩০০ তেও পৌঁছে যায় !) । চিড়িয়াখানার একেবারে কাছে সেরকম কোনও ভালো খাবার দোকান নেই, মেইন গেটের উল্টোদিকে একটা সাধারণ ভাতের হোটেল আছে ।

চিড়িয়াখানায় ঢোকার আগে এর উল্টোদিকে 'অ্যাকোরিয়াম' দেখে নেওয়া যেতে পারে । প্রবেশমূল্য মাথাপিছু ৫ টাকা আর দু'বছরের নিচে টিকিট লাগে না । অ্যাকোরিয়ামে যথারীতি নানা প্রজাতির নানা রঙের নানা আকৃতির নানা দেশের মাছ রয়েছে । অ্যাকোরিয়ামটা বেশ বড় এবং ভেতরে ছবি তোলা নিষিদ্ধ । এদের মধ্যে রাক্ষুসে মাছ 'পিরান্‌হা'কেও দেখতে পেলাম ।

এবার রাস্তা পেরিয়ে মূল চিড়িয়াখানায় প্রবেশ । এখানে প্রবেশমূল্য ২০ টাকা আর দু'বছর পর্যন্ত ফ্রি । ক্যামেরার জন্য কোনও টিকিট লাগে না (এটা আমার বেশ ভালো লাগল কারণ ইদানিংকালে দার্জিলিঙ, নন্দনকানন বা শিলং-এ যে'কটা চিড়িয়াখানা দেখেছি, প্রত্যেকটাতেই ক্যামেরার জন্য আলাদা টিকিট লেগেছে) । চিড়িয়াখানার সময়সীমা সকাল ন'টা থেকে বিকেল পাঁচটা । প্রতি বৃহস্পতিবার চিড়িয়াখানা বন্ধ থাকে তবে কোনও বৃহস্পতিবার কোনও সরকারী ছুটির দিন পড়ে গেলে সেদিন খোলা থাকে ।

ভেতরে ঢুকেই প্রথমে একটা ম্যাপ দেওয়া আছে, সেখানে বিভিন্ন জন্তু এবং নিজেদের অবস্থান দেখে নেওয়া যেতে পারে । আমাদের খুব কাছেই রয়েছে বাঘ - তাই আমরা সেদিকেই এগোলাম । যাওয়ার পথে কিছু কাকাতুয়া, ম্যাকাও ইত্যাদি দেখে নেওয়া গেল ।

রানি
এরপর 'রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার' । একটা পরিখাঘেরা বেশ বড় জায়গায় এনাকে রাখা হয়েছে এবং আমরা যতক্ষণ ছিলাম তিনি পুরো জায়গাটা পায়চারি করলেন । আমরা রাজসকাষে বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে 'রানি'কে (এটাই বাঘের নাম) দেখলাম আর অনেক ছবি তুললাম ।



পাখিদের খাঁচা
এরপর আরও কিছু পাখির খাঁচা ছিল, সেখানে কয়েকজনকে দেখা গেল । আরও কিছুটা এগিয়ে ময়ূরের খাঁচায় ময়ূরকে দেখা গেল কিছু তার পেখম দেখা গেল না (যথারীতি কিছু লোক খাঁচার সামনে দাঁড়িয়ে ময়ূরকে পেখম তোলার জন্য বিশুদ্ধ বাংলায় অনুরোধ করছিল, কিন্তু কেন জানিনা ময়ূর কিছুতেই তাদের কথা শুনছিল না !) ।


জিরাফের ঘর
চিড়িয়াখানার ভেতরে কিছু জলাশয় আছে আর সেগুলো পেরোনোর জন্য ছোট ছোট ব্রীজও করা আছে । সেরকম একটা ব্রীজ পেরিয়ে আমাদের সামনে পড়ল জিরাফের খাঁচা । তখন বৃষ্টি বেশ জোরে পড়ছে - বেচারা জিরাফরা তাদের দর্শনার্থীদের দর্শনার্থে কিছুতেই বাইরে বেরোতে চাইল না । আমরা ঘরের ভেতরে তাদের যতদূর দেখা যায়, দেখলাম । একটা বাচ্চা জিরাফ বারবার বেরিয়ে আসছিল আর একটা বড় জিরাফ তাকে ধরে আবার ভেতরে ঢুকিয়ে দিচ্ছিল । দেখে মনে হল :
মা : বাবু, আবার বৃষ্টির মধ্যে ভিজছ ?
বাবু : একটু যাই না !
মা  : না সোনা, বৃষ্টিতে ভিজলে ঠান্ডা লেগে যাবে । কাল আকাশ পরিষ্কার থাকলে অনেক লোক আসবে, তাদের সামনে ঘোরাঘুরি করতে হবে না ? এখন একদম ভিজবে না !

হাতিদের বাড়ি
জিরাফের পরে কিছু চিতাবাঘ, প্যান্থার ইত্যাদিদের দেখা গেল । তারপর আমরা গেলাম হাতির কাছে । তিনটে বড় আর একটা বাচ্চা হাতিকে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম । বোধহয় বৃষ্টির জন্যই হাতিরও সেরকম হাঁটাচলা দেখা গেল না ।





হাতির পরে যেটা উল্লেখযোগ্য সেটা হল সিংহ । সিংহকেও বাঘের মতো একটা পরিখাঘেরা খোলা জায়গায় রাখা হয়েছে আর পশুরাজকে আমরা দেখলাম ওনার ঘরের সামনে শুয়ে বিশ্রাম করছেন । মাঝে একবার ঘাড়টা তুলে আমাদের একটু তাচ্ছিল্যমিশ্রিত দর্শন দিলেন, তারপর আবার শুয়ে পড়লেন ।

আমরা আরও এগিয়ে চললাম । শুরুতে বৃষ্টিটা ঝিরঝির করে হলেও এখন ঝমঝম করে হচ্ছে । এরপর আমরা দেখতে পেলাম জলহস্তিকে । তার পুরো শরীরটাই জলের নিচে - শুধু পিঠের ওপরের কিছুটা ওপরে । একবার মাথাটা সামান্য তুলল, আবার যেই-কে-সেই ।

খাঁচার ভেতরে সাদা বাঘ
আরও এগিয়ে আরেকটা বাঘের খাঁচা - তবে এবার আর কোনও খোলা জায়গা নয়, একেবারে ঢাকা খাঁচা । সেখানেও বাঘকে পায়চারি করতে দেখা গেল আর এবার একেবারে খাঁচার সামনের দিক ঘেঁষে । অর্থাৎ দর্শকের সঙ্গে তার দূরত্ব হাত দু'য়েকের বেশি নয় । বাঘের পাশের সাদা বাঘ । একেও দেখলাম খাঁচার ভেতরে পায়চারি করতে ।


শীতকালে চিড়িয়াখানায় সরীসৃপের ঘর বন্ধ থাকে, আমরা আর ওদিকে গেলাম না । তার বদলে বাঁদরের খাঁচার সামনে দিয়ে এলাম আর সামনেই জলের মধ্যে কুমীরকে দেখলাম ।

আমাদের চিড়িয়াখানা দেখা শেষ - বৃষ্টিও সেইসঙ্গে সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে গেছে, তাই এবার আমরা ফেরার পথ ধরলাম ।

উপসংহারঃ

কলকাতা চিড়িয়াখানা
কলকাতার চিড়িয়াখানা সম্পর্কে প্রথম যে কথাটা উল্লেখ করতেই হবে সেটা হল আমাদের ভুল ধারণার কথা । কেন জানি না, বহু লোক মনে করে আলিপুর চিড়িয়াখানায় কোনও রক্ষণাবেক্ষণ হয় না । হয়তো একসময়ে সত্যিই হতো না, কিন্তু এখন হয় এবং স্বীকার করতেই হয় বেশ ভালোভাবেই হয় । একটা ভালো জিনিস লক্ষ্য করলাম সেটা হল প্রত্যেকটা জন্তুর দায়িত্ব একজন/কোনো সংস্থা নিয়েছেন । তিনি/তাঁরা ১৮ই সেপ্টেম্বর ২০১৩ - ১৭ই সেপ্টেম্বর ২০১৪ পর্যন্ত এই দায়িত্ব নিয়েছেন । আন্দাজ করলাম প্রত্যেক বছর এই দায়িত্ব নতুন করে বিন্যাস করা হয় । এছাড়া আলিপুর চিড়িয়াখানা যথেষ্ট পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন । ভেতরে কিছু স্ন্যাক্স খাওয়ার ব্যবস্থাও আছে । সবমিলিয়ে যথেষ্ট চিত্তাকর্ষক । আমি এখানে আমাদের দেখা প্রধান জন্তু বা পাখিদের কথাই উল্লেখ করেছি, কিছু ছোটখাটো জিনিস আর বিস্তারিত উল্লেখ করিনি । কাজেই আমার লেখা পড়ে যদি মনে হয় "এ আর কি এমন, এই ক'টা জিনিস দেখতে যাওয়ার কোনও মানে হয় না" তাহলে ভুল হবে । আমার মতে ইদানীংকালে না গিয়ে থাকলে কলকাতা চিড়িয়াখানায় একবার যাওয়া যেতেই পারে !

কলকাতা চিড়িয়াখানার নিজস্ব ওয়েবসাইট http://www.kolkatazoo.in/ থেকে এখানকার সম্পর্কে আরও তথ্য জানা যেতে পারে ।