আমি ব্লগ লেখার খুব বেশি সমর্থক কোনওদিনও ছিলাম না, সত্যি কথা বলতে কি এখনও যে আছি তা নয় । তার একটা প্রধান কারণ আমার ধারণা ব্লগ লেখার থেকেও পড়া অনেক বেশি ক্লান্তিকর । অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, অনেক সময়ই পড়তে শুরু করে শেষ করা হয়ে ওঠে না । নিজের ধৈর্য এবং/অথবা আগ্রহের অভাবকে 'ঠিক আছে, বাকিটা পরে পড়ব' জাতীয় অজুহাত দিয়ে ঢেকে দিই - আর আমরা সবাই জানি সেই 'পরে' টা আর কখনওই আসে না । তো, এই কারণে আমি ঠিক করেছি আমার ব্লগকে কখনওই অন্যের ক্লান্তির কারণ ঘটাব না, আমার ব্লগের বিষয় হবে প্রধানতঃ ভ্রমণ । আমার মতো যেসব বাঙালিরা ঘুরতে ভালোবাসে, তাদের জন্য আমার ব্লগ হবে তথ্যের একটা উৎস । আমার নিজের একটা অভ্যেস আছে, কোনও জায়গায় বেড়াতে যাওয়ার আগে সেই জায়গাটা সম্পর্কে কিছুটা জেনে নেওয়ার চেষ্টা করি, আর ইন্টারনেট ঘাঁটতে গিয়ে আমার বরাবরই মনে হয়েছে যে ইন্টারনেটে লেখালেখি করার ব্যাপারে বাঙালিদের থেকে কুঁড়ে খুব কম শিক্ষিত জাতই আছে । আমার মতো যেসব বাঙালিরা আছে, যারা ইন্টারনেটে কোনো একটা ইংরিজীতে লেখা দেখলেই না পড়ার চেষ্টা করে, তাদের জন্য আমার ব্লগ সহায়ক হবে, এই বিশ্বাস নিয়ে শুরু করছি আমার ভ্রমণকাহিনী । আগেই বলে রাখি, আমি স্ট্যাটিসটিক্সের ছাত্র ছিলাম, তাই আমার ব্লগে তত্ত্বের থেকে তথ্যের দেখাই মিলবে বেশি ।

Sunday, April 27, 2014

তাজপুর ভ্রমণ

০১২ সালে চাঁদিপুর ভ্রমণের দু'বছর পরে অফিস থেকে আমরা এবারে তাজপুর বেড়াতে গেলাম । এবারের দলে একজন শিশুসহ মোট ২৪ জন যার মধ্যে ১৮ জন অফিসের আর বাকিরা তাদের পরিবার । যদিও বেশিরভাগ লোকই জানে, তাও বলছি তাজপুর পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে দীঘার কাছে আরেকটা বীচ্‌ । দীঘা বা মন্দারমণির মতো ঘিঞ্জি নয় - তাজপুর বেশ ফাঁকা ফাঁকা একটা জায়গা । সেই তাজপুর ভ্রমণ নিয়েই আমার ব্লগের এবারের নাতিদীর্ঘ পোস্ট ।

রামনগর স্টেশনে সবাই
২৬শে এপ্রিল, ২০১৪ শনিবার সকাল ৬:৪০ এ হাওড়া স্টেশন থেকে তাম্রলিপ্ত এক্সপ্রেসে আমাদের যাওয়া । ট্রেনে না গিয়ে গাড়ি নিয়েও যাওয়া যেতে পারে, তবে তাতে খরচ কিছুটা বাড়বে । তাজপুর যাওয়ার জন্য রামনগর স্টেশনে নামতে হয় - সেখান থেকে মোটর ভ্যানে বা গাড়িতে তাজপুর । তাম্রলিপ্ত এক্সপ্রেস রামনগর পৌঁছয় সকাল ৯:৪৪ এ । আমাদের ট্রেন মিনিট দশেক লেট ছিল ।

রামনগর স্টেশন থেকে আমরা তাজপুর যাওয়ার জন্য গাড়ি ভাড়া করলাম । আগেই বলেছি মোটর ভ্যানের ব্যবস্থা আছে তবে এপ্রিলের প্রবল গরমে বেলা ১০ টার সময়ে মাথাখোলা ভ্যানে যাওয়ার বাড়াবাড়িটা বোধহয় না করাই ভালো । আমরা তিনটে মারুতি ওম্‌নি নিলাম । প্রতি গাড়ির ভাড়া ৩৫০ টাকা (এখানে একটা সিন্ডিকেটের চার্ট টাঙানো আছে, চাইলেও এদের বেশি দেওয়ার কোনও মানে হয় না) । রামনগর থেকে তাজপুর যেতে প্রায় আধঘন্টা লাগে ।

তাজপুর রিট্রিটে আমাদের কটেজ
তাজপুরে আমাদের বুকিং ছিল 'তাজপুর রিট্রিটে' । এখানে বলে রাখি তাজপুরে সমুদ্রের ধারে কিন্তু কোনও হোটেল বা থাকার জায়গা নেই, কাজেই কোনও হোটেলওয়ালা বা তাদের প্রতিনিধিরা (মানে দালাল আর কি !) যদি সেটা দাবী করে তাহলে বুঝতে হবে তারা প্রতারক এবং তাদের বিরুদ্ধে সরব হতে হবে । তাজপুর রিট্রিটে নন্‌ এসি ডাব্‌ল্‌ বেডের ভাড়া ১,০০০ টাকা, এসি ডাব্‌ল্‌ বেড ১,৫০০ টাকা । তবে আমরা মাথাপিছু ১,২০০ টাকা হিসেবে প্যাকেজ সিস্টেম নিয়েছিলাম । প্যাকেজে থাকছে - পরেরদিন বিকেল ৫টা পর্যন্ত থাকা, প্রথমদিনের লাঞ্চ, বিকেলের চা ও স্ন্যাক্স, ডিনার, পরেরদিন সকালে চা ও ব্রেকফাস্ট আর দুপুরের লাঞ্চ ।

তাজপুরের সমুদ্র
সাধারণতঃ সকালে এইরকম সময়ে সমুদ্রের কাছে পৌঁছলে চান করাটা অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠে, আমরাও তাই কিছুক্ষণের মধ্যেই তৈরি হয়ে গেলাম সমুদ্রের দিকে । তাজপুরের গাড়ি চলাচলের প্রধান রাস্তাটা পেরিয়ে একটা ঝাউবনের ভেতর দিয়ে ৫ মিনিট হাঁটলেই সমুদ্র । তাজপুরের সমুদ্র সম্পর্কে একটা কথা প্রায়ই শোনা যায় যে এখানে সমুদ্র নাকি একেবারে ডোবা ! কথাটা যে একেবারেই সত্যি নয়, আশা করি আমাদের তোলা ছবিগুলো তার যথেষ্ট প্রমাণ বহন করবে । বেলা সাড়ে এগারোটা বাজে - প্রায় ভাঁটার সময়ে, কিন্তু তাও সমুদ্রে চান করে বেশ ভালো লাগল । ঘন্টাখানেক জলে লাফালাফি করে জল থেকে উঠে ডাব খেয়ে (মানে ডাবের জল খেয়ে - না, শাঁস ছিল না) হোটেলে ফিরে এলাম । তাজপুরের বীচ্‌ আরও একটা কারণে বিশেষ উল্লেখযোগ্য, সেটার কথা যথাসময়ে বলব ।

কটেজের ভিতর
হোটেলে ফিরে আরেকদফা চান । তাজপুর রিট্রিটের ঘরগুলো বেশ বড় আর প্রত্যেকটা ঘরেই এসির ব্যবস্থা করা আছে । ঘরে একটা বাথরুম কাম্‌ টয়লেট আর একটা শুধু টয়লেট । ঘরগুলো কটেজ টাইপ আর বাইরে বেশ গরম বেশ বেশি হলেও ঘরের ভেতরটা বেশ আরামদায়ক । তবে এইপ্রসঙ্গে বলে রাখি তাজপুরে কিন্তু কলকাতার থেকে কম গরম লাগছিল । গাছপালা ঘেরা জায়গা বলেই হোক বা সমুদ্রের ধার বলেই হোক, কলকাতার হাঁসাফাঁসানি থেকে তাজপুরে গিয়ে কিছুটা মুক্তিই পেলাম ।

দুপুরে ভাত, ডাল, পোস্ত, আলুভাজা আর পারশে মাছের ঝাল । কটেজগুলোর বাইরে একটা খাওয়ার জায়গা আছে - সেখানেই সবাই মিলে বসে খেলাম । তারপর দুপুরে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে বিকেলে আবার সমুদ্রের ধারে গেলাম ।

সমুদ্রের ওপর সূর্য্যাস্ত
বিকেলের জোয়ারের সময় । আমরা গেছি কৃষ্ণপক্ষের দ্বাদশীতে, জোয়ারের জোর স্বাভাবিকভাবেই বেশি । বিকেলে চান করার ব্যাপার নেই, বালির ওপর চটি খুলে রেখে প্যান্ট/পাজামা/সালোয়ার গুটিয়ে পা ভেজানো আর কিছুক্ষণ অন্তর পিছিয়ে গিয়ে চটিজোড়াকে আরও কিছুটা পিছনে রেখে আসা । বিকেলে গরম একেবারেই লাগছিল না, বেশ আরামদায়ক আবহাওয়া আরও অনেকক্ষণ ঘোরাঘুরি করে আমরা সমুদ্রের ওপর সন্ধ্যে নামা দেখলাম ।

এরপর আবার হোটেলে ফিরে এসে চা আর পকোড়া খাওয়া হল । তাজপুরে সমুদ্র ছাড়া দেখার আর কিচ্ছুই নেই, আর আমাদের মতো যাদের সমুদ্রের জল ছাড়া আর কোনও 'জলের' অভ্যেস নেই, তাদের জন্য সন্ধ্যের পর সমুদ্রই ভালো অপ্‌শন্‌ । হোটেলের লোকের কথা শুনে এবারে আমরা পাঁচজন (আমি, আমার স্ত্রী অমৃতা, আমার কলিগ্‌ কঙ্কনাদি, অমিতদা আর ওদের একবছরের মেয়ে অন্নিকা) আর ঝাউবনের মধ্যে দিয়ে না গিয়ে এবার মোহনার দিকে গেলাম । তাজপুরের গাড়ি চলার প্রধান রাস্তাটা ধরে মিনিট কুড়ি হাঁটলেই মোহনায় পৌঁছনো যায় ।

রাত্রিবেলা মোহনাটা খুবই মনোরম । এই মোহনারই অন্য পাড়ে মন্দারমনি । আমরা জলের কাছে গিয়ে বালির ওপর বসলাম । জায়গাটা মোটামুটি অন্ধকার - দূরে কয়েকটা টালির/খড়ের চালের ছোট দোকান রয়েছে সেখানে টিমটিম করে আলো জ্বলছে । এই দোকানগুলোয় খুব সামান্য টুকিটাকি জিনিস আর ডাব পাওয়া যায় । আমরা ঘন্টাখানেক বসে ডাব খেয়ে (মানে ডাবের জল খেয়ে - হ্যাঁ, এবারে মোটা শাঁস ছিল) ফেরার পথ ধরলাম ।

হোটেলে ফিরতে দশটা বেজে গেল । তারপর ডিনার করলাম । ডিনারে ফ্রায়েড রাইস আর চিলি চিকেন ।

তাজপুরের সূর্য্যোদয়
পরেরদিন ২৭শে এপ্রিল, ২০১৪ রবিবার । সমুদ্রের ধারে বেড়াতে গেলে সানরাইজ দেখতে যাওয়ার একটা ব্যাপার থাকেই, আমি সেইমতো ভোর পাঁচটার সময়ে বেরোলাম । আমাদের দলের আরও অনেকে বেরোলো । তাজপুর এমনিতেই ফাঁকা, আমরা ছাড়া আর খুব কম লোকই এসেছে আর সকালের বীচে গিয়ে দেখা গেল আমরাই শুধু এসেছি । যাই হোক, বীচে পৌঁছে দেখলাম সূর্য্যোদয় তখনো হয়নি আর দেখার কোনও সম্ভাবনাও নেই কারণ আকাশ মেঘে ঢাকা । কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর সূর্য্যের দেখা পাওয়া গেল ঠিকই, তবে ততক্ষণে উনি মেঘের আড়াল দিয়ে অনেকটা উঠে পড়েছেন ।

তাজপুরের লাল কাঁকড়া
এবার সেই বিশেষ জিনিসটার উল্লেখ করি । তাজপুরের বীচে পৌঁছে দেখা যায় বালির ওপর বহুদূর পর্যন্ত ছড়িয়ে আছে - লাল কাঁকড়া । সংখ্যায় অগুনতি । কাছে গেলেই টুপটুপ করে গর্তের মধ্যে ঢুকে যায় । যতই পা টিপে টিপে সন্তর্পণে যাওয়া হোক না কেন, ওরা ঠিক পায়ের কম্পন বুঝতে পারে । এই লালকাঁকড়া তাজপুরের একটা বিশেষত্ব । এরা আকারে খুব বড় নয় - এদের প্রধান বৈশিষ্ট্য হল এদের গায়ের রঙ । আমার মতো মানসিকতা যাদের তাদের জন্য খারাপ খবর - এগুলো মানুষের খাদ্য নয় !

আরও কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করে হোটেলে ফিরে এলাম । তাজপুর রিট্রিটের বাগানে দোলনা টাঙানো আছে, সেখানে সকালে বসে থাকতে দিব্যি লাগছিল । কিছুক্ষণ পরে আলুর পরোটা আর আচার দিয়ে ব্রেকফাস্ট করলাম ।

এরপর আবার সমুদ্রে চান । দ্বিতীয়দিন প্রথমদিনের থেকে আগে জলে নামা হয়েছে, তাই জোয়ারের জোরটা বেশি । চান কর আগেরদিনের থেকেও বেশি ভাল লাগল । প্রায় দু'আড়াইঘন্টা চান করে হোটেলে ফিরে এলাম ।

বাকিটা গতানুগতিক । হোটেলে ফিরে চান, তারপর দুপুরে পোনা মাছের ঝাল দিয়ে ভাত । তারপর কিছুক্ষণ বিশ্রাম করে বিকেলে বেরোলাম তখন সোয়া পাঁচটা । আবার তিনটে গাড়িতে ২৩ + ১ জন । রামনগর স্টেশনে এসে সন্ধ্যে ৬:২৯ এ কান্ডারি এক্সপ্রেসে উঠলাম । কান্ডারির হাওড়ায় পৌঁছনোর কথা রাত ৯:৫০ এ - পৌঁছল সাড়ে দশটার পরে । তাজপুর ভ্রমণ শেষ ।

সারসংক্ষেপঃ

১. কলকাতার কাছে একদিনের ঘুরে আসার জন্য যে জায়গাগুলো আছে, তাদের মধ্যে তাজপুর বিশেষ উল্লেখযোগ্য । ফাঁকা বীচ্‌, ফাঁকা জায়গা যাদের আকর্ষণ করে তাদের জন্যই তাজপুর ।
২. হাওড়া থেকে দীঘাগামী যেকোনও ট্রেনে রামনগরে নেমে গাড়িতে বা মোটর ভ্যানে তাজপুর যাওয়া যেতে পারে । এছাড়া নিজেদের গাড়িতে করে গেলে কাঁথি-দীঘা রোডে বালিসাই থেকে বাঁদিকে ঘুরে তাজপুর যেতে হবে ।
৩. তাজপুরে হোটেলের সংখ্যা বেশি নয়, আর এখানে খুব বেশি লোক যায় না । তাই পীক্‌ সিজ্‌ন্‌ ছাড়া অন্য সময়ে আগে থেকে হোটেল বুকিং না করে গেলেও চলবে ।
৪. আমরা ছিলাম তাজপুর রিট্রিটে । এদের ওয়েবসাইট http://www.tajpurhotel.com/ । এছাড়া এদের সঙ্গে যোগাযোগের নম্বর - 9830271064.
৫. তাজপুর রিট্রিটে মোট আটটা ডাবল্‌ বেড রুম আছে, সেখানে এরা আমাদের ১৯ জনের ব্যবস্থা করেছিল । বাকিচারজনের জন্য যে দু'টো ঘর দিয়েছিল সেগুলো অন্য হোটেলের এবং সেটা এদের কম্পাউন্ডের বাইরে । তাই যদি বড় দলে যাওয়ার পরিকল্পনা থাকে তাহলে বিশেষতঃ এই বিষয়ে হোটেল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে নেওয়াই ভালো ।
৬. তাজপুরের সমুদ্র চান করার পক্ষে বেশ উপযোগী । সমুদ্রে যথেষ্ট ঢেউ আছে এবং বীচে যথেষ্ট লোক নেই, তাই একা বেশিদূরে না যাওয়াই শ্রেয় ।
৭. তাজপুরের বীচে একটা বিশেষ উল্লেখযোগ্য জিনিস হল অসংখ্য লালকাঁকড়া । যাদের এই জিনিস দেখার বিশেষ অভিজ্ঞতা নেই, তাদের এই দৃশ্য মুগ্ধ করবে বলেই মনে হয় ।

উপসংহারঃ

তাজপুর !
কলকাতা থেকে সপ্তাহান্তের ছুটি উপভোগ করার জন্য তাজপুর বেশ ভালো একটা জায়গা । এখানে থাকার জন্য একদিনই যথেষ্ট - তার বেশি থাকলে একঘেয়ে লাগার সম্ভাবনা । লোকসমাগম কম, নিরিবিলি, দোকানপাট বিহীন, প্রায় নির্জন এই জায়গা বিশ্রাম নেওয়ার পক্ষে একেবারে আদর্শ । সকালে সমুদ্রে চান, ডাব খাওয়া (মানে ডাবের জল খাওয়া - শাঁস পেলে খাওয়া যেতে পারে) আর বিকেলে সমুদ্রের তীরে ঘুরে বেড়ানো - এই নিয়েই তাজপুর । এখানে সমুদ্র ছাড়া দেখার আর কিছুই নেই । তাই ঘুরতে গিয়ে বেশি ঘোরাঘুরি না করে শরীর আর মনের ক্লান্তি দূর করা যাদের উদ্দেশ্য, তাজপুর তাদের জন্যই । আমি তাজপুর ২০০৯ সালেও গেছি, এবারে গিয়েও আমার সেই অনুভূতিটাই হল যেটা আমার বক্‌খালি-তেও হয়েছিল । তাই বক্‌খালি ভ্রমণের সেই কথাগুলো দিয়েই শেষ করছি - দীঘা পুরী মন্দারমণির মতো ঘ্যাম নয়, অল্প হোটেল-দোকান, সমুদ্রের লাল কাঁকড়া আর শান্ত নিরিবিলি পরিবেশ নিয়ে তাজপুর থাকুক তাজপুরেই !

তাজপুরের আরও ছবি দেখতে হলে click here.

Tuesday, April 15, 2014

সাতকোশিয়া ভ্রমণ

মার ধারণা আমার ব্লগে যেসব জায়গায় ভ্রমণ সম্পর্কে পোস্ট করেছি, তাদের মধ্যে সাতকোশিয়ার নাম সবচেয়ে কম লোক শুনেছে । আমি নিজেও জায়গাটার নাম জেনেছি যাওয়ার মাসতিনেক আগে - 'সানন্দা' থেকে (এটা শুনে "এবাবা, তুই/তুমি/আপনি সানন্দা পড়িস/পড়ো/পড়েন !" বলে হ্যাটা করার কোনও কারণ নেই, কারণ আমি নিয়মিত পড়ি না, মাঝে মাঝে ওখানকার 'বেড়ানো' বিভাগটা ওল্টাই) । সাতকোশিয়া জায়গাটা উড়িষ্যায় । মহানদীর প্রবাহপথের এই সাত ক্রোশ বা চোদ্দ মাইল পথের এলাকাকে বলা হয় 'সাতকোশিয়া' । পুরো জায়গাটাই পাহাড়ে ঘেরা বলে একে বলা হয় 'সাতকোশিয়া গর্জ' ।

১২ই এপ্রিল, ২০১৪ - শনিবার রাত ৮:৫৫ য় হাওড়া থেকে সম্বলপুর এক্সপ্রেসে আমাদের যাত্রা শুরু । আমাদের এবারের দল ছ'জনের - সেই ছ'জন যারা দার্জিলিঙ গিয়েছিলাম অর্থাৎ আমি, আমার স্ত্রী অমৃতা, নন্দিনীদি, দীপঙ্করদা আর ওদের যমজ ছেলে সায়ক ও সৌনক । সাতকোশিয়া যাওয়ার জন্য অঙ্গুলে নামতে হয় আর হাওড়া থেকে অঙ্গুল যাওয়ার একটিই ট্রেন আছে, সম্বলপুর এক্সপ্রেস যা আবার সাপ্তাহিক - শুক্রবার ওদিক থেকে এদিকে আর শনিবার এদিক থেকে ওদিকে । কাজেই যদি শনিবার ছাড়া অন্য কোনওদিন বেরোনোর পরিকল্পনা থাকে তাহলে হাওড়া থেকে কটক গিয়ে সেখান থেকে বাসে বা গাড়িতে অঙ্গুল যেতে হবে ।

সম্বলপুর এক্সপ্রেস অঙ্গুল পৌঁছয় ভোর পাঁচটায় এবং আমাদের ক্ষেত্রে একেবারেই লেট করল না । আমরা যখন অঙ্গুলে নামলাম তখন চারদিক ফর্সা হয়ে গেলেও সূর্য্য ওঠেনি । এখানে একটা কথা বলে রাখি সাতকোশিয়া কিন্তু কোনও বিশেষ জায়গা নয়, এটা একটা বড় এলাকা । সাতকোশিয়া প্রধানতঃ পাহাড় এবং জঙ্গলপ্রধান একটা জায়গা আর পুরোটাই উড়িষ্যা বনদপ্তরের এলাকা । এখানে থাকার জায়গাগুলো হল - টিকরপাড়া, পুরুনাকোটে, ছোটকেই, লবঙ্গী প্রভৃতি । এই সব জায়গাতেই থাকার জন্য উড়িষ্যা বনদপ্তরের কাছে বুকিং করতে হয় যার অফিস অঙ্গুলে । আমাদের প্রায় দু'মাস আগে থেকে অগ্রিমবুকিং করা ছিল ।

অঙ্গুল থেকে আমাদের গাড়ি ঠিক করা ছিল । সাতকোশিয়া ভ্রমণের জন্য নিজস্ব গাড়ি থাকা বিশেষ প্রয়োজনীয়, না হলে ঘোরাঘুরি করা সহজ হবে না । আমাদের প্রথম গন্তব্য টিকরপাড়া - সেখানে আমরা একদিন থাকব । অঙ্গুল থেকে টিকরপাড়ার দূরত্ব ৪০ কিলোমিটারের মতো । টিকরপাড়া একটা ছোট্ট গ্রাম, দোকানপাটও প্রায় নেই বললেই চলে । আমাদের ড্রাইভার বলল - যেতে ঘন্টাখানেক লাগবে এবং ওখানে গিয়ে ব্রেকফাস্ট পাওয়া যাবে না, কাজেই আমাদের যাওয়ার পথে ব্রেকফাস্ট সেরে নেওয়াই ভালো । সেইমতো একটা পাঞ্জাবি ধাবা থেকে আমরা পরোটা আর পনীরবাটার মশালা দিয়ে ব্রেকফাস্ট করলাম । এটা যে আমাদের পক্ষে কতটা ভালো হল সেটা বুঝলাম আরও মিনিট পনেরো চলার পরে । বড় রাস্তা ছেড়ে আমাদের গাড়ি যখন দু'দিকে পাহাড় আর জঙ্গল ঘেরা সম্পূর্ণ জনবসতিবিহীন রাস্তা দিয়ে এগিয়ে চলল তখন বুঝলাম এখানে ব্রেকফাস্ট পাওয়ার থেকে নিজেরা বন্যজন্তুদের হাতে ব্রেকফাস্ট হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি !

আরও কিছুক্ষণ চলার পরে পড়ল 'পম্পাসার চেক পয়েন্ট' । এখানে বুকিং এর কাগজ দেখালে এরা ভেতরে যাওয়ার অনুমতিপত্র দেয় । মাথাপিছু ২০ টাকা এবং গাড়ির জন্য ৫ টাকা (প্রতিদিন) হিসেবে এখানে প্রবেশমূল্য দিতে হয় (বাঃ, জন্তুজানোয়ার দেখতে গেলে প্রবেশমূল্য দিতে হবে না ?) । পম্পাসার থেকে টিকরপাড়া যেতে আরও আধঘন্টা লাগল - আমরা পৌঁছলাম সাড়ে আটটার সময়ে ।

টিকরপাড়ায় পৌঁছে আমরা কিছুটা সমস্যায় পড়লাম ।  টিকরপাড়ায় থাকার জায়গা নেচার ক্যাম্পের টেন্ট - পৌঁছে দেখলাম তার গেট বন্ধ আর আশেপাশে কাউকে দেখা যাচ্ছে না । সেইসঙ্গে আমাদের কারুর মোবাইলও কাজ করছে না । অর্থাৎ আমাদের বুকিং-এর কাগজপত্রে দেওয়া ফোন নম্বরে যোগাযোগ করার কোনও উপায় নেই । কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর একজনের দেখা পাওয়া গেল, সেই হল এখানকার কেয়ারটেকার । তার কাছ থেকে জানলাম অঙ্গুলের অফিস থেকে আমাদের আসার খবর তাকে পাঠানো হয়নি । এটা নাকি সিজ্‌ন নয়, ওর কাজের ছেলেরাও এখন প্রায় কেউই নেই কাজেই আমাদের থাকার মতো কোনও বন্দোবস্তই করা নেই । অগত্যা আমাদের একটু অপেক্ষা করতে হবে ।

টিকরপাড়া নেচার ক্যাম্প
আমরা বসে রইলাম । জায়গাটায় টেন্ট ছাড়াও গাছের ছায়ায় ছোট ছোট বসার জায়গা আছে আর একটা খড়ের চাল দেওয়া খাওয়ার জায়গা আছে । জায়গাটা মহানদীর একেবারে ধারে, বসে বসে প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখতে ভালোই লাগছিল । এপ্রিলের মাঝামাঝি সময় - প্রচন্ড গরম হওয়া উচিৎ কিন্তু জায়গাটা গাছপালা ঘেরা হওয়ায় আর আগেরদিন রাতে বৃষ্টি হওয়ায় গরম তো লাগছিলই না, বরং কিছুটা ঠান্ডার দিকেই । ইতিমধ্যে আরেকটা ট্যুরিস্ট দল এসে হাজির হয়েছে - বলা বাহুল্য বাঙালি দল । এদেরও আমাদের মতোই অবস্থা অর্থাৎ এদের আসার খবরও কেয়ারটেকারের কাছে পৌঁছয়নি । সাড়ে দশটার কিছু আগে আমাদের টেন্ট রেডি হল ।

আমরা নিয়েছিলাম ডিলাক্স টেন্ট যার ভাড়া ২,০০০ টাকা (খাওয়াসুদ্ধ) । টেন্টগুলো বেশ সুন্দর, ভেতরে একটা খাট, দু'টো চেয়ার আর একটা টেবিল আছে । প্রত্যেকটা টেন্টের পেছনে বাইরে একটা বাথরুম । প্রত্যেকটা টেন্টের চারপাশে বাঁশের বেড়া দেওয়া আছে যদিও তার মানে এই নয় যে একটা থেকে অন্যটায় যেতে গেলে খুব বেগ পেতে হবে ।

(এখানে না বলে পারছি না যে টিকরপাড়ার মানুষের জীবনযাত্রা খুব বাঁশের ওপর নির্ভরশীল । আমাদের নেচার ক্যাম্পে গাছের গা থেকে ঝোলানো একটা দোলনা আছে যেটা দড়ির বদলে বাঁশ দিয়ে আটকানো । এরা জামাকাপড় শুকোতে দেওয়ার সময়েও দড়ির বদলে বাঁশের ওপর টাঙায় । কাজেই এখানে বেড়াতে গেলে 'বাঁশ হইতে সাবধান' !)

মহানদী - কুমীর প্রকল্পে যাওয়ার পথে
টেন্টের ভেতরে কোনও পাখার ব্যবস্থা নেই, সাধারণতঃ কোনও টেন্টেই থাকে না । গরমকালে এইসব জায়গায় কেউ যায়ও না কাজেই পাখার ব্যবস্থা করার দরকার পড়ে না । যত বেলা বাড়তে লাগল তত তাপমাত্রাও বাড়তে থাকল আর আমরা অনুভব করলাম টেন্টের ভেতরে থাকা যাচ্ছে না । তবে তাতে সমস্যা নেই কারণ টেন্টের সামনে নদীর ধারে গাছের তলায় বেঞ্চির ওপর বসে/শুয়ে থাকতে ভালোই লাগছিল ।

কুমীর প্রকল্পে ঘড়িয়াল
একটু পরে আমরা গেলাম কাছেই 'কুমীর প্রকল্প' দেখতে । যদিও আমরা গাড়ি নিয়ে গেলাম তবে এই পথটুকু হেঁটেই যাওয়া যায় । একেবারে নদীর ধার দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে যেতে হয় এই জায়গায় । দেখার মধ্যে কিছু কুমীর আর ঘড়িয়াল আছে । তাছাড়া আছে একটা কচ্ছপ । এই জায়গাটাও গাছপালায় ঘেরা - ফুরফুরে হাওয়ায় ঘুরঘুর করতে বেশ লাগে ।

মহানদীতে চান
ফিরে এসে আমরা গেলাম মহানদীতে চান করতে । মহানদীতে প্রচুর কুমীর আর ঘড়িয়াল আছে (ভয় দেখানোর জন্য বাড়িয়ে বলছি না) কাজেই চান করা বিপজ্জনক । বিভিন্ন জায়গায় সাইনবোর্ডে লেখাও আছে জলে না নামার কথা । যদিও এদের স্থানীয় লোকেরা নদীতে চান করে, কাপড় কাচে কিন্তু এরাও নদীর ধারেই থাকে, বেশিদূর এগোয় না । তাই চান করতে ইচ্ছে হলে আরও লোকজন যেখানে আছে, সেরকম জায়গায় যাওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ । আমরা কিছুক্ষণ চানটান করে ফিরে এলাম (Performed by experts. Do not try this) ।

দুপুরে ভাত-ডাল-আলুভাজা-তরকারি আর চিকেন । রান্না এককথায় বেশ বাজে । কেয়ারটেকার নিজেই রান্না করেছে - আমাদেরও আর কোনও উপায় নেই, তাই ঐ খাবারই খেতে হল । দুপুরে টেন্টের ভেতরটা অগ্নিকুন্ড হয়ে আছে, তাই বাইরেই বসে রইলাম ।

টিকরপাড়ায় ঝড়ের তান্ডব
বিকেল হতে দেখা গেল আকাশটা ক্রমশঃ কালো হয়ে আসছে । চারটের একটু পরে আকাশ একেবারে কালো হয়ে প্রচন্ড ঝড় শুরু হল । এই ঝড়ে টেন্টে থাকা নিরাপদ নয়, তাই আমরা সবাই মিলে খড়ের চালে ঢাকা খাওয়া জায়গাটায় আশ্রয় নিলাম । সেখান থেকে দেখলাম মহানদী আর সাতকোশিয়া গর্জে ঝড় আর বৃষ্টির তান্ডব । প্রচন্ড ঝড় আর সেইসঙ্গে বৃষ্টি - চারদিক একেবারে সাদা হয়ে গেছে । আমাদের টেন্টের ক্যানভাসগুলো অসহায়ের মতো এদিকওদিক ঝাপটাচ্ছে । খাওয়ার জায়গাটার শুধু মাথাটাই ঢাকা - চারপাশটা খোলা । সেখান দিয়ে অনবরত বৃষ্টির ছাট গায়ে লাগছিল । আমরা কোনওমতে বৃষ্টি বাঁচিয়ে (খুব যে বাঁচানোর চেষ্টা করছিলাম এমন নয়, দুপুরের ওই গরমের পর বৃষ্টিটা ভালোই লাগছিল) দাঁড়িয়ে রইলাম । আমাদের মাথার ওপরে খড়ের চালের কিছুটা উড়ে গিয়ে সেখান দিয়ে জল পড়তে লাগল । সবমিলিয়ে যাকে বলে বেশ থ্রিলিং ব্যাপার !

সূর্য্যাস্তের ঠিক আগে
বৃষ্টি থামল ঘন্টাখানেক পরে । আমি আমাদের নেচার ক্যাম্প থেকে নদীর একেবারে ধারে চলে গেলাম । প্রচন্ড জোরে হাওয়া সেখানে তখনও অল্প অল্প বৃষ্টির আমেজ অনুভব করছিলাম । অত ঝড়ের পর নদীর জলের অস্থিরতা তখনও কমেনি । সেখানে দাঁড়িয়ে দেখলাম দু'টো পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে সূর্য্য অস্ত চলে গেল । পরিবেশটার মধ্যে একটা ভীষণ ভালোলাগা কাজ করছিল যা শুধু অনুভবই করা যায়, ব্যাখ্যা করা যায় না ।

রাতের আলোয় টিকরপাড়া নেচার ক্যাম্প
সন্ধ্যেবেলা আর কিছু করার নেই । গরম একেবারেই লাগছিল না, চাঁদের আলোয় টেন্টের বাইরে বসে বসে সবাই মিলে আড্ডা দিলাম । দুপুরে চিকেনের শোচনীয় অবস্থা দেখে নন্দিনীদি আগেই বলে রেখেছিলেন যে রাতের চিকেনটা উনি রান্না করবেন । এতে কেয়ারটেকার খুশিই হল কারণ রান্নাটা ওর নিজের সামর্থ্যের মধ্যের জিনিস নয় । রাতে নন্দিনীদির রান্না করা চিকেন দিয়ে (অসাধারণ হয়েছিল, নন্দিনীদি !) রুটি খেয়ে শুয়ে পড়লাম ।

মহানদীতে নৌভ্রমণ
পরেরদিন সকালে উঠে চা খেয়ে রেডি হয়ে নিলাম । আগে থেকেই পরিকল্পনা ছিল আমরা মহানদীতে নৌভ্রমণে বেরোব । দলে আমরা ছ'জন ছাড়াও আরও সাতজন (যারা গতকাল এখানে এসেছিল) । নৌকো বলতে আসলে একটা ডিঙিই বলা চলে । নদীর ধার দিয়ে মাঝে মাঝে দাঁড় বেয়ে মাঝে মাঝে লগি ঠেলে আমাদের নৌকা চলল । অভিজ্ঞতাটা আমার কাছে নতুন না হলেও অনেকদিন পরে - কাজেই বেশ মজা লাগছিল । যেতে যেতে মাঝে দূর থেকে জলের মধ্যে একটা কুমীর দেখা গেল (বলা বাহুল্য তাতে দলের সবার মধ্যেই বেশ চাঞ্চল্য দেখা গেল - লোকজন ছবিটবিও তুলল) ।

পাথরে ঢাকা নৌ-হল্ট্‌
প্রায় ঘন্টাখানেক চলার পর নৌকো একজায়গায় ভিড়ল । জায়গাটা পাথর দিয়ে ঢাকা - ছোটো ছোটো পাথরের স্তুপ । আমরা সেখানে কিছু ঘোরাঘুরি করে আবার ফেরার পথ ধরলাম । ফেরার সময়ে নৌকো কিছুটা মাঝখান দিয়ে ফিরল আর স্রোতের অনুকূলে হওয়ার দরুণ ফিরতে কম সময় লাগল । নৌকোর ভাড়া নিল ৮০০ টাকা ।



এরপর আমরা লুচি তরকারি দিয়ে ব্রেকফাস্ট করে বেরিয়ে পড়লাম । আমাদের পরের গন্তব্য পুরুনাকোটে ।

পুরুনাকোটের কটেজের ঘর
যে রাস্তা দিয়ে আমরা কাল টিকরপাড়া গেছিলাম, পুরুনাকোটে যেতে গেলে সেই রাস্তা দিয়েই কিছুটা ফিরে আসতে হয় । টিকরপাড়া থেকে পুরুনাকোটের দুরত্ব ১০ - ১৫ কিলোমিটারের মতো । পুরুনাকোটে টিকরপাড়ার মতো রিমোট নয়, এখানে কিছু দোকান টোকান আছে । এখানে উড়িষ্যা বনদপ্তরের 'ফরেস্ট রেস্ট হাউস' আছে - পুরুনাকোটের থাকার জায়গাটাও সেখানেই । এখানে পৌঁছেও আমরা একই সমস্যার সম্মুখিন হলাম - অঙ্গুল থেকে এখানে কোনও খবর আসেনি । পুরুনাকোটের থাকার জায়গাটা কটেজ, সেখানে আবার বিদ্যুতের সমস্যা । এখানে মাত্র দু'টোই ঘর আছে - সেগুলো পরিষ্কার হতে কিছুক্ষণ সময় লাগল । পুরুনাকোটের ঘরভাড়া ১,০০০ টাকা করে আর সেটা খাওয়াসুদ্ধ নয় । এখানে প্রতি দু'জনের জন্য ৫০০ টাকা করে খাবার নেওয়া যেতে পারে । আমরা সেরকম ব্যবস্থাই করলাম ।

দুপুরে ডিমের ডালনা দিয়ে ভাত খেয়ে আমরা গাড়ি নিয়ে ঘুরতে বেরোলাম । এখান থেকে পম্পাসার চেক পয়েন্টের দিকে আরও কিছুটা এগোলে লবঙ্গীর দিকে যাওয়া যায় । আমাদের কেয়ারটেকার বলল - লবঙ্গীর ওয়াচ্‌ টাওয়ার থেকে কিছু জন্তু জানোয়ারের দেখা মিলতে পারে ।

লবঙ্গী যাওয়ার পথ
সেইমতো আমরা লবঙ্গীর উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম । এই যাওয়ার পথটাই বিশেষ উল্লেখযোগ্য । দু'দিকের জঙ্গলের মধ্যের কাঁচা রাস্তার মধ্যে দিয়ে উঁচুনিচু পথে আমাদের গাড়ি এগিয়ে চলল । মাঝে একজায়গায় আমরা গাড়ি থামিয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়ালাম । জঙ্গলের ভেতরে নিস্তব্ধতার মধ্যে সে এক অদ্ভুত গা-ছমছমানি পরিবেশ । প্রতিমূহুর্তে বন্য জন্তুদের দেখতে পাওয়ার এক অনাবিল আকর্ষণ (আমি এই ভাষায় লিখি না, এই দু'টো লাইন সানন্দার প্রতিবেদকের প্রতি একটা ছোট্ট শ্রদ্ধার্ঘ্য) ।

যাওয়ার পথে একজায়গায় চোখে পড়ল উড়ন্ত কাঠবিড়ালী । লবঙ্গীতে পৌঁছে জানা গেল এখন উড়িষ্যা ভোটের জন্য অনেক কিছু বন্ধ - ওয়াচ্‌টাওয়ারেও যাওয়া যাবে না । আমরা লবঙ্গীর ফরেস্ট রেস্ট হাউস পর্যন্ত পৌঁছলাম । এখানেও আর কোনও ট্যুরিস্ট নেই । আমরা কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করে আবার ফেরার পথ ধরলাম । জঙ্গলে ঢাকা পাহাড়ি পথে সম্পূর্ণ অন্ধকারে ফেরার সময়ে থেকে থেকেই কেন জানি না গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠছিল ! (আদৌ উঠছিল না, এটাও ওই - শ্রদ্ধার্ঘ্য !)

পুরুনাকোটেতে চাঁদের আলোয় আড্ডা
কটেজে ফিরে দেখলাম লোডশেডিং । কেয়ারটেকার জানালো কোথায় একজায়গায় হাতি ইলেকট্রিকের তার ছিঁড়ে দিয়েছে - রাতের মধ্যে কারেন্ট আসার সম্ভাবনা কম । আমরা কটেজের সামনের লনে বসে রইলাম । আকাশে পূর্ণচন্দ্র - আর খুব হাল্কা হাল্কা হাওয়া দিচ্ছিল বলে গরম লাগছিল না ।



রাতে রুটি আর চিকেন । এখানেও নন্দিনীদিই রান্না করলেন । আলো না থাকায় আমরা লনেই খোলা আকাশের নিচে বসে যাকে বলে 'মুনলাইট ডিনার' করলাম । পুরুনাকোটেতে আমাদের রাত্রিযাপন এভাবেই শেষ হল ।

পরেরদিন ১৫ই এপ্রিল, ২০১৪ । বাংলা নববর্ষ । আমাদের ফেরার দিন । সকালে লুচি আর আলুর তরকারি দিয়ে ব্রেকফাস্ট করে বেরিয়ে পড়লাম । আগেই বলেছি অঙ্গুল থেকে আমাদের ফেরার কোনও উপায় নেই তাই আমাদের কটক যেতে হবে । কটক থেকে দুপুরে ধৌলি এক্সপ্রেস ধরে হাওড়া ।

কটক স্টেশন
আমাদের গাড়ি আমাদের কটক স্টেশনে ছেড়ে দিল । পুরুনাকোটে থেকে কটক আসতে ঘন্টাতিনেক লাগে । কটকে এসে আমরা স্টেশন থেকে দুপুরের খাওয়া সেরে নিলাম । তারপর ট্রেনে চড়ে হাওড়া ! খতম্‌ !






সারসংক্ষেপঃ

১. উড়িষ্যার কটকের কাছে পাহাড় আর জঙ্গল ঘেরা একটা জায়গা সাতকোশিয়া । এখানকার সিজ্‌ন্‌ নভেম্বর থেকে মার্চ - এই সময়সীমার বাইরে সাতকোশিয়ায় যাওয়ার মানে হয় না, কারণ তাতে এখানে যাওয়ার প্রধান উদ্দেশ্য চরিতার্থ নাও হতে পারে ।
২. সাতকোশিয়ার সবচেয়ে কাছের রেলস্টেশন অঙ্গুল - এখান থেকে গাড়িতে যেতে ঘন্টাখানেক লাগে । হাওড়া থেকে অঙ্গুল যাওয়ার ট্রেন সপ্তাহে একটাই ছাড়ে - শনিবার রাতে । এছাড়া কটক পর্যন্ত্য ট্রেনে গিয়ে তিনঘন্টার গাড়ির জার্নি করেও সাতকোশিয়া যাওয়া যেতে পারে ।
৩. সাতকোশিয়ায় থাকার বা ঘোরার জায়গা প্রধানতঃ চারটে - টিকরপাড়া, ছোটকেই, পুরুনাকোটে আর লবঙ্গী । এদের মধ্যে টিকরপাড়াতে একদিন অবশ্যই থাকা উচিৎ ।
৪. যদিও এখানে বিভিন্ন রুটে সরকারি বাস চলে, কিন্তু সাতকোশিয়ায় ঘোরার জন্য নিজস্ব গাড়ি থাকাই শ্রেয় । অঙ্গুল বা কটক থেকে অল্প খরচে ২ - ৩ দিনের জন্য গাড়ি ভাড়া করে নেওয়া যেতে পারে ।
৫. সাতকোশিয়ার সবজায়গাতেই উড়িষ্যার বনদপ্তরের থাকার জায়গা রয়েছে । বুকিং এর জন্য এদের ওয়েবসাইট http://www.satkosia.org/ দেখা যেতে পারে অথবা ইমেল বা ফোনে যোগাযোগ করা যেতে পারে । ইমেল : dfosatkosiawl@yahoo.co.in, ফোন : 08763102681.
৬. সাতকোশিয়ার বিভিন্ন জায়গায় একটা বড় সমস্যা হল এখানে মোবাইলের নেটওয়ার্ক পাওয়া যায় না বা পাওয়া গেলেও তা খুবই ক্ষীণ । কাজেই বাইরের কারুর সঙ্গে দরকার পড়লেও যোগাযোগ করা যাবে না এটা ধরে নিয়েই সাতকোশিয়ায় যাওয়া উচিৎ ।
৭. এখানে দোকানপাট নেই বললেই চলে - খাওয়াদাওয়ার জন্যও রিসর্টের ওপরেই নির্ভর করতে হয় । নিজের ইচ্ছেমতো খাদ্যসামগ্রীও পাওয়ারও সম্ভাবনা নেই ।

উপসংহারঃ

সাতকোশিয়া 
আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে সাতকোশিয়ার পরিবেশ বেড়ানোর পক্ষে যথেষ্ট অনুকূল নয় । হ্যাঁ, এটা ঠিক নাগরিক পরিষেবা বলতে যে জিনিসগুলো আমরা প্রতিমূহুর্তেই পেতে অভ্যস্ত, তার অনেককিছুই এখানে পাওয়া যায় না, পয়সা ফেললেও না । কিন্তু এটাই হয়তো এই জায়গার ইউ এস পি । প্রতিকূল অবস্থার সঙ্গে মানিয়ে নেওয়াটাও জীবনের একটা শিক্ষা । বিশেষ করে তার পরিবর্তে যদি অসামান্য প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য দেখার সু্যোগ পাওয়া যায় । প্রকৃতির মধ্যে থাকা, প্রকৃতিকে দেখা - এগুলোই সাতকোশিয়ার মূল আকর্ষণ । আমরা এর আগেও প্রকৃতির মধ্যে থেকেছি, কিন্তু এভাবে একেবারে কেন্দ্রস্থলে গিয়ে কখনও পড়িনি । এর একটা আলাদা স্বাদ আছে - অনুভূতি আছে - গন্ধ আছে । আর এগুলোর কোনওটাই যদি টের না পাওয়া যায়, তাহলে নিজের ফুসফুসটাকে চাঙ্গা করতে অন্তত বিশুদ্ধ অক্সিজেন তো আছেই । এইসবকিছুকে পেতে হলে কলকাতা থেকে মাত্র ঘন্টা ৯ ঘন্টার দুরত্বে সাতকোশিয়ায় একবার ঘুরে আসতেই হবে !
বিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ - অফ্‌ সিজ্‌নে সাতকোশিয়ায় নৈব নৈব চ ।

সাতকোশিয়ার আরও ছবি দেখতে হলে click here.