আমি ব্লগ লেখার খুব বেশি সমর্থক কোনওদিনও ছিলাম না, সত্যি কথা বলতে কি এখনও যে আছি তা নয় । তার একটা প্রধান কারণ আমার ধারণা ব্লগ লেখার থেকেও পড়া অনেক বেশি ক্লান্তিকর । অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, অনেক সময়ই পড়তে শুরু করে শেষ করা হয়ে ওঠে না । নিজের ধৈর্য এবং/অথবা আগ্রহের অভাবকে 'ঠিক আছে, বাকিটা পরে পড়ব' জাতীয় অজুহাত দিয়ে ঢেকে দিই - আর আমরা সবাই জানি সেই 'পরে' টা আর কখনওই আসে না । তো, এই কারণে আমি ঠিক করেছি আমার ব্লগকে কখনওই অন্যের ক্লান্তির কারণ ঘটাব না, আমার ব্লগের বিষয় হবে প্রধানতঃ ভ্রমণ । আমার মতো যেসব বাঙালিরা ঘুরতে ভালোবাসে, তাদের জন্য আমার ব্লগ হবে তথ্যের একটা উৎস । আমার নিজের একটা অভ্যেস আছে, কোনও জায়গায় বেড়াতে যাওয়ার আগে সেই জায়গাটা সম্পর্কে কিছুটা জেনে নেওয়ার চেষ্টা করি, আর ইন্টারনেট ঘাঁটতে গিয়ে আমার বরাবরই মনে হয়েছে যে ইন্টারনেটে লেখালেখি করার ব্যাপারে বাঙালিদের থেকে কুঁড়ে খুব কম শিক্ষিত জাতই আছে । আমার মতো যেসব বাঙালিরা আছে, যারা ইন্টারনেটে কোনো একটা ইংরিজীতে লেখা দেখলেই না পড়ার চেষ্টা করে, তাদের জন্য আমার ব্লগ সহায়ক হবে, এই বিশ্বাস নিয়ে শুরু করছি আমার ভ্রমণকাহিনী । আগেই বলে রাখি, আমি স্ট্যাটিসটিক্সের ছাত্র ছিলাম, তাই আমার ব্লগে তত্ত্বের থেকে তথ্যের দেখাই মিলবে বেশি ।

Sunday, June 5, 2016

শঙ্করপুর ভ্রমণ

০১৪ সালে তাজপুর ভ্রমণের পর অফিস থেকে আমরা এবারে গেলাম শঙ্করপুর । পশ্চিমবঙ্গের মেদিনীপুর জেলায় অবস্থিত এই জায়গাটা তাজপুরের মতোই, তবে তাজপুরের তুলনায় বেশি ফাঁকা । সপ্তাহান্তে কলকাতা থেকে একদিনের জন্য ঘুরতে যেতে হলে যে যে অপশনগুলো আছে, শঙ্করপুর তাদের মধ্যে অন্যতম ।

রামনগর স্টেশনে পুরো দল (ফোটোগ্রাফার বৈশাখী বাদে)
৪ঠা জুন, ২০১৬ শনিবার সকালে হাওড়া স্টেশন থেকে তাম্রলিপ্ত এক্সপ্রেসে আমাদের যাত্রা শুরু । ট্রেন ছাড়ে সকাল ৬:৪০ এ আর রামনগর পৌঁছয় ৯:৪৪ এ । এবারে আমাদের দল তিনজন শিশুসহ মোট একুশ জনের - বলা বাহুল্য তিনজনের মধ্যে দু'জন আমাদের যমজ মেয়ে কথা-কলি । এছাড়া অন্যজন কঙ্কনাদির মেয়ে মিঙ্কা । বড়দের নাম আর লিখলাম না । এখানে উল্লেখ করা দরকার আমাদের ট্রিপটার সম্পূর্ণ খরচ আমাদের অফিস বহন করেছে - হাওড়া থেকে হাওড়া পর্যন্ত আমাদের একপয়সাও লাগেনি । ট্রেনে ব্রেকফাস্টের জন্য কুকিজারের চিকেন স্যান্ডউইচ কেনা হয়েছিল, ট্রেন ছাড়ার একটু পরে সেগুলো খেয়ে নেওয়া হল । ট্রেন মাত্র পাঁচমিনিট লেট করে আমাদের পৌঁছে দিল রামনগর স্টেশনে ।

রামনগর থেকে শঙ্করপুর যাওয়ার জন্য ভ্যান, অটো, ট্রেকার পাওয়া যায় আর এখানে এদের একটা রেটচার্ট টাঙানো আছে । কিন্তু আমাদের হোটেল থেকে আগেই দু'টো বড় ট্রেকার ভাড়া করে রেখেছিলাম, সেগুলো আমাদের শঙ্করপুর পৌঁছে দিল সওয়া দশটার একটু পরে ।

অশোকা হোটেলের সামনে সমুদ্র
আমাদের হোটেলের নাম 'অশোকা হোটেল' । এটা একেবারে বিচের ধারেই - ঘর থেকে সমুদ্র দেখা যায় । আমরা মোট আটটা নন-এসি ঘর নিয়েছিলাম আর ঘরভাড়া ৭৫০/- টাকা করে (ডিসকাউন্ট দিয়ে) । ঘরগুলো খুব বড় নয়, তবে আমাদের মেয়াদ মাত্র একরাত, তাই কোনও অসুবিধে হয়নি । ঘরে এসে একটু ফ্রেশ হয়ে নিলাম । তারপর এগারোটা নাগাদ গেলাম সমুদ্র দেখতে ।


শঙ্করপুরের বাঁধানো পাড়
শঙ্করপুরে একটা বড় জায়গা জুড়ে সমুদ্রের পাড় বাঁধানো । অশোকার সামনের পুরোটাই এরকম । এইরকম জায়গায় চান করা যায় না, তাই চান করার জন্য আমাদের আরও কিছুটা এগিয়ে যেতে হল । বাঁধানো পাড় শেষ হওয়ার পর চান করার জায়গাটা খুবই সুন্দর । দুপুরের দিকে জোয়ার ছিল বলে চান করতে আরও আরাম । সঙ্গে বাচ্চা থাকায় অমৃতা আর আমি চান করলাম না, পাড়ে বসেই এনজয় করলাম । এছাড়া সমুদ্রের ধারে গেলে যা করতেই হয় - ডাব খেলাম ।

দুপুরে হোটেলে ফিরে এসে চান করে লাঞ্চ করতে গেলাম । অশোকার ডাইনিং হলটা বেশ বড় - একসঙ্গে ৩০ জন বসে খাওয়া যায় । দুপুরের মেনুতে ছিল ভাত, ডাল, আলুভাজা, পোস্ত, পারসে মাছ, ভেটকি মাছ, চাটনি, পাঁপড় ইত্যাদি । খাবারের কথা উল্লেখ করলাম কারণ এখানকার রান্না অদ্ভুত সুন্দর । প্রত্যেকটা আইটেমই খেতে অত্যন্ত ভালো হয়েছিল আর সেইজন্যই কিছুটা বেশি খাওয়া হয়ে গেল । খাওয়ার পরে দুপুরে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিলাম ।

সমুদ্রের ধারে কথা-কলির সঙ্গে আমরা
বিকেলে আবার সমুদ্রের ধারে । শঙ্করপুর তাজপুর মন্দারমণি - এই ্জায়গাগুলোয় সমুদ্র ছাড়া আর কিছুই নেই, তাই হোটেলে থাকা অথবা সমুদ্রের ধারে গিয়ে বসা এছাড়া আর কিছু করার নেই । শঙ্করপুরে সমুদ্রের ঢেউ ভালোই, আর বাঁধানো পাড়ে একটু নিচের দিকে গিয়ে বসলে জল এসে পায়ে আছড়ে পড়ে, তাই এখানে বসে থাকলে দিব্যি সময় কেটে যায় । সন্ধ্যে সাড়ে সাতটার সময়ে হোটেল থেকে ইভনিং স্ন্যাক্স দিল - চা, ভেজ পকোড়া আর চিকেন পকোড়া । আমরা সমুদ্রের ধারে বসেই এগুলোর সদ্ব্যবহার করলাম । সাড়ে আটটার পরে আমরা আবার হোটেলে ফিরে এলাম ।

ডিনারের মেনু ছিল রুটি, চিকেন কারি আর আইসক্রিম । খাওয়ার পরে ঘরে এসে শুয়ে পড়লাম । আমাদের ঘরটা ছিল একেবারে সামনের দিকের ঘর, তাই সমুদ্রের হাওয়া খুবই দিচ্ছিল । গরমকাল হওয়া সত্ত্বেও ঘরের মধ্যে বেশ আরাম লাগছিল ।

শঙ্করপুরের সূর্য্যোদয় - সমুদ্রের ওপরে হচ্ছে না
পরেরদিন সকালে যখন ঘুম ভাঙল তখন সূর্য্যোদয় হয়ে গেছে । এখন জুনমাস, আর শঙ্করপুরে সমুদ্রের ওপর থেকে সূর্য্যোদয় হয় না । তবে সকালে সমুদ্রের ধারে ঘুরতে ভালোই লাগে । বেলা সাড়ে আটটা নাগাদ আমাদের ব্রেকফাস্ট দিয়ে দিল । লুচি আর আলুর তরকারি । আগেরদিনের লাঞ্চ থেকে শুরু করে এই ব্রেকফাস্ট পর্যন্ত্য পুরোটা খাওয়ার প্যাকেজের মধ্যে - মাথাপিছু খরচ ৬২৫/- টাকা । আমরা দুপুরের লাঞ্চটা এদের থেকে প্যাক করিয়ে নিলাম কারণ সেটা আমাদের ফেরার পথে লাগবে । মেনু হল ফ্রায়েড রাইস আর চিলি চিকেন । এর দাম ১৫০/- টাকা করে । আমাদের ফেরার ট্রেন সেই তাম্রলিপ্ত এক্সপ্রেস যেটা রামনগর থেকে ১০:৩৮ এ ছাড়ে ।

হোটেল থেকে চেক্-আউট করে বেরোলাম তখন সাড়ে ন'টা । আবার ট্রেকার আমাদের স্টেশন পর্যন্ত পৌঁছে দিল । নির্ধারিত সময়ে ট্রেন এল আর আমাদের নিয়ে ছেড়েও দিল । তাম্রলিপ্ত এক্সপ্রেসের হাওড়া পৌঁছনোর নির্ধারিত সময় দুপুর ১:৫০ আর ট্রেন লেট করল পঁচিশ মিনিট মতো । এখান থেকে ট্যাক্সি ধরে বাড়ি !

সারসংক্ষেপঃ

১. কলকাতা থেকে একদিনের জন্য কোথাও যেতে চাইলে শঙ্করপুর একটা ভালো অপশন । জায়গাটা মোটামুটি ফাঁকা, বিশ্রাম নেওয়ার পক্ষে খুব সুন্দর ।
২. হাওড়া থেকে ট্রেনে রামনগর পর্যন্ত গিয়ে সেখান থেকে গাড়ি করে শঙ্করপুর যাওয়া যায় । এছাড়া সরাসরি গাড়ি নিয়েও এখানে যাওয়া যেতে পারে ।
৩. শঙ্করপুরে অল্পসংখ্যকই হোটেল আছে । 'অশোকা হোটেল' তাদের মধ্যে অন্যতম । এখানকার যোগাযোগের নম্বর - 03220-264275 । এছাড়া ইন্টারনেটের মাধ্যমে এদের বুকিং করা যেতে পারে ।
৪. শঙ্করপুরের প্রায় সব হোটেলই সমুদ্রের ধারে । এখানে সমুদ্রের পাড় বেশ কিছুটা জায়গা জুড়ে বাঁধানো - কিছুটা জায়গা আছে যেখানে চান করা যায় ।
৫. শঙ্করপুরের সমুদ্রে ঢেঊ বেশ ভালো - চান করে ভালই লাগবে । সমুদ্রের ধারে অল্প কিছু দোকান আছে ।

উপসংহারঃ

শঙ্করপুর
কলকাতা থেকে সপ্তাহান্তে অর্থাৎ শনিবার গিয়ে রবিবার ফিরে আসার মতো জায়গা কমই আছে - শঙ্করপুর এদের মধ্যে অন্যতম । তাজপুর মন্দারমণি তালসারি বক্‌খালি উদয়পুরের মতো শঙ্করপুরেও সমুদ্র ছাড়া দেখার কিছুই নেই । তাই ঘুরতে যাওয়ার জন্য না গিয়ে বরং বলা যেতে পারে রিল্যাক্স করার জন্য শঙ্করপুর যাওয়া যেতে পারে । এখানে সমুদ্র বেশ সুন্দর - ভালো ঢেউ আছে । সমুদ্রে চান করা যেতে পারে আবার পাড়ে বসে সমুদ্রের দৃশ্যও উপভোগ করা যেতে পারে । আমাদের কোলাহলপূর্ণ দৈনন্দিন জীবনের মধ্যে একটা শান্ত-সুন্দর পরিবেশে একটা দিন কাটানোর এই অভিজ্ঞতা অর্জন করার জন্যই শঙ্করপুর । এখানে হয়তো দেখার অনেক কিছু নেই, কিন্তু যা আছে তা সময় কাটানোর জন্য যথেষ্ট । সবমিলিয়ে খরচও খুব বেশি না । তাই যদি হাতে একদিনের ছুটিও না থাকে, শুধুমাত্র সপ্তাহান্তে একটা দিন কোথাও চলে যাওয়ার জন্য শঙ্করপুর অবশ্যই একটা দূর্দান্ত জায়গা !

শঙ্করপুর ভ্রমণের আরও ছবি দেখতে হলে click here.

ফোটোগ্রাফার যখন ক্যামেরার সামনে
কৃতজ্ঞতা স্বীকার - শঙ্করপুরে অমৃতা বা আমি ক্যামেরা নিয়ে যাইনি কারণ আমাদের ছবি তোলার বিশেষ অবকাশ ছিল না । লেখার সঙ্গের সবক'টা ছবিই আমাদের অফিসের বৈশাখীর তোলা । এছাড়া উপরের লিঙ্কে আরও যা যা ছবি আছে, সেগুলোও ওরই তোলা । কথায় বলে প্রত্যেক সফল পুরুষের পিছনে একজন নারীর অবদান থাকে । শঙ্করপুরের প্রত্যেক সফল ছবির পিছনেও যে একজন নারীরই অবদান ছিল, এই ছবিগুলো তারই প্রমাণ !