আমি ব্লগ লেখার খুব বেশি সমর্থক কোনওদিনও ছিলাম না, সত্যি কথা বলতে কি এখনও যে আছি তা নয় । তার একটা প্রধান কারণ আমার ধারণা ব্লগ লেখার থেকেও পড়া অনেক বেশি ক্লান্তিকর । অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, অনেক সময়ই পড়তে শুরু করে শেষ করা হয়ে ওঠে না । নিজের ধৈর্য এবং/অথবা আগ্রহের অভাবকে 'ঠিক আছে, বাকিটা পরে পড়ব' জাতীয় অজুহাত দিয়ে ঢেকে দিই - আর আমরা সবাই জানি সেই 'পরে' টা আর কখনওই আসে না । তো, এই কারণে আমি ঠিক করেছি আমার ব্লগকে কখনওই অন্যের ক্লান্তির কারণ ঘটাব না, আমার ব্লগের বিষয় হবে প্রধানতঃ ভ্রমণ । আমার মতো যেসব বাঙালিরা ঘুরতে ভালোবাসে, তাদের জন্য আমার ব্লগ হবে তথ্যের একটা উৎস । আমার নিজের একটা অভ্যেস আছে, কোনও জায়গায় বেড়াতে যাওয়ার আগে সেই জায়গাটা সম্পর্কে কিছুটা জেনে নেওয়ার চেষ্টা করি, আর ইন্টারনেট ঘাঁটতে গিয়ে আমার বরাবরই মনে হয়েছে যে ইন্টারনেটে লেখালেখি করার ব্যাপারে বাঙালিদের থেকে কুঁড়ে খুব কম শিক্ষিত জাতই আছে । আমার মতো যেসব বাঙালিরা আছে, যারা ইন্টারনেটে কোনো একটা ইংরিজীতে লেখা দেখলেই না পড়ার চেষ্টা করে, তাদের জন্য আমার ব্লগ সহায়ক হবে, এই বিশ্বাস নিয়ে শুরু করছি আমার ভ্রমণকাহিনী । আগেই বলে রাখি, আমি স্ট্যাটিসটিক্সের ছাত্র ছিলাম, তাই আমার ব্লগে তত্ত্বের থেকে তথ্যের দেখাই মিলবে বেশি ।

Sunday, April 16, 2017

বারকুল (চিল্কা) ভ্রমণ

ভ্রমণপথঃ

বৃহস্পতিবার ১৩ই এপ্রিল, ২০১৭ঃ হাওড়া - রাত ১১ঃ৩০ মিনিটে অমরাবতী এক্সপ্রেস
শুক্রবার ১৪ই এপ্রিল, ২০১৭ঃ সকাল ৬ঃ১০ মিনিট - ভুবনেশ্বর - সকাল ৭ঃ১০ মিনিটের ভুবনেশ্বর-ভিশাখাপত্তনম ইন্টারসিটি এক্সপ্রেস - সকাল ৯ টা - বালুগাঁও - বারকুল । বারকুল - গোপালপুর - বারকুল । বারকুলে রাত্রিবাস ।
শনিবার ১৫ই এপ্রিল, ২০১৭ঃ বারকুলে জলপথে ভ্রমণ - বারকুলে রাত্রিবাস ।
রবিবার ১৬ই এপ্রিল, ২০১৭ঃ বারকুল - বালুগাঁও - সকাল ৮ঃ৪৯ মিনিটের ফলকনামা এক্সপ্রেস - বিকেল ৬ঃ২০ মিনিট - হাওড়া

ভারতবর্ষের ম্যাপ আঁকার সময়ে উড়িষ্যার এক জায়গায় একটা ছোট্ট জলাশয়ের খাঁজ দিতে হয়, মনে আছে ? (এটা না দিলে ভুল হয় না, তবে দিলে শিক্ষক-শিক্ষিকারা বেশি পছন্দ করেন ।) জায়গাটার নাম চিল্কা । ভারতবর্ষের বৃহত্তম আর পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম উপহ্রদ । লেকটা সুবিশাল, তার মধ্যে দু'টো জায়গায় দু'টো ট্যুরিস্ট স্পট আছে - রম্ভা আর বারকুল । এদের মধ্যে বারকুলে ১৪২৩ আর ১৪২৪ বাংলা বছরের সন্ধিক্ষণে সপ্তাহান্তে  দু'দিন কাটানোর অভিজ্ঞতা আমার ব্লগের এবারের বিষয় ।

ট্রেনে বালুগাঁও যাওয়ার পথে
আমাদের এবারের দল রাজগীর-এর অপরিবর্তিত দল । বারকুল যাওয়ার জন্য বালুগাঁওতে নামতে হয় আর হাওড়া থেকে বালুগাঁও যাওয়ার জন্য একাধিক ট্রেন রয়েছে । সবথেকে ভালো ট্রেন হল চেন্নাই মেল কিন্তু টিকিট না পাওয়ার জন্য আমরা ব্রেকজার্নি করতে বাধ্য হলাম । ১৩ই এপ্রিল, ২০১৭ বৃহস্পতিবার রাত ১১ঃ৩০ মিনিটের অমরাবতী এক্সপ্রেস ধরে আমরা পরেরদিন সকাল ৬ঃ১০ মিনিটে ভুবনেশ্বর নামলাম । সেখান থেকে সকাল ৭ঃ১০ মিনিটের ইন্টারসিটি এক্সপ্রেস ধরে সকাল ৯ টায় বালুগাঁও । এই ভুবনেশ্বর থেকে বালুগাঁও যাওয়ার সময়ে প্রাকৃতিক দৃশ্য খুব সুন্দর । মাঝে মাঝেই ছোট ছোট পাহাড় - সেগুলোকে পাহাড় না বলে টিলা বলাই ভাল । এর মাঝখান দিয়ে ট্রেন ছুটে চলেছে । এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি হওয়া সত্ত্বেও গরম সেরকম লাগছিল না, একটা আরামদায়ক হাওয়া সারাক্ষণই পাওয়া যাচ্ছিল ।

বালুগাঁও স্টেশন থেকে বারকুল যাওয়ার জন্য চাইলে ও টি ডি সি (ওড়িশা ট্যুরিজম ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন) থেকে গাড়ি বুক করে রাখা যায় । সেটা না করতে চাইলে শুধুমাত্র অটোই ভরসা । স্টেশন থেকে বারকুলের দূরত্ব ৭ কিলোমিটার মতো আর অটোয় যেতে মিনিট কুড়ির বেশি লাগে না । আমরা দু'টো অটো ধরে পৌঁছে গেলাম বারকুল পান্থনিবাসে ।

ব্যালকনি থেকে চিল্কা
এর আগে চাঁদিপুরে আমরা ও টি ডি সি-তে ছিলাম আর এবারে বারকুলে । জায়গাটা একটা বিশাল চত্বর আর তার মাঝে মাঝে কয়েকটা দোতলা বিল্ডিং । ট্যুরিজমের ব্যাপারে উড়িষ্যা সরকার বিশেষ যত্নবান এটা আগেও দেখেছি - এই রাজ্যের অর্থনীতির অন্যতম প্রধান ভিত্তিই হল ট্যুরিজম । একটা বিল্ডিং-এর দোতলায় পাশাপাশি তিনটে ঘরে আমরা আর কঙ্কনাদিরা থাকলাম । কিছুটা দূরে একটা এ সি কটেজে সমীরণদারা । আমাদের ঘরগুলো সবই লেকের সামনে - প্রত্যেকটা ঘরের সঙ্গেই লাগোয়া ব্যালকনি আছে যেখানে বসে লেকের দৃশ্য উপভোগ করা যায় (দাঁড়িয়েও করা যায়, যেহেতু উপভোগের সঙ্গে আরামের সরাসরি সম্পর্ক আছে তাই বসলে বেশী ভালো লাগে !) । আমরা ঘরে ঢুকে একটু হাতমুখ ধুয়ে চলে গেলাম ডাইনিং হলে ।

চত্বরের মধ্যেই একটা সুবিশাল ডাইনিং হল । ভেতরটা এ সি । এখানে একসঙ্গে অন্ততঃ ৫০ - ৬০ জন বসে খেতে পারে । এখানে ঘরের চার্জের সঙ্গে ব্রেকফাস্ট কমপ্লিমেন্টারি, যদিও প্রথমদিনের ব্রেকফাস্টটা আমরা কমপ্লিমেন্টারি নিলাম না, সেটা আমরা রেখে দিলাম ফেরার দিনের জন্য ।
(অঙ্কটা বোঝা যাচ্ছে না ? বুঝিয়ে দিচ্ছি । আমরা থাকছি দু'দিন । সেই হিসেবে আমাদের দু'টো ব্রেকফাস্ট কমপ্লিমেন্টারি হয় । আমরা প্রথমদিন নিলাম না, দ্বিতীয়দিন একটা আর তৃতীয়দিন সকালে আমরা যখন চেক্‌আউট করব, তখন আরেকটা নিয়ে নেব ।)
ব্রেকফাস্টে আমরা পাঁউরুটি-ডিমসেদ্ধ-কলা আর পুরী-সবজি নিলাম । এখানকার রান্না বেশ ভালো আর খিদেও পেয়েছিল, তাই গপাগপ খেয়ে ফেললাম !

পান্থনিবাসের ভেতরে
ঘরে ফিরে এসে চানটান করে নিলাম । এখানে ঘরে বসে এমনিই সময় কেটে যায় আর আমাদের সঙ্গে ছোটো বাচ্চা থাকায় আমাদের সময় কাটানোর কোনও সমস্যা হয় না (সত্যি বলতে কি, আমাদের মাঝে মাঝে সময়ের অভাবই হয় !) । দুপুরে দু'টো নাগাদ খেতে গেলাম । এখানে একধরনের মাছ পাওয়া যায় - নাম খাইঙ্গা । এটা এই অঞ্চলেরই মাছ, এখানেই লেক থেকে জেলেরা ধরে । একপ্লেটের দাম একপ্লেট পোনা মাছের দ্বিগুণ । আমরা একপ্লেট নিলাম টেস্ট করার জন্য । খেতে অনেকটা ভেটকি মাঝের মতো, তবে ভেটকির মতো অত সুস্বাদু নয় । ভাত, ডাল, আলুভাজা, মাছ আর চিংড়ি নিয়ে আমাদের ন'জনের মোট খরচ পড়ল ২,১৪৫/- টাকা ।

গোপালপুর যাওয়ার পথে
দুপুরে ঘরে বসে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিলাম । বিকেল ৪ টের সময়ে একটা বোলেরো নিয়ে বেরিয়ে পড়া হল গোপালপুরের উদ্দেশ্যে । একটা বোলেরোতে ন'জন ধরা আক্ষরিক অর্থেই 'বেশ চাপের' কিন্ত কথায় বলে "যদি হও সুজন/বোলেরোতে ন'জন" - তাই কষ্টেসৃষ্টে আমরা বসে পড়লাম । বারকুল থেকে গোপালপুরের দুরত্ব ৭৫ কিলোমিটার হলেও যেতে ঘন্টা দেড়েকের বেশি লাগল না তার প্রধান কারণ হল রাস্তাটা দুর্দান্ত । একেবারে মাখনের মতো সুন্দর রাস্তা তাই গাড়িতে বসে বোঝাই যাচ্ছিল না যে মাঝে মাঝে গাড়ির গতি ঘন্টায় ১০০ কিলোমিটারেরও বেশি হয়ে যাচ্ছে । রাস্তার দৃশ্যও খুব সুন্দর - একজায়গায় রাস্তাটা একটা পাহাড়ের গা দিয়ে কিছুটা গেছে । সেখান থেকে চিল্কা লেকের দৃশ্য খুব সুন্দর । এখানে আমরা মিনিট দশেক দাঁড়িয়ে ছবিটবি তুললাম ।

গোপালপুর সি-বিচ্‌
গোপালপুর মানে 'গোপালপুর অন্‌ সি' (কেন যে গোপালপুরকে 'গোপালপুর অন্‌ সি' বলা হয় আমি কখনও বুঝিনি । সমুদ্রের ধারের যেকোনও জায়গাই তো অন্‌ সি । কিন্তু পুরী অন্‌ সি বা দীঘা অন্‌ সি কখনও বলা হয় না, শুধুমাত্র গোপালপুরই অন্‌ সি ।) । গোপালপুরের বিচটা খুব সুন্দর । আমরা যখন পৌঁছেছি, তখন সবেমাত্র সূর্য্যাস্ত হয়েছে । আকাশ আর সমুদ্রের মধ্যে চলেছে রঙের আদানপ্রদান । আবহাওয়া খুবই আরামদায়ক - একটা সুন্দর হাওয়া দিচ্ছিল । গরম একেবারেই লাগছিল না । আমরা কিছুক্ষণ জলে পা-টা দিয়ে পাড়ে এসে বসলাম । বাঁধানো পাড়ে সুন্দর বসার জায়গা করা আছে । এখানে বসে বসে ঘন্টার পর ঘন্টা সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে কাটিয়ে দেওয়া যায় । আমরা অবশ্য অতঘন্টা বসিনি, কিছুক্ষণ বসার পরে ওখান থেকে উঠে এসে একটা দোকান থেকে চিকেন পকোড়া খেয়ে নেওয়া হল । খরচ হল ৩০০/- টাকা ।

৭ টা নাগাদ আমরা ফেরার পথ ধরলাম । ফেরার জন্য সময় বেশি লাগল কারণ রাত্রিবেলা অত জোরে গাড়ি চালানো যায় না, চালানো উচিৎও নয় । বারকুল পান্থনিবাসে পৌঁছতে আমাদের প্রায় ন'টা বেজে গেল । গোপালপুর যাতায়াতের জন্য গাড়ি নিল ২,৫০০/- টাকা । দশটা নাগাদ আমরা ডাইনিং হলে গেলাম । রাতের মেনু ছিল রুটি আর চিকেন কারি । খরচ হল ১,১৯৭/- টাকা ।

লেকের ওপরে সূর্য্যোদয়
১৫ই এপ্রিল, ২০১৭ শনিবার - বাংলা নববর্ষ । সকালে যখন উঠলাম তখন সবে সূর্য্যোদয় হয়েছে । আমাদের ঘরগুলো থেকে খুব সুন্দর সূর্য্যোদয় দেখা যায় । একেবারে লেকের জলের ওপর থেকে সূর্য্য ওঠে । কিছুক্ষণ পরে আমরা ডাইনিং রুমে গেলাম ব্রেকফাস্ট করতে । মেনু আগের দিনের মতোই - এখানে এই মেনুই প্রতিদিন হয় । ব্রেকফাস্ট করে সকাল ৯ টার সময়ে আমরা বেরোলাম জলবিহারে । ও টি ডি সি থেকে বোটে করে বিভিন্ন দ্বীপে যাওয়ার ব্যবস্থা আছে । সেরকমই একটা বোট আমরা ভাড়া করেছিলাম । বোটে ২০ জনের বসার জায়গা আছে । মাথাটা পুরোটাই ছাউনি দেওয়া । বোটে চড়ার জন্য ও টি ডি সি-র নিজস্ব জেটির মতো আছে । সেখান থেকে বোটে চড়ে আমরা রওনা দিলাম 'কালিজাই দ্বীপ'-এর দিকে । চিল্কায় একটা জায়গা আছে যেখানে গেলে ডলফিন দেখতে পাওয়া যায় (মানে গেলে দেখতে পাওয়া যাবেই এরকম কোনও কথা নেই - অনেকটা সুন্দরবনে গিয়ে বাঘ দেখতে পাওয়ার মতো । না, ভুল লিখলাম । হয়তো এতটা অনিশ্চিতও নয় ।) । কিন্তু আমরা গেলাম না কারণ এখন গ্রীষ্মকাল আর এই সময়ে নাকি ডলফিন সেভাবে দেখা যায় না ।

আমাদের বোটে আমরা সবাই
আমাদের এই জলপথে ভ্রমণটা খুবই সুন্দর । চিল্কার সঙ্গে সমুদ্রের যোগাযোগ আছে আর যেহেতু এর পরিসর সুবিশাল তাই এখানে ঢেউও আছে । তারই মধ্যে আমাদের বোট এগিয়ে চলল । রোদের তেজ বেশ বেশি হলেও জলের মধ্যে সেরকম গরম লাগে না - একটা ঠান্ডা হাওয়া বইতে থাকে । এই জলপথে ভ্রমণটা আমাদের মহারাষ্ট্র ভ্রমণ-এ যেদিন আমরা লঞ্চে করে মুম্বই থেকে এলিফ্যান্টা গেছিলাম, সেদিনের মতো ।  পার্থক্য হল সেদিন লঞ্চে আমাদের দল ছাড়াও আরও লোক ছিল আর এবারে শুধু আমরাই ।

কালিজাই মন্দিরের সামনে
প্রায় ৪৫ মিনিট চলার পর আমরা পৌঁছলাম কালিজাই দ্বীপ-এ । এখানে একটা কালিজাই দেবীর মন্দির আছে । দ্বীপটা সবমিলিয়ে খুব একটা বড় না, পুরোটা হেঁটে ঘুরতে বড়জোর ঘন্টাখানেক লাগে । আর সত্যি কথা বলতে কি ঘুরে দেখার মতো সেরকম কিছু নেইও । দ্বীপের মধ্যে একটা ছোট্ট টিলা আছে আর এর ওপরে একটা ছাউনি দেওয়া জায়গা । আমরা সেই ছাউনিটার ওপরে উঠলাম । এটাই দ্বীপের সর্ব্বোচ্চ জায়গা । এখান থেকে অনেকদূর পর্যন্ত দেখা যায় । সেখানে কিছুক্ষণ কাটিয়ে নেমে এসে আমাদের মধ্যে কয়েকজন গেলাম দ্বীপটাকে একটা চক্কর দিতে । কিছুদূর গিয়েই বুঝতে পারলাম দেখার কিছুই নেই, ঝোপঝাড় গাছপালার মধ্যে একটা সিমেন্টের বাঁধানো পায়ে চলা পথ । সেটা দিয়ে দ্বীপের কিছুটা ঘুরে আমরা যেখানে বোট থেকে নেমেছিলাম, সেখানে ফিরে এলাম । ঘড়ি বলছে বেলা সাড়ে দশটা, আর তাই আমরা এবার ফেরার জন্য বোটে উঠে পড়লাম (না, আমরা কালিজাই মন্দিরে ঢুকিনি, পুজো দেবারও কোনও প্রশ্ন ওঠে না) ।

ফেরাটাও একই রকম তাই সেটার সম্পর্কে আর বিস্তারিত লিখছি না । ফেরার সময়েও একই সময় লাগল । বোট থেকে নেমে যখন পান্থনিবাসের দিকে যাচ্ছি, তখন গরমটা টের পাওয়া যাচ্ছিল । এখানে জানিয়ে রাখি চিল্কা হ্রদ হিসেবে সুবিশাল হলেও আদপে এটা একটা হ্রদই, তাই সমুদ্রের মতো সবসময়ে এখানে হাওয়া দেবে এরকম আশা করা ঠিক নয় । বিশেষ করে মাঝে মাঝে বেশ গুমোটই লাগে । তবে জলের ধারে জায়গা, তাই বাতাসে আর্দ্রতা বেশি, তাই গরমে গা পুড়ে যাওয়ার ব্যাপারটা নেই ।

ঘরে ফিরে এসে আবার সেই 'কিছু করার নেই' অর্থাৎ অনেক কিছু করার আছে । দুপুরে খেতে গেলাম দু'টো নাগাদ । মেনু প্রায় একই, তবে মাছের বদলে বেশ কয়েক প্লেট চিকেন নেওয়া হল বলে খরচ কিছুটা কম পড়ল - ১,৪১০/- টাকা । ঘরে ফিরে এসে কিছুক্ষণ বারান্দায় বসে আড্ডা মারলাম ।

ও টি ডি সি-র নিজস্ব ঘেরা জায়গায়
বিকেলে আমাদের আর আলাদা করে কোথাও যাওয়ার ছিল না, তাই পান্থনিবাসের সামনেই ও টি ডি সি-র যে জেটিটা আছে, সেখানে গেলাম । এখানে লেকের কিছুটা জায়গা ও টি ডি সি ঘিরে রেখেছে, সেই ঘেরা জায়গার পাঁচিলের ওপর দিয়ে চাইলে হেঁটে ঘোরা যায় । এখানে নির্দিষ্ট দূরে কয়েকটা বসার জায়গাও রয়েছে । আমরা যখন সেখানে গেলাম, তখন সবেমাত্র সূর্য্যাস্ত হয়েছে, পেছনের পাহাড়ের ওপর সেই দৃশ্য দেখতে ভারী সুন্দর লাগছিল । জায়গাটায় পর্য্যাপ্ত আলো আছে, তাই সন্ধ্যে পেরিয়ে গেলেও কোনও অসুবিধে নেই । আর সবথেকে বড় কথা জায়গাটা ও টি ডি সি-র এলাকার মধ্যে, তাই নিরাপত্তা নিয়েও কোনও সমস্যা নেই ।

এখান থেকে ফিরে এসে আমরা বেরোলাম পান্থনিবাসের বাইরে । কিছু দেখার নেই, তবে একটা বড় দলে সবাই মিলে একসঙ্গে হেঁটে ঘোরাঘুরি করতেও ভালোই লাগে, আর আমরা মাঝে মাঝে সেটাই করে থাকি । পান্থনিবাসের বাউন্ডারির বাইরেই কিছু দোকান আছে, সেখান বসে আমরা বাঁধাকপির পকোড়া, বড়া ইত্যাদি খেলাম । বাঁধাকপির পকোড়াটা বেশ নতুন ধরনের, খেয়ে একেবারেই বোঝা যায় না যে বাঁধাকপি দিয়ে তৈরি । এই দোকানেই আমাদের ডিনার অর্ডার দিয়ে ঘরে ফিরে এলাম । রাত ন'টা নাগাদ গিয়ে ডিনার নিয়ে আসা হল । বলা বাহুল্য, খরচ অনেক কম পড়ল । রুটি আর চিকেন নিয়ে খরচ হল ৮৯৯/- টাকা ।

১৬ই এপ্রিল, ২০১৭ - রবিবার সকালে ঘুম ভাঙল আগেরদিনের থেকেও আগে - তখনও অন্ধকার কাটেনি । এই অবস্থা থেকে আলো ফুটে সূর্য্যোদয় যতক্ষণে হয়, সেই পুরো সময়টা আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে খুব ভাল লাগে । আগেই বলেছি, এখানে জলের ওপর থেকে সূর্য্যোদয় দেখা যায় । বারান্দায় দাঁড়িয়ে সেই দৃশ্য উপভোগ করলাম ।

আমাদের ঘর
সকাল ৮ টা নাগাদ আমরা পান্থনিবাস থেকে চেক্‌আউট করে বেরিয়ে পড়লাম । আমাদের প্রাপ্য ব্রেকফাস্টটা আমরা প্যাক করে নিয়ে নিলাম । আমাদের ফেরার ট্রেন ফলকনামা এক্সপ্রেস বালুগাঁও থেকে সকাল ৮ঃ৪৯ মিনিটে । স্টেশনে আসতে মিনিট কুড়ির বেশি লাগে না । স্টেশনে এসে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পরেই ট্রেন এসে গেল । ফলকনামা একেবারে হাওড়া পর্যন্ত্য যায়, তাই ফেরার সময়ে আমাদের আর ব্রেকজার্নি করতে হবে না । আমাদের সঙ্গে কোনও লাঞ্চের ব্যবস্থা ছিল না, ট্রেনের প্যান্ট্রির খাবারই ভরসা । দুপুরে চিকেনভাত আর নিরামিষ ভাত নিয়ে ভাগাভাগি করে খাওয়া হল ।

ফলকনামার হাওড়া পৌঁছনোর নির্ধারিত সময় বিকেল ৫ঃ৪৫ মিনিট আর মাত্র আধঘন্টা দেরীতে আমরা পৌঁছে গেলাম । তারপর ট্যাক্সিতে বাড়ি !

সারসংক্ষেপঃ

১. কলকাতা থেকে ৯ ঘন্টার ট্রেনের দূরত্বে উড়িষ্যায় চিল্কা হ্রদ একটা বিখ্যাত বেড়ানোর জায়গা । চিল্কায় থাকার জায়গা মূলতঃ দু'টো - বারকুল আর রম্ভা ।
২. বারকুল আর রম্ভা দু'টো জায়গাতেই ও টি ডি সি-র পান্থনিবাস আছে । এদের ওয়েবসাইট https://visitodisha.org/Search-Hotel-List থেকে বুকিং করা যায় অথবা এদের কলকাতার অফিস 'উৎকল ভবন' থেকেও বুকিং করা যায় । উৎকল ভবনের ফোন নম্বর হল - (033)22493653.
৩. শুধুমাত্র বারকুল নয়, ও টি ডি সি-র যেকোনও পান্থনিবাসে প্রবীণ নাগরিকদের জন্য ১০% ছাড় আছে । যদি দলে কোনও প্রবীণ নাগরিক থাকেন তাহলে তাঁর নামে বুকিং করার সময়ে সেটা মাথায় রাখলে ভাল ।
৪. বারকুল পান্থনিবাসের চেক-আউটের সময় হল সকাল ৮ টা অর্থাৎ এদের সময়সীমা ৮ টা থেকে ৮ টা ।
৫. পান্থনিবাসের ঘরগুলো সবই লেকের দিকের । ঘরের ব্যালকনি থেকে লেকের দৃশ্য উপভোগ করা যায় ।
৬. প্রত্যেক ঘরের সঙ্গেই কমপ্লিমেন্টারি ব্রেকফাস্ট রয়েছে । এখানে খাবারের মান বেশ ভালো । এখানে একটা আলাদা ডাইনিং রুম আছে আবার চাইলে ঘরে আনিয়েও খাবার খাওয়া যেতে পারে ।
৭. এখানে বেড়ানোর জায়গা বলতে চিল্কা লেক । লেকে বোটিং করার ব্যবস্থা আছে, আর বোটে করে এখান থেকে কাছাকাছি কালিজাই দ্বীপে যাওয়া যায় ।
৮. বারকুল থেকে কালিজাই দ্বীপ বোটে যেতে ৪০ - ৪৫ মিনিট লাগে । এই দ্বীপে মুলতঃ একটা কালিমন্দির আছে । দ্বীপটা খুব একটা বড় নয়, পুরোটা হেঁটে ঘুরতে ঘন্টাখানেকের বেশি লাগার কথা নয় ।
৯. এখানে একটা জায়গা আছে যেখান থেকে ডলফিন দেখতে পাওয়া যায় । তবে গরমকালে দেখতে পাওয়ার সম্ভাবনা কম বলে আমরা আর এখানে যাইনি ।
১০. বারকুল থেকে চাইলে গোপালপুর যাওয়া যেতে পারে - দূরত্ব ৭৫ কিলোমিটার । গোপালপুরের আলাদা কোনও বৈশিষ্ট্য নেই - শুধুমাত্র একটা সী-বিচ্‌ ।
১১. গোপালপুর যাতায়াতের রাস্তাটা খুব সুন্দর । কিছুটা রাস্তা পাহাড়ের ওপর দিয়ে আর সেখান থেকে লেকের দৃশ্য দেখতে খুবই ভালো লাগে ।
১২. বছরের যেকোনও সময়েই বারকুল যাওয়া যেতে পারে । জলের ধারে হওয়ায় এখানকার তাপমাত্রায় বিশেষ পরিবর্তন দেখা যায় না ।

উপসংহারঃ

চিল্কা
প্রধানতঃ সমুদ্রভিত্তিক পর্যটনশিল্পভিত্তিক রাজ্য উড়িষ্যার একটা অন্যতম পর্যটনের জায়গা হল চিল্কা - যেটা সমুদ্রভিত্তিক নয় । আর চিল্কার এক দিকে বারকুলে পর্যটন শিল্প গড়ে উঠেছে । এখানে সমুদ্রের গর্জন নেই, রয়েছে লেকের নিস্তব্ধতা । এখানে জলের উচ্ছাস নেই, রয়েছে স্নিগ্ধতা । এখানকার জলে স্নান করা যায় না, শুধুই দেখে উপভোগ করত হয় । আর এগুলোই চিল্কার ইউ এস পি । এখানে কাছাকাছির মধ্যে দেখার আর কিছুই নেই কিন্তু তাতে কিছু যায় আসে না । আমাদের মতো যারা বেড়াতে গিয়ে 'ক'টা জায়গা দেখা হল' আঙুলের গাঁট গুণে সেই হিসেব করে না, তাদের জন্য চিল্কা একটা আকর্ষণীয় জায়গা । শান্ত, নিরিবিলি জায়গায় প্রকৃতির সৌন্দর্য্য উপভোগ করার জন্য চিল্কা । দৈনন্দিন একঘেয়ে রুটিনের বাইরে বেরিয়ে একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলার জন্য চিল্কা । কম পুঁজি আর দিনতিনেকের ছুটি সম্বল করে বেড়ানোর মতো জায়গা হল চিল্কা । চিল্কা এমন একটা জায়গা যেখানে বারবার গেলেও একঘেয়ে লাগবে না । আর যারা কখনও যায়নি, তাদের ভালো লাগতে বাধ্য । এই ভালো লাগাটা অনুভব করার জন্য একবার ঘুরে আসতেই হবে - চিল্কা !

বারকুল ভ্রমণের আরও ছবি দেখতে হলে click here.